বাংলাদেশ তদন্তে দুর্নীতির প্রমাণ, অধরা জড়িতরা তদন্তে দুর্নীতির প্রমাণ, অধরা জড়িতরা

৩১ জানুয়ারি, ২০২৩ | ৯:৫৯ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচিতে (সিপিপি) শতাধিক পদের নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে। সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ের এক তদন্ত প্রতিবেদনে এ চিত্র পাওয়া যায়। প্রতিবেদন নিয়ে প্রায় এক বছর গড়িমসি করে শেষ পর্যন্ত নিয়োগ কার্যক্রম বাতিল করে মন্ত্রণালয়। তবে তদন্তে অনিয়মের প্রমাণ মিললেও দায়ীদের বিরুদ্ধে এখনও নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। আর এ সুযোগে ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন তাঁরা। প্রতিবেদনে দেখা যায়, লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ছাড়াই নির্বাচিত, যোগ্য প্রার্থীর নম্বর কমিয়ে দেওয়া, উত্তরপত্র বদল, পছন্দের প্রার্থীদের প্রাপ্ত নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। লিখিত পরীক্ষার খাতায় নম্বর কাটাকাটিরও প্রমাণ পাওয়া যায়। ২০২০ সালের ১৬ জুন ১০৮ পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সিপিপি। ২০২১ সালের ২৮ আগস্ট লিখিত পরীক্ষার পর ৩০ আগস্ট ফল প্রকাশ হয়। মৌখিক পরীক্ষা শেষে ওই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশ হয় চূড়ান্ত ফল। এতে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ সেপ্টেম্বর ফল স্থগিত করা হয়। এর পর অক্টোবরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব শেখ মো. মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করে তদন্তের দায়িত্ব দেয় মন্ত্রণালয়। ১৩ মাস আগে কমিটির পক্ষ থেকে তদন্ত প্রতিবেদন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিবের কাছে জমা দেওয়া হয়। প্রতিবেদন জমা হওয়ার অন্তত এক বছর পর এই জানুয়ারিতে নিয়োগ কার্যক্রম বাতিল করে মন্ত্রণালয়। তবে নিয়োগের অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত সবাই আড়ালেই থেকে যায়। মন্ত্রণালয়-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সিপিপির নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে বেশ কয়েকজন জড়িত। এর মধ্যে বড় ভূমিকা রাখা দু'জন হলেন- সিপিপির প্রধান কর্মকর্তা আহমাদুল হক ও তৎকালীন সচিব মো. মোহসীন। এ কারণে ওই সময় তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলেও ব্যবস্থা নেননি সচিব মো. মোহসীন। বর্তমানে তিনি অবসরে আছেন। আর নিয়োগ কার্যক্রমে অনিয়ম প্রমাণিত হলেও এখনও বহাল তবিয়তে আছেন আহমাদুল হক। তদন্ত প্রতিবেদনে আহমাদুল হক যে অসহযোগিতা করেছেন- তাও উল্লেখ করা হয়। এ পটভূমিতে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে আহমাদুল হক বলেন, 'এটা মন্ত্রণালয়ের বিষয়।' নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এটা তদন্ত হয়েছে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা মন্ত্রণালয় নেবে।' তদন্তে আপনার অনিয়ম-দুর্নীতিই প্রাধান্য পেয়েছে, এ ব্যাপারে কী বলবেন? জবাবে আহমাদুল বলেন, 'তদন্তে কী আছে আমি জানি না, মন্ত্রণালয় জানে, তাদের জিজ্ঞাসা করেন।' দায়ীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে- জানতে চাইলে কোনো উদ্যোগের কথা জানাতে পারেননি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব কামরুল হাসান। তিনি বলেন, 'বিষয়টি নিয়ে আমরা ভাবছি, এখানে আরও কিছু বিষয় আছে, সেগুলো বিবেচনা করে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।' দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেন, 'এ নিয়োগ বাতিলের সময় দায়ীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি।' তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি- এমন তথ্য জানালে প্রতিমন্ত্রী বলেন, 'বিষয়টি আমি দেখছি।' তদন্তে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির ১৮ ক্যাটাগরির ১০৮ শূন্য পদের মধ্যে সাত ধরনের পদে ৩৬ প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম করা হয়েছে। তাদের লিখিত পরীক্ষার নম্বর উদ্দেশ্যমূলকভাবে বাড়িয়ে চূড়ান্ত নির্বাচন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, জুনিয়র সহকারী পরিচালক পদের প্রার্থীদের দু'জনের উত্তরপত্র বদল করে নম্বর বাড়ানো হয়েছে। একই পদের তিনজনের প্রাপ্ত নম্বর কাটাকাটি করে বাড়ানো হয়েছে। সহকারী কাম রেডিও অপারেটর পদের একজনের কাটাকাটি করে অস্পষ্টতা তৈরি করে বাড়তি নম্বর দেওয়া হয়েছে। রেডিও ওয়ার্কশপ সহকারীর তিনটি শূন্য পদে ছয়জন আবেদন করেন। পরীক্ষায় অংশ নেন তিনজন। ৭০ নম্বরের মধ্যে তিন পরীক্ষার্থীর একজন পান ১৮, অন্য দুই প্রার্থী পান ১৬ ও ১৫.৫ নম্বর। অর্থাৎ তারা পরীক্ষায় পাস না করলেও তাদের উত্তীর্ণ দেখানোর পর চূড়ান্তভাবেও নির্বাচন করা হয়। সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি হয়েছে স্পিডবোট ড্রাইভার পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে। এ পদে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় উপস্থিতই ছিলেন না। তার পরও তাঁকে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ দেখিয়ে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দিয়ে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত দেখানো হয়। তদন্ত কমিটি বলছে, নিয়োগ প্রক্রিয়ার কোনো এক পর্যায়ে এ অনিয়ম ধরা পড়া উচিত ছিল, তবে তা হয়নি। এ পদে ১১ শূন্য পদের বিপরীতে মাত্র ১৩ প্রার্থী পরীক্ষায় অংশ নেন। রেডিও ওয়ার্কশপ ও স্পিডবোট ড্রাইভার পদে যথেষ্ট প্রতিযোগী ছিল না বলে তদন্ত কমিটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করে। শুধু নম্বর ও প্রার্থী জালিয়াতিই নয়, নিয়োগ কমিটির সদস্যদের কিছু বিষয়ে অন্ধকারে রাখা হয়েছে বলে তদন্তে উঠে আসে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, প্রার্থী চূড়ান্ত করতে নিয়োগ কমিটি ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর শেষ বৈঠক করেছিল। চূড়ান্ত সুপারিশে একজন সদস্যের সই নেই। তিনি বৈঠকে উপস্থিত, না অনুপস্থিত ছিলেন- তা কার্যবিবরণীতে উল্লেখ ছিল না। আরেক সদস্য বৈঠকে উপস্থিত থাকলেও নিয়োগের চূড়ান্ত ফলে তার সই নেই। এতে নিয়োগ চূড়ান্ত করার বিষয়ে সব সদস্য যে একমত ছিলেন না, তা তদন্তে ধরা পড়ে। তদন্ত সূত্র জানায়, মৌখিক পরীক্ষায় কয়েকটি বোর্ডের মধ্যে একটির আহ্বায়ক ছিলেন নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক নিজেই। তাঁর বোর্ড থেকে প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষার ফলাফলে বোর্ডের আর কোনো সদস্যের সই নেই, শুধু আহ্বায়কের সই পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এ বোর্ডে ১৩ পদের মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। যেভাবে নম্বর জালিয়াতি: অষ্টম গ্রেডের জুনিয়র সহকারী পরিচালকের ১১ পদে নির্বাচিত চূড়ান্ত প্রার্থীর মধ্যে পাঁচজনের নম্বর জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এর মধ্যে ৪৯৭৩ রোলধারী প্রার্থীর প্রাপ্ত ৪৯ নম্বরকে বাড়িয়ে ৫৭ করা হয়েছে। ৩৩৭০ রোলধারীর প্রাপ্ত ৫০ নম্বর থেকে বাড়িয়ে ৫৭, ২৮২০ রোলধারীর প্রাপ্ত ৫০ নম্বর বদলে ৫৪, ১৭০১ রোলধারীর প্রাপ্ত ৫১ থেকে ৫৪, ৩৮৫৯ রোলধারীর প্রাপ্ত ৫০ নম্বরকে ৫৩.৫ নম্বর দেখানো হয়েছে। এভাবে নম্বর বাড়িয়ে একাধিক যোগ্য প্রার্থীকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ২০তম গ্রেডের অফিস পিয়নের ১০ পদের বিপরীতে ছয়টিতেই নম্বর জালিয়াতি হয়েছে। একই গ্রেডের অন্য পদে ২০ প্রার্থীর মধ্যে ১২ জনের নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। নৈশপ্রহরীর ১৭ পদের মধ্যে চারজনের নম্বর বাড়ানো হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এভাবে সহকারী কাম রেডিও অপারেটরের ১৯ পদের মধ্যে ছয় প্রার্থীর নম্বর জালিয়াতি করে বাড়ানো হয়েছে। ১৬তম গ্রেডের জিপ ড্রাইভারের চার পদের মধ্যে দুটিতে নম্বর জালিয়াতি করে বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে এ পদের ০০১৪ রোলধারীর লিখিত পরীক্ষায় প্রাপ্ত ৩৫ নম্বর কমিয়ে ৩৩.৫ দেখানো হয়েছে। এতে যোগ্য এ প্রার্থী চূড়ান্ত ফলে হয়ে যান অযোগ্য। তথ্য দিতে টালবাহানা: চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর নিয়োগ কার্যক্রম নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শেখ মো. মনিরুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি তদন্তের প্রয়োজনে চাওয়া তথ্য সিপিপির অফিস-প্রধান ও পরিচালক (প্রশাসন) আহমাদুল হক গড়িমসি করেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব আহমাদুল হকের কাছে তদন্ত কমিটি লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ফলের আলাদা টেবুলেশন শিট চেয়েছিল। তবে আহমাদুল হক সেই তালিকার পূর্ণাঙ্গ কপি তদন্ত কমিটিকে দেননি। আংশিকভাবে যেগুলো দিয়েছেন, সেগুলোর সঙ্গে চূড়ান্ত তালিকার নম্বরের গরমিল পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে তদন্ত কমিটি অন্য উপায়ে টেবুলেশন শিট সংগ্রহ করে তদন্ত কাজ শেষ করে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নিয়োগ কার্যক্রম বাতিল করা ভালো উদ্যোগ। তবে এই অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে দুর্নীতি আরও বাড়বে। তিনি বলেন, সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিয়ে সেটা জনগণকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো উচিত। তাহলে মানুষ দুর্নীতি করতে ভয় পাবে।