সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ৯:৩৬ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

যুগান্তর ২৪ বছরে পদার্পণ করেছে। বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে এটি নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আমাদের কোনো শতবর্ষী সংবাদপত্র নেই, অর্ধশতবর্ষী সংবাদপত্রের তালিকাটাও খুব সংক্ষিপ্ত। বরং শুরুতেই ঝরে পড়া প্রতিশ্রুতিশীল সংবাদপত্রের সংখ্যা এগুলোর থেকে অনেক বেশি। অনূর্ধ্ব-৫ বা অনূর্ধ্ব-১০ সংবাদপত্র-মৃত্যুর সংখ্যা এদেশে অনেক। এই অপমৃত্যুর অনেক কারণ রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে প্রধান হলো : কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা, জরিপ ও সমীক্ষা না করেই সংবাদপত্র বের করা; সংবাদপত্রকে কোনো প্রতিষ্ঠানের মর্যাদার অথবা ক্ষমতার প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করা; নিরবচ্ছিন্ন আর্থিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং অন্যান্য সহায়ক কার্যক্রম না থাকা (যেমন সাংবাদিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ), প্রকাশক (অথবা প্রকাশক-প্রতিষ্ঠান) কর্তৃক সংবাদপত্রের সম্পাদক ও অন্যদের নিয়ন্ত্রণ করা; সাংবাদিকদের বেতনভাতা সম্মানজনক এবং নিশ্চিত না হওয়া; পাঠক ধরে রাখা ও তৈরি করার উদ্যোগ না থাকা প্রভৃতি। এ সমস্যাগুলোকে এড়িয়ে গেলে সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের উদ্বেগ থেকেই যাবে। কিন্তু আজ যেহেতু একটি পত্রিকার এক মাইলফলক অতিক্রমের শুভলগ্নে এ নিবন্ধটি লেখা, এটি একটি নেতির চিত্র দিয়ে শুরু না করে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই শুরু করা যাক। অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও পত্রিকাটি তার শক্তিশালী কণ্ঠটি ধরে রাখতে পেরেছে, একটা দল বা মত নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সংবাদ পরিবেশন করতে পেরেছে, ভিন্নমতের কলাম, লেখকদের একত্র করতে পেরেছে, সমাজের অবহেলিত ও প্রান্তিক মানুষজনের দিকে দৃষ্টি দিতে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পেরেছে। এই পত্রিকাটির আরও উন্নতির অনেক সুযোগ রয়েছে; ২. সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে বসলেই বেশ কয়েকটি ছবি আমাদের সামনে ভেসে আসে, যেগুলোর সঙ্গে জড়িত অনেক প্রশ্ন। যেমন দৃশ্যমাধ্যমের প্রাবল্যের যুগে ছাপানো সংবাদপত্র কি টিকে থাকবে? মানুষ কি পত্রিকা আদৌ পড়বে, যেখানে মোবাইল ফোনে মুহূর্তে মুহূর্তে তাজা খবর বা ‘ব্রেকিং নিউজ’ সচিত্র পড়া ও দেখা যায়? যেখানে বিনামূল্যে অসংখ্য সংবাদপত্র পড়া যায় (টেলিভিশনে, ল্যাপটপে), সেখানে পয়সা দিয়ে মানুষ কেন সংবাদপত্র কিনবে? ধরে নেওয়া যাক, মানুষ এখনো (এবং অদূর ভবিষ্যতেও) সংবাদপত্রের সঙ্গে আছে এবং থাকবে-মূলত একটি ঐতিহ্যগত ও সাংস্কৃতিক চর্চা, অভ্যাস ও পছন্দের কারণে-যদি সেই অভ্যাস/চর্চাকে টিকিয়ে রাখতে সংবাদপত্রগুলো সহায়তা না করে, তখন কী হবে? যেমন, মতাদর্শের, বাণিজ্যিক স্বার্থের প্রচারণা-পাঠক কেন তার সঙ্গে যুক্ত হবে, তাকে সমর্থন করে যাবে? যদি সংবাদপত্র সত্য প্রকাশে ভয় পায়, সত্যের সঙ্গে সন্ধি করে চলে, অর্থাৎ তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়, তাহলেই বা কী হবে? যদি সংবাদপত্র তার নিজের ঘর অগোছালো রেখে নানা দুর্বলতা নিয়ে অগ্রসর হয়, তাহলে সেটি কতদূর যাবে? উপরের প্রশ্নগুলোর সমাধান নেই, কিন্তু সামষ্টিকভাবে যদি সংবাদপত্রগুলো, সাংবাদিক, প্রকাশক ও সংবাদপত্রকে সহায়তা করছেন যারা, তারা (বিজ্ঞাপনদাতা-যাদের মধ্যে সরকারও আছে) এবং পাঠক তাদের সমাধান প্রয়াস চালিয়ে যান, তাহলে তা সম্ভব। মনে রাখতে হবে, সংবাদপত্রের কয়েকটি স্বীকৃত ভূমিকা আছে, যেগুলো বিশ্বব্যাপী অসংখ্য সংবাদপত্র তুলে ধরেছে। যেমন, সংবাদপত্রকে বলা হয় একটি দেশের সভ্যতার স্মারক। একটি সভ্য জাতি প্রতিদিন নিজেদের মধ্যে যেসব কথোপকথন করে, প্রশ্ন তোলে এবং তার উত্তর অন্বেষণ করে, যেগুলোর প্রতিফলন সংবাদপত্রে পড়ে, একটি দেশের সংস্কৃতি ও গণতন্ত্র কতটা শক্তিশালী, তারও একটা প্রতিচ্ছবি সংবাদপত্র। বাংলাদেশ তার সামনে অনেকগুলো অর্জনের সম্ভাবনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে-এর একটি হচ্ছে, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত একটি রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হওয়া, যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর স্মার্ট বাংলাদেশ হওয়ার ঘোষণা। আরেকটি হচ্ছে, একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের আবির্ভাব। স্মার্ট বাংলাদেশ শুধু ডিজিটাল ক্ষেত্রে স্মার্ট হলেই তৈরি হবে না, এর কর্মপরিকল্পনায়, জীবনচর্চায়, শিক্ষায়, আচরণে, মননে ও সংস্কৃতিতেও তাকে স্মার্ট হতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশের সংবাদপত্রকে স্মার্ট হওয়ার মানে এর অনলাইনে, ডিজিটাল মাধ্যমে রূপান্তর নয়, বরং এর মুদ্রিত রূপটি ধরে রেখে এর অবস্থানে স্মার্টনেস নিয়ে আসা। একে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তৈরি কোনো আইন যদি তখন চালু থাকে, সংবাদপত্র স্মার্ট হবে না, নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাকেও স্মার্ট বলা যাবে না। অর্থাৎ সংবাদপত্রের ভবিষ্যতের জন্য যা প্রয়োজন-এটিকে একটি শিল্পে পরিণত করে বর্তমানের সমস্যাগুলো সফলভাবে মোকাবিলা করা। এটি যে অসম্ভব তা নয়, বরং সম্ভাবনাটা যতদিন যাবে, বাড়বে। তার একটি কারণ বাংলাদেশের মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে আকাঙ্ক্ষা। ভবিষ্যৎ যেহেতু তৈরি করবে তরুণরা, তাদের চিন্তাভাবনা একটু খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে তারা ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার কারণে আমার সৌভাগ্য হয়েছে প্রতিদিন তরুণদের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটানোর, তাদের কথা শোনা, প্রতিবাদ ও অসম্মতিগুলো শোনার, তাদের প্রত্যাশাগুলো জানার। তরুণরা বাংলাদেশকে একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে দেখতে চায়, কিন্তু অর্থবিত্ত, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ডিজিটাল সক্ষমতার বৈষম্য দেখতে চায় না; তারা গণতন্ত্র চায় কিন্তু দলগুলোকেও এর জন্য তৈরি হতে দেখতে চায়; তারা ধর্মকে হিংসা বা সংঘাত সৃষ্টির জন্য ব্যবহৃত হতে দেখতে চায় না, তারা উগ্রতা, জাতিগত বিদ্বেষ এসব চায় না, তারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চায়। এসব তরুণ তাদের হাতে থাকা নানা ‘ডিভাইসে’ প্রতিদিন বিশ্বকে দেখে। এদের হয়তো একদিন বা দুদিন ভুলিয়ে রাখা যাবে; কিন্তু প্রতিদিন নয়। এই তরুণরা যে মুক্তচিন্তাকে স্বাগত জানায়, একে ধারণ করলে সংবাদপত্রগুলো তাদের বান্ধবে পরিণত হবে। অর্থাৎ ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নিজের প্রয়োজনেই সংবাদপত্রের পাশে দাঁড়াবে। আমি অনেকদিন একটি প্রশ্নের উত্তর তাদের দিতে শুনেছি-মুদ্রিত বই কি উঠে যাবে? তারা বলেছে, না। বই ডিজিটাল ও মুদ্রিত দুই সংস্করণেই থাকবে। মুদ্রিত সংবাদপত্রও থাকবে, তার ছায়াসঙ্গী ডিজিটাল সংবাদপত্রকে নিয়ে। ৩. সংবাদপত্রের বর্তমানের অবস্থান এবং সমস্যাগুলোর দিকে তাকানো যাক এবং এদের সমাধানের দিকেও। কিছু সমাধান হয়তো ছেড়ে দিতে হবে ভবিষ্যতের হাতে, কিন্তু অধিকাংশের সমাধান এখন এবং অদূর ভবিষ্যতের মধ্যেই সম্ভব। প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া উচিত, সংবাদপত্র শিল্পের মর্যাদায় পৌঁছাতে পারেনি। সংবাদপত্রের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু সংখ্যাবৃদ্ধি এর গ্রহণযোগ্যতাকে সুনির্দিষ্ট করে না। অনেক সংবাদপত্র ছাপা হয় নানা করপোরেট হাউজ ও প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে। এগুলোর কোনো কোনোটি প্রকৃত সংবাদপত্র হয়ে উঠতে পারেনি। তারপরও সংবাদপত্রের গ্রহণযোগ্যতা যে কমেছে, তা নয়; বরং বলা যায়, গ্রহণযোগ্যতা আছে, তবে একে আরও ব্যাপক ও টেকসই করতে হবে। তাছাড়া দৃশ্যমাধ্যমের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থেকে এখনো সব সংবাদপত্র যে দরজা বন্ধ করে দেয়নি, সেটি আশাব্যঞ্জক। আজকের সংবাদপত্রকে টিকে থাকতে হচ্ছে নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে, যেমন নানা বিধিনিষেধ, আইনি প্রতিবন্ধকতা, স্ব-আরোপিত সেন্সরশিপ, কোনো কোনো সংবাদপত্রকে সরকারের বিরাগভাজন হওয়া, সরকারি বিজ্ঞাপন না পাওয়া, কোনো কোনো সংবাদপত্রকে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের, বিভিন্ন মতাদর্শপুষ্ট নানা মহলের কোপানলে পড়া প্রভৃতি। এর সঙ্গে আছে কাগজ, কালি ও অন্যান্য অনুষঙ্গের মূল্যবৃদ্ধি অথবা দুষ্পাপ্যতা, বিজ্ঞাপনের অপ্রতুলতা। সাংবাদিকদের চাকরির অনিশ্চয়তা, ওয়েজবোর্ড কার্যকর না হওয়া, বেতনভাতার অপ্রতুলতা-এসব তো আছেই। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী গ্র্যাজুয়েটদের প্রথম পছন্দ হিসাবে সাংবাদিকতা এখনো উপরের সারিতে নেই। প্রেস কাউন্সিল একটি নিষ্ক্রিয় প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এবং নানা বিধিবিধানের নিচে কাজ করার কারণে সাংবাদিকতার চাকরিটি এখন আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া সাংবাদিকদের ভেতর রাজনৈতিক বিভাজনটাও এখন বেশ স্পষ্ট। এসবের পাশাপাশি একটা সম্ভাবনার ছবিও আমরা দেখতে পাই। দেশের নানা সংকটকালে সংবাদপত্র দিকনির্দেশকের ভূমিকা পালন করছে। জনস্বার্থ, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা, নারী ও শিশুর সুরক্ষা, শ্রমিক ও কৃষকদের ন্যায্য পাওনা আদায়, পরিবেশ সুরক্ষা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ অনেক বিষয়ে সংবাদপত্র ক্রমাগত সক্রিয়তা দেখিয়ে যাচ্ছে, জনসচেতনতা তৈরি করছে এবং এসব বিষয়ে জনমত প্রতিফলিত করছে। মুদ্রিত সংবাদপত্র এখনো যে টিকে আছে এবং আরও দীর্ঘকাল থাকাটা যে নিশ্চিত করছে, এর কারণ মোটা দাগে বর্ণিত এর সফলতাগুলো। তবে পাশাপাশি সংবাদপত্রকে বেশকিছু চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যেগুলো আসছে বাইরে এবং ভেতর থেকে; বাইরের বলতে নানা বিধিনিষেধ, বিজ্ঞাপনের অভাব, কাগজ-কালি প্রভৃতির দাম বৃদ্ধি-এসব। ভেতর থেকে চ্যালেঞ্জ আসে সাংবাদিকতায় রাজনীতি ও বিভাজন চলে আসা, চাকরির মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধার অভাব, সাংবাদিকতা একটা স্বাধীন পেশা থেকে চাকরিতে পরিণত হওয়া, সাংবাদিকদের ভেতর ঐক্যের অভাব, হলুদ সাংবাদিকতা, মফস্বলের সাংবাদিক পরিচয়ধারী কিছু ব্যক্তির নানা নীতিবিরোধী কাজে সাংবাদিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা-এসব থেকে। পাকিস্তান আমলে কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং নিষ্পেষণের মুখেও সাংবাদিকদের ভেতর ঐক্য থাকার কারণে সরকারকে অনেক সময় পিছু হটতে হয়েছে। এখন ঐক্যের অভাবে সাংবাদিকদের কোনো ন্যায্য আন্দোলনও দানা বাঁধতে পারে না। এ কারণে আন্তর্জাতিক নানা সংগঠনের-যেগুলো সারা বিশ্বের সাংবাদিকদের স্বার্থরক্ষার জন্য সক্রিয়-সঙ্গে আমাদের সংযুক্তিও তেমন নেই। ফলে বাংলাদেশের কোনো সাংবাদিক তার পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য হেনস্তা বা মামলা-মোকাদ্দমার সম্মুখীন হলেও তার পক্ষে অনমনীয় অবস্থানে সাংবাদিকদের দাঁড়াতে দেখা যায় না। একজন কার্টুনিস্ট তার কার্টুন আঁকার কারণে জেলে গেলেও তার পাশে ঐক্যবদ্ধভাবে সাংবাদিকরা দাঁড়াননি। এ চ্যালেঞ্জগুলোর আদ্যোপান্ত খতিয়ে দেখে সেগুলো মোকাবিলা করা না গেলে সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল হবে না। ভেতরের সমস্যাগুলো ভেতর থেকে, অর্থাৎ সাংবাদিকরা নিজেরাই সমাধান করবেন, এটিও তাদের পেশাগত দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আর বাইরের সমস্যাগুলোর সমাধান আসবে সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত নানা পক্ষের অংশগ্রহণে। সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত পক্ষগুলোর মধ্যে আছে পাঠক থেকে নিয়ে বিজ্ঞাপনদাতা ও সরকার। এদের মধ্যে সরকারের ভূমিকাটাই সম্ভবত প্রধান, অন্তত আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে। আমি নিশ্চিত সরকার (সরকার বলতে আমি শুধু এই সময়ের সরকারকে বোঝাচ্ছি না, বরং যে সরকারই বাংলাদেশের ক্ষমতায় থাকবে, তাদেরও) এ কথাটিকে মূল্য দেয় যে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে নিলে, একে সহযোগিতা করলে লাভ হয় গণতন্ত্রচর্চার, নিশ্চিত হয় প্রশাসনিক, আর্থিক এবং আরও নানা ক্ষেত্রের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি, ক্রমহ্রাস ঘটে দুর্নীতি ও বিচারহীনতার। অর্থাৎ একটি উন্নত দেশ ও সমাজের জন্য মুক্ত সংবাদপত্র অত্যাবশ্যক। ফলে অনাবশ্যক নজরদারি, নানা আইন বা বিধিবিধানের নিয়ন্ত্রণ এক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক। সংবাদপত্র কোনো আইন ভাঙলে, মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করলে, কাউকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হেনস্তা বা তার সম্মানহানি করলে প্রচলিত আইনের ভেতরেই যেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। প্রেস কাউন্সিল সক্রিয় ও স্বাধীন থাকলে একটা সুষ্ঠু সমাধানও হয়। এজন্য সরকার ও সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোর (যত কম ও ঐক্যবদ্ধ, তত ভালো) নিয়মিত যোগাযোগ প্রয়োজন। সংবাদপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত বড় একটি পক্ষ হচ্ছে পাঠক। পাঠক পছন্দ করে নিরপেক্ষ, নির্মোহ সাংবাদিকতা, যার পেছনে শক্তি ও স্বচ্ছতা থাকে। সেটি নিশ্চিত করলে পাঠক কখনো সংবাদপত্র থেকে সরে যাবে না। আজকাল অনলাইনেও পাঠকদের প্রথম পছন্দ জাতীয় সংবাদপত্রগুলো এবং পাশাপাশি স্থানীয় সংবাদপত্রগুলো। আমাদের দৃষ্টিতে তাই শুধু জাতীয় সংবাদপত্র নয়, সারা দেশের জেলা-উপজেলা শহর থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোকেও রাখতে হবে। এরা স্বাস্থ্যবান হলে সারা দেশের সাংবাদিকতা একটা তীব্রতা ও ব্যাপ্তি পাবে। ৪. সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে একটি প্রশ্ন ওঠে : শুধু সংবাদ দিয়েই যেহেতু সংবাদপত্র চলে না, আর কী কী বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত? সংবাদপত্র অবশ্যই একটি সমগ্রের নাম, যাতে জাতীয়, রাজনৈতিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংবাদের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা প্রভৃতি বিষয়ে সংবাদ থাকে, ফিচার ছাপা হয়। ভবিষ্যতে নিশ্চয় এসবের ব্যাপ্তি বাড়বে। আমার এক সাংবাদিক বন্ধু কিছুদিন আগে কিছুটা রসিকতা করে বলেছিল, যেভাবে পরিবারগুলো ছোট হচ্ছে, কাজের মানুষের অভাব দেখা দিচ্ছে, তাতে প্রতিদিনের রান্না ও ঘরগৃহস্থালি নিয়ে সংবাদপত্রের নিয়মিত শাখা থাকতে হবে এবং পুরুষরাও যাতে রান্নাঘরমুখী হন, সেই লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে। কথাটার ভেতর একটা সত্য অবশ্য আছে। সমাজে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোয় যত পরিবর্তন আসবে, তাদের একটা প্রভাব ব্যক্তির ওপর পড়বে। ফলে ভবিষ্যতের ব্যক্তি-সমাজ, ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান সম্পর্কগুলোও অনেক বদলে যাবে। এজন্য সংবাদপত্রকে ভবিষ্যতের নানা চাহিদা-ব্যক্তির, পরিবারের, সমাজের, প্রতিষ্ঠানের মাথায় রেখে কাজ করতে হবে। মানুষ চাইবে অপরাধীর শাস্তি হোক, উপকারীর প্রশংসা হোক। আমরা দেখি, অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনা মানুষের মন থেকে দ্রুত হারিয়ে যায়, যেমন এক ভয়ানক অপরাধীকে জেলে ঢোকানো হলে তার ছবি কিছুদিনের মধ্যে অস্পষ্ট হয়ে যায়। অথচ লোকটি দুই মাসের মধ্যে জামিন নিয়ে মুক্ত হয়ে যে অপরাধ জগতে ফিরে যায়, তা পাঠক জানতেই পারেন না। এজন্য সংবাদপত্রগুলোকে আরও জাগ্রত থাকতে হবে, সংবাদের ফলোআপ নিয়মিত হতে হবে, নানা অধিকার ইস্যুতে একনিষ্ঠ হতে হবে। সংবাদপত্র পাঠক তৈরি করে তাদের ধরে রাখতে পারলে বাজারের সূত্র অনুযায়ী বিজ্ঞাপন পাবে। অর্থাৎ ভবিষ্যতের সংবাদপত্র যাতে পাঠকরাই নিজের উদ্যোগে, স্বার্থে, প্রয়োজনীয়তায় এবং দায়িত্ববোধ থেকে বাঁচিয়ে রাখেন, তার শ্রী বৃদ্ধি করেন, সেই লক্ষ্যে সংবাদপত্রকে কাজ করতে হবে। সংবাদপত্রের একটা ভবিষ্যৎ যে আছে, সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত, যদিও তার রূপ ঠিক কী হবে, তা এখনই বলা মুশকিল। আমরা নিশ্চিত পাঠকও থাকবে। কিন্তু পাঠকের সঙ্গে সেই নিবিড় সংযুক্তি-যার ফলে এর আর্থিক সংগতি ও অন্য অনেক আনুষঙ্গিক আবশ্যকতা নিশ্চিত হবে-মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী করার দায়িত্ব সংবাদপত্রের অর্থাৎ সাংবাদিকদের। এ কথাটি মনে রেখে অগ্রসর হলে ভবিষ্যতের পথটা মসৃণ হবে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক