‘বইয়ের জবাব বইয়ে দিতে হবে নিষিদ্ধ করে নয়’: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ৭:৩৬ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

বইমেলা নানাভাবে বিপদগ্রস্ত। করোনার কারণে তো দুই বছর বইমেলা হলোই না। এ বছর বইমেলা বিপদগ্রস্ত কাগজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে। কাগজের দাম এত বেড়ে গেছে যে, দেশের বেশির ভাগ প্রকাশকই তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারছেন না। ফলে এ বছর মেলায় বই প্রকাশ অনেক কমে যাবে। অবশ্য এটা ঠিক যে, বইয়ের সংখ্যা দিয়ে শিল্প-সাহিত্যের উৎকর্ষতার বিচার করা যায় না। বইমেলার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাংলা একাডেমিও নানা জটিলতার মধ্যে পড়েছে। যদিও বইমেলা করা বাংলা একাডেমির কাজ নয়। কয়েকটি বই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ কারণে প্রকাশককে স্টল দেওয়া হয়নি। এগুলো করা ঠিক না। বই হচ্ছে একজন লেখকের চিন্তা, চেতনা, অনুভূতি ও মননশীলতার সন্তান। বইকে নিষিদ্ধ করা উচিত না। বইয়ের জবাব দিতে হবে বই দিয়ে। লেখকের চিন্তার সঙ্গে পাঠকের চিন্তার মিল না থাকতেই পারে; কিন্তু চিন্তাকে রুদ্ধ করা যায় না। ভিন্নচিন্তা, ভিন্নমত সমাজকে সক্রিয় রাখে, গতিশীল রাখে; সমাজের প্রাণস্পন্দনকে নিরন্তর জাগিয়ে রাখে। বইমেলা করা বাংলা একাডেমির দায়িত্ব নয়, বইমেলার দায়িত্ব প্রকাশককে নিতে হবে। পৃথিবীর সব দেশে প্রকাশকরাই মেলাটির দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে বইকে কেন্দ্র করেই মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মতো প্রকাশনার ক্ষেত্রেও নানা বিষয়ে নানা বিরোধ আছে, মতপার্থক্য আছে; কিন্তু বইমেলার ব্যাপারে একটা ঐকমত্য থাকবে-এটি আশা করি। আমাদের বইমেলায় কেবল বইকেন্দ্রিক মানুষেরই আগমন ঘটে না। অনেক মানুষ আসেন সামাজিকভাবে মেলামেশার জন্য, বিনোদনের জন্য। কারণ, আমাদের সামাজিক সম্মিলনের জায়গা এবং উপলক্ষ্য অনেক সংকুচিত হয়ে গেছে। বইমেলায় বিনোদনপ্রত্যাশী অনেক মানুষের ভিড়, বইমেলার নিজস্বতা এতে আহত হয়। বইমেলায় বই নিয়ে যারা আগ্রহী, তাদের আনা দরকার। সেটা কমে আসছে। ভিড়ের মধ্যে যদি ‘বই’ হারিয়ে যায়, তাহলে ‘বইমেলা’ও গৌণ হয়ে যাবে। তাই ‘বইমেলার মূল চরিত্র রক্ষা করা দরকার বইকেন্দ্রিক মানুষের আগমন নিশ্চিত করার জন্য। এখানে মিডিয়ার ভূমিকা রাখা দরকার। তারা তাদের আয়োজনে বইকে তুলে ধরতে পারে। সেটা খুব ভালো কাজ হবে। বই প্রকাশ একটা কঠিন কাজ। বইয়ের বিপণনের জন্য একটা সুন্দর ব্যবস্থা গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। এটা প্রকাশকদের উদ্যোগেই করতে হবে। এক্ষেত্রেও মিডিয়া অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। শুধু একুশের বইমেলানির্ভর যে প্রকাশনা, সেই নির্ভরতা কমাতে হবে। বইকে আমাদের জীবনের অনুষঙ্গ করে তুলতে হবে। দেশের প্রতিটি শহরে একটি সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে তোলা প্রয়োজন। সেখানে বইয়ের জন্য আলাদা স্থান করে দিতে হবে। সেটা হতে পারে লাইব্রেরিগুলোকে কেন্দ্র করে। বাংলাবাজার যেমন বইয়ের বিপণনের পীঠস্থান ছিল, তেমনই সময়ের প্রয়োজনে বই বিপণনের নতুন পীঠস্থান গড়ে তুলতে হবে জেলা, উপজেলা শহরগুলোয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক বলয় তৈরিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীলক্ষেতের মার্কেটটি হয়ে উঠতে পারে বইয়ের বেষ্টনী। একসময় যে জায়গাটিতে নীলক্ষেতের পুলিশ ফাঁড়ি ছিল, সেখানে গড়ে তোলা যেতে পারে বইয়ের হাব-বড় একটি কমপ্লেক্স নির্মাণ করে এখানে নতুন বই পাড়া গড়ে তোলা যায়। যেখান থেকে সারা দেশে বই বিপণনের কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এ কাজে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকেও কাজে লাগানো যেতে পারে। বই নতুন চিন্তা, ভিন্নমতকে ধারণ করে। জীবনকে বহুমাত্রিক উপলব্ধির ভেতর দিয়ে সমৃদ্ধ করে। বই মানুষকে বাঁচাতেই শুধু শেখায় না, বাঁচাটাকে অর্থপূর্ণ ও সার্থক করে তোলে। বই আমাদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু, অনন্য আশ্রয় বটে। এবারের বইমেলায় ‘কথা প্রকাশ’ থাকে ‘মুক্তি কতদূরে’, ‘বাতিঘর’ থেকে ‘স্বপ্ন ছিল থাকবেও’ এবং ‘অনন্যা’ থেকে ‘ইংরেজি সাহিত্যে অশুভের তিন ধারা ও কয়েকটি প্রসঙ্গ’-আমার এ বইগুলো বের হবে। অনুলিখন : শুচি সৈয়দ