অবস্থান থেকে সরে এলো ইসি

২৮ জানুয়ারি, ২০২৩ | ১০:২১ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ইভিএমে আঙুলের ছাপ দিয়ে সর্বোচ্চ ১ শতাংশ ভোটারের ব্যালট ইস্যুর বিধান আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না। আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে নিজেদের এ সংক্রান্ত প্রস্তাব থেকে সরে এসেছে নির্বাচন কমিশন। এখন এটি বাদ দিয়েই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রধান আইন ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে’ (আরপিও’র) সংশোধনীর নতুন খসড়া সম্প্রতি চূড়ান্ত করেছে কমিশন। আরও কয়েকটি ধারায় ইসির প্রস্তাবিত সংশোধনী বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে নতুন খসড়ায় ১৫-১৭টি ধারা-উপধারায় সংশোধনীর প্রস্তাব রাখা হয়েছে। গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান ও বেগম রাশিদা সুলতানার সঙ্গে নির্বাচন ভবনে আইন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়। সেখানের সিদ্ধান্তের আলোকে আরপিও’র সংশোধনী তৈরি করা হয়। ইসি ও আইন মন্ত্রণালয় সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে। ইসি সূত্র জানায়, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটার শনাক্তে আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়। এরপর ভোট দেওয়ার জন্য ব্যালট ইস্যু করা হয়। এক্ষেত্রে আঙুলের ছাপ না মিললে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা (সহকারী প্রিসাইডিং) নিজ আঙুলের ছাপ দিয়ে ব্যালট ইস্যু করেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তার আঙুলের ছাপ দিয়ে কত শতাংশ বা কতজন ভোটারের ব্যালট ইস্যু করতে পারবেন তা নিয়ে আরপিওতে সুনির্দিষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। এমনকি বিধিমালাতেও তা স্পষ্ট নয়। এ নিয়ে কয়েকটি নির্বাচনে বিতর্ক ওঠে। এ অবস্থায় বর্তমান কমিশন নির্বাচনে স্বচ্ছতার স্বার্থে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাকে সর্বোচ্চ ১ শতাংশ ব্যালট ইস্যুর ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করে। বিষয়টি আরপিওতে যুক্ত করে সংশোধনীর প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিল। কিন্তু এখন নিজের ওই প্রস্তাব থেকে সরে এসেছে ইসি। এ বিষয়ে ইসির আইন সংস্কার কমিটির প্রধান ও নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশিদা সুলতানার সঙ্গে বৃহস্পতিবার কথা হয়। তিনি বলেন, আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। সেখানে আরপিওতে কয়েকটি সংশোধনীর বিষয়ে আমরা সম্মত হয়েছি। তার একটি হচ্ছে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার আঙুলের ছাপে ১ শতাংশ ব্যালট পেপার ইস্যুর বিষয়। তাদের যুক্তি হচ্ছে, এ বিষয়টি বিধিমালায় রয়েছে। প্রয়োজন অনুসারে বিধি মোতাবেক ইসি সার্কুলার জারি করে নিলে হবে। তাদের প্রস্তাব আমাদের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে। তিনি বলেন, আরপিওর চূড়ান্ত সংশোধনী আমরা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। আশা করছি, আইন মন্ত্রণালয় দ্রুত এ আইন পাশের পদক্ষেপ নেবে। ইসির কর্মকর্তারা জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচন (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) বিধিমালা, ২০১৮ এর ধারা ১২ এএ বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। সেখানে ‘নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত হারে’ ভোটারকে নিজ আঙুলের ছাপে ভোট দেওয়ার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা আছে। এ বিধানের ফলে নির্বাচন কমিশন নিজেদের ইচ্ছামতো ভোটারকে এ প্রক্রিয়ায় ভোট দেওয়ার সুযোগ দিতে পারবে। যদিও এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক বিতর্ক উঠেছে। ইসি ও আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন গত বছরের ৮ আগস্ট আরপিও সংশোধনী প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। পরে সম্পূরক সংশোধনী দিয়ে আরেকটি প্রস্তাব পাঠানো হয়। ওই সংশোধনী প্রস্তাবের বিষয়ে পদক্ষেপ না জানানোর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৯ সেপ্টেম্বর, ১০ অক্টোবর ও ২৭ নভেম্বর তিন দফায় আইন মন্ত্রণালয়কে তাগাদাপত্র দেয় ইসি। এমনকি এতে ইসি ক্ষোভও প্রকাশ করে। ইসির ওই চিঠির কপি গণমাধ্যমেও জানানো হয়। এরপরই লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ এক চিঠি দিয়ে ইসিকে জানায়, তারা ইসির প্রস্তাবগুলো গুরুত্বের সঙ্গে যাচাই করছেন। সূত্র আরও জানায়, পরে আরপিও সংশোধনের বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। এক পর্যায়ে নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশিদা সুলতানা ও মো. আনিছুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ওই বৈঠকে ইসির কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে ইসির প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলোর মধ্যে অনুচ্ছেদ ৬, ১৫, ২৬ই, ৭৭, ৮৪এ, ৮৪বি, ৮৪সি, ৮৪ডি, ৮৪ই, ৮৪এফ, ৮৪জি, ৮৪এইচ এবং ৯১এ ধারায় সংশোধনীর বিষয়ে আপত্তি জানায় আইন মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে কারাবন্দি ও বয়স্কদের পোস্টাল ব্যালটে ভোটের সুযোগ দেওয়ার বিষয় আছে। এছাড়া ইভিএমে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার আঙুলের ছাপ দিয়ে সর্বোচ্চ ১ শতাংশ ভোটারের ব্যালট ইস্যুর বিধান যুক্তের প্রস্তাবও রয়েছে। এর আগে, বিতর্ক এড়াতে ১ শতাংশের বিধান আরপিওতে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে ইসির প্রস্তাবের কথা জানান নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর। এর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে গত ৩ অক্টোবর নিজ কার্যালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বিষয়টি নিয়ে যাতে সংশয় তৈরি না হয়, সেজন্য এটাকে আইনের কাঠামোতে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত হয়। তিনি আরও বলেন, বৃহত্তর স্বার্থে এটা করা হচ্ছে। এটি নিয়ে যেহেতু সন্দেহ করা হয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রশ্ন তোলে, তাই বৃহত্তর স্বার্থে ইসি এটি করতে যাচ্ছে। সূত্র মতে, আরপিও সংশোধনীতে ইসি আইন মন্ত্রণালয়ের বেশ কিছু আপত্তি মেনে নিয়েছে। তবে আরপিও অনুচ্ছেদ ১৫, ৮৪এ, ৮৪বি ও ৯১-এর সংশোধনী বহাল রাখার বিষয়ে অনড়। ভাষা পরিমার্জনের মাধ্যমে এ কয়েকটি সংশোধনী প্রস্তাব অন্তর্ভুক্তি করেই চূড়ান্ত খসড়া তৈরি করেছে নির্বাচন কমিশন। নতুন খসড়ায় ১৫-১৭টি সংশোধনী প্রস্তাব রয়েছে। যদিও আগে পাঠানো প্রস্তাবেও এসব সংশোধীন ছিল। নতুন খসড়ায় কৃষি ও ক্ষুদ্রঋণ এবং বিল খেলাপিদের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার আরও সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এ প্রস্তাব পাশ হলে আগের দিন ঋণখেলাপিমুক্ত হয়ে পরের দিনই মনোনয়নপত্র দাখিলের সুযোগ পাবেন। বিদ্যমান আইনে সাত দিন আগে এসব পরিশোধের বিধান রয়েছে। এছাড়া সংশোধনীর অনুচ্ছেদ ২৫-এ ভোটকেন্দ্রে পেশিশক্তির প্রভাব বিস্তার করলে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাকে নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নির্বাচন কর্মকর্তা কোন প্রক্রিয়ায় নির্বাচন বন্ধ করবেন তাও উল্লেখ রয়েছে। অনুচ্ছেদ ৩১ ও ৩৬-এ ব্যালট পেপারের পেছনে অফিসিয়াল সিল ও প্রিসাইডিং কর্মকর্তার স্বাক্ষর না থাকলে তা গণনায় আনা যাবে না-এমন বিধান স্পষ্ট করা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৩৬(১১)-এ ভোটগণনার বিবরণী ও ব্যালট পেপারের হিসাব প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বা তার এজেন্টকে দেওয়ার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ৭৮(২) অনুচ্ছেদে ভোটগ্রহণ শুরুর আগের ৪৮ ঘণ্টা ও পরের ৪৮ ঘণ্টায় কেউ বিশৃঙ্খলামূলক আচরণ, অস্ত্র ও পেশিশক্তি প্রদর্শন এবং ভোটগ্রহণ কাজে নিয়োজিতদের ভয় দেখালে সর্বোচ্চ সাত বছর ও সর্বনিম্ন দুই বছর জেল-জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীর ৮৪এ ও ৮৪বি অনুচ্ছেদে ভোটার, পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং পেশিশক্তির বিস্তার বন্ধে সাজার কথা বলা হয়েছে। ৮৪এ অনুচ্ছেদে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে সর্বোচ্চ তিন বছর সাজার আওতায় আনা হয়েছে। যদিও আইন মন্ত্রণালয় এ অনুচ্ছেদের বিরোধিতা করেছিল। ৮৪বি অনুচ্ছেদে পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের কাজে বাধা দেওয়াসহ বিভিন্ন অপরাধে সাত বছর সাজার প্রস্তাব করা হয়েছে। ৯০(বি)(১) অনুচ্ছেদে রাজনৈতিক দলের প্রতিটি স্তরের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধি রাখার সময়সীমা ২০২০ সাল থেকে বাড়িয়ে ২০৩০ সালের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ৯১(এ) অনুচ্ছেদে অনিয়ম হলে যে কোনো পর্যায়ে পুরো নির্বাচন বন্ধ করার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারের বিষয়টি আরও স্পষ্ট করা হয়েছে।