দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর রাজধানীর ঐতিহাসিক স্থাপনা

৯ জুন, ২০২৫ | ৫:৫৫ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

ঈদুল আজহার ছুটিতে রাজধানী ঢাকা যেন পরিণত হয়েছে এক নিস্তরঙ্গ শহরে। উৎসবের আবহে অধিকাংশ নগরবাসী ছুটে গেছেন আপন ঠিকানায়—গ্রামের বাড়িতে প্রিয়জনের সান্নিধ্যে ঈদ উদযাপন করতে। এই ফাঁকা শহরে থেকে যাওয়া মানুষরা পরিবার-পরিজন নিয়ে খুঁজে নিচ্ছেন স্বস্তির নিঃশ্বাস, ছুটছেন নগরীর ঐতিহাসিক ও বিনোদনপ্রিয় স্থাপনাগুলোতে। দর্শনার্থীদের পদচারণায় প্রাণ ফিরে পেয়েছে ঢাকার নানান দর্শনীয় স্থান। এরই মাঝে ঈদের আনন্দে অন্যতম গন্তব্য হয়ে উঠেছে ইতিহাসবিদ্ধ মোগল আমলের স্থাপত্য লালবাগ কেল্লা। রোববার ঈদের দ্বিতীয় দিন দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত লালবাগ কেল্লার আনাচে-কানাচে দেখা গেছে উপচেপড়া দর্শনার্থীদের ভিড়। নানা বয়সি নারী-পুরুষ ও শিশুরা পরিবারসহ ঘুরে বেড়াচ্ছেন ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটির বিভিন্ন অংশে। কেউ কেউ ইতিহাসের গন্ধ নিতে, কেউবা ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে এসেছেন এই কেল্লায়। সরজমিনে দেখা যায়, ঈদুল আজহার ছুটির এই দিনে লালবাগ কেল্লা ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে উৎসবমুখর পরিবেশ। সকাল থেকেই ৮ থেকে ৮০ বছর বয়সি নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ—বয়োজ্যেষ্ঠ বৃদ্ধ, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসার শিক্ষার্থী, পরিবার নিয়ে আসা অভিভাবক, তরুণ-তরুণী এবং সাধারণ দর্শনার্থীরা—ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ও দেশের নানা প্রান্ত থেকে এখানে ভিড় করছেন। কেউ এসেছেন ইতিহাসের টানে, কেউ ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে, আবার কেউ এসেছেন নিছক ঘোরার উদ্দেশ্যে। কেল্লার চত্বরে শিশুদের ছুটোছুটি, পরিবারের পিকনিক আয়োজন, তরুণদের ফটোসেশন আর প্রবীণদের স্মৃতিচারণ মিলেমিশে এক অনন্য আবহ তৈরি করেছে। পাশাপাশি, বিদেশি দর্শনার্থীরাও এসেছেন লালবাগ কেল্লার ইতিহাস, স্থাপত্য ও ঐতিহ্য নিজ চোখে দেখতে, মোবাইল বা গাইডবুকের সাহায্যে খুঁটিনাটি তথ্য জানার চেষ্টা করছেন তারা। ধানমন্ডি থেকে ঘুরতে আসা মো. বিল্লাল বলেন, প্রতি বছরই ঈদের সময় ঢাকার বাইরে কোথাও ঘুরতে যাই। এবার ঠিক করলাম লালবাগ কেল্লা ঘুরে দেখি। ঢাকা শহরে ঘোরার জায়গা কম, কিন্তু এখানে এসে মনে হলো পরিবেশটা সুন্দর। কাঁঠালবাগান থেকে আসা মোস্তফা কামাল রাব্বি তার স্ত্রী তামান্নাকে নিয়ে এসেছেন লালবাগ কেল্লা ঘুরতে। রাব্বি জানান, স্ত্রীর অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল লালবাগ কেল্লায় ঘুরতে আসার। অবশেষে আজ তা পূরণ হলো। তামান্না বলেন, শৈশবে বইয়ে পড়েছিলাম লালবাগ কেল্লা অনেক সুন্দর। এবার এসে বাস্তবে দেখে ভালো লাগছে, যদিও রোদ একটু বেশি, তবুও মজা পাচ্ছি। ঝিনাইদহের এক পরিবার ঢাকা শহরের নবাবগঞ্জ এলাকায় বসবাস করেন। ঈদের ছুটিতে দুই পরিবারের আটজন সদস্য মিলে এসেছেন লালবাগ কেল্লায়। ঘুরে তারা জানালেন, এটি ঈদের দিন কাটানোর এক দারুণ জায়গা। মোহাম্মদপুর থেকে খন্দকার আহমেদ ইমতিয়াজও এসেছেন পরিবার নিয়ে। তিনি বলেন, ছেলে-মেয়েরা পরীক্ষায় লালবাগ কেল্লা সম্পর্কে প্রশ্ন পেয়ে আগ্রহ দেখায়। তাই ঈদে ঘুরতে চলে এসেছি। পরিবেশ সুন্দর, তবে দর্শনার্থীদের ফেলানো ময়লার কারণে কিছুটা অস্বস্তিকর লাগে। যদি সবাই ময়লা ডাস্টবিনে ফেলত, তাহলে সৌন্দর্য আরও বাড়ত। বেইলিরোড সিদ্ধেশ্বরী থেকে অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ইসলাম শেখ তার স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে এসেছেন কেল্লা দেখতে। ঢাকায় ১০ বছর থাকার পর এবারই প্রথম এসেছেন এখানে। তিনি বলেন, ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসেবে জায়গাটা দারুণ। তবে জাদুঘরের ভেতরে যেসব নিদর্শন রয়েছে, সেগুলোর পাশে পরিচিতিমূলক বোর্ড বা লেখা থাকলেও কিছুই বোঝা যায় না। শিশু-কিশোরদের শেখার জন্য এটা দরকার। তাই এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ আরও যত্নবান হওয়া উচিত। হাজারীবাগের বাসিন্দা গোলাম রহমান জানান, লালবাগ কেল্লা এক সময় পুরান ঢাকার অন্যতম জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান ছিল। এটি একটি প্রাচীন ঐতিহাসিক দুর্গ ও জাদুঘর, যেখানে আগে প্রচুর মানুষ ঘুরতে আসতো। কিন্তু বর্তমানে এটি অবহেলা ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধার অভাবে আগের মতো দর্শনার্থী টানতে পারছে না। তারপরও ঈদের মতো উৎসবের দিনে একটু প্রশান্তি পেতে এখনো অনেকেই এখানে আসেন। তাঁর মতে, আধুনিক প্রজন্ম যেখানে পার্ক ও শপিং মলে বেশি আগ্রহী, সেখানে লালবাগ কেল্লার ইতিহাস-ঐতিহ্য জানার মতো অনেক কিছুই রয়েছে, যা জানা ও সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। লালবাগ দুর্গ জাদুঘরের সহকারী কাস্টোডিয়ান মো. তানজিলুর রহমান জানান, গত ঈদুল ফিতরের তুলনায় এবারের ঈদুল আজহার প্রথম দিনে দর্শনার্থীর সংখ্যা কম থাকলেও দ্বিতীয় দিনে তা অনেক বেড়েছে। কর্মচারীদের ছুটি থাকা সত্ত্বেও আজ সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আমরা জাদুঘর খোলা রেখেছি। ঈদের ছুটির পুরো সপ্তাহজুড়েই একইভাবে খোলা থাকবে। তিনি আরও জানান, প্রবেশ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য ৩০ টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য ১০ টাকা, বিদেশিদের জন্য ৪০০ টাকা এবং সার্কভুক্ত ও বে অব বেঙ্গল সদস্যদের জন্য ২০০ টাকা। এছাড়াও ঈদের দিন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বিনামূল্যে প্রবেশের সুযোগ রাখা হয়েছিল। ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও নগরজীবনের ক্লান্তির মাঝে খানিকটা অবকাশ পেতে লালবাগ কেল্লা এখন ঢাকাবাসীর এক জনপ্রিয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। তবে পরিচ্ছন্নতা ও তথ্যসমৃদ্ধ পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে এর আকর্ষণ আরও বাড়বে বলে মনে করছেন দর্শনার্থীরা।