পাওনা আদায়ে রিসিভার নিয়োগের সুপারিশ

২৮ জানুয়ারি, ২০২৩ | ৬:২৭ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

প্রতারিত প্রতিষ্ঠান যুবকের আত্মসাৎ করা গ্রাহকের আড়াই হাজার কোটি টাকা আদায়ে একজন ‘রিসিভার’ নিয়োগের সুপারিশ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি যুবকের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত জটিলতাও সমাধানের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উচ্চ আদালতে পাঠানো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ করা হয়। এর আগে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও পুলিশ বিভাগের কাছে যুব কর্মসংস্থান সোসাইটির (যুবক) কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চান উচ্চ আদালত। গ্রাহকদের করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে এই আদেশ দিয়েছিলেন আদালত। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, রিসিভার নিয়োগের বিধান আছে ‘দ্য অফিসিয়াল রিসিভারস অ্যাক্ট-১৯৩৮’-এর মাধ্যমে। এ আইনের ৮ ধারায় আদালত কর্তৃক রিসিভার নিয়োগ করা যাবে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যুবক একটি সামাজিক সংগঠন। ১৯৯১ সালে এটি নিবন্ধন নিয়েছে দ্য সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টের আওতায়। এর বিধিবিধান পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ আইনে প্রশাসক নিয়োগের বিধান নেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি উচ্চ আদালতে পুলিশ বিভাগ প্রতিবেদন দাখিল করেছে। আর এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় সরাসরি উচ্চ আদালতে জবাব না দিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দিতে বলেছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপনকান্তি ঘোষ বলেন, উচ্চ আদালত যুবকের ব্যাপারে একটি জবাব চেয়েছে। সেই জবাব দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি উচ্চ আদালত দেখবে। আইন পর্যালোচনা করে দেখে যদি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে রিসিভার নিয়োগের নির্দেশ দেয় তাহলে মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কাজ করবে। কারণ বর্তমানে যুবকের সম্পত্তি রয়েছে। এসব সম্পত্তি বিক্রি করে গ্রাহকের টাকা দিতে হলে একটি কর্তৃত্ব থাকতে হবে। এই কর্তৃত্ব যদি আদালত থেকে নির্দেশনা আসে, তাহলে নিয়োগ দিয়ে একটি উদ্যোগ নেওয়া যাবে। কিন্তু প্রশাসক নিয়োগ করার কোনো বিধান রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানির আইনে নেই। জানতে চাইলে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের সংগঠন যুবকের ক্ষতিগ্রস্ত জনকল্যাণ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হোসেন মুকুল বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের সাড়ে তিন লাখ গ্রাহকের দুঃখ-দুর্দশার বিষয়টি উপলদ্ধি করে এর সমস্যা সমাধানের নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা এর সুষ্ঠু সমাধান চাই। এর জন্য প্রয়োজন একজন রিসিভার নিয়োগ দেওয়া। আমরা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি। আদালত আমাদের যে রায় দিবেন, সেটি মেনে নেব। লাখ লাখ ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহক এখনো টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য হাত পেতে বসে আছে। এর সমাধান হলে এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ১৫ লাখ মানুষ রক্ষা পাবেন। জানা যায়, যুবকের গ্রাহকদের পাওনা ও সম্পত্তি বিক্রিসংক্রান্ত জটিলতা নিরসনের জন্য ইতঃপূর্বে ড. ফরাস উদ্দিন ও অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে সরকার দুটি কমিশন গঠন করে। দুটি কমিশন তাদের রিপোর্টে যুবকের সমস্যা নিরসনের জন্য একজন প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করেছিল। একই ধরনের সুপারিশ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটিও। কিন্তু আইনের সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া এবং না দেওয়া নিয়ে এরই মধ্যে কেটে গেছে ১৬ বছর। যে কারণে প্রতারিত যুবকের সাড়ে তিন লাখ গ্রাহক তাদের ২৫৮৮ কোটি টাকা ফেরত পায়নি। উচ্চ আদালতে পাঠানো প্রতিবেদনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, যুবকের সম্পত্তি সরকারের হেফাজতে গ্রহণ, রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও বিক্রির জন্য প্রকৃত গ্রাহকের পাওনা ও আসল টাকা পরিশোধের লক্ষ্যে প্রশাসক নিয়োগ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণের জন্য একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ওই সভায় নিবন্ধক, আরজেএসসি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি এবং আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত পর্যালোচনা করা হয়। সেখানে দেখা গেছে, দ্য সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টে প্রশাসক নিয়োগ করার বিধান নেই। বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে অবহিত করা হয়। এদিকে যুবক সম্পর্কে কার্যক্রমের ব্যাপারে উচ্চ আদালতের জবাব অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সরাসরি দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ওই চিঠিতে অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, যুব কর্মসংস্থান সোসাইটির (যুবক) ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন, অর্থমন্ত্রীর নির্দেশনা এবং আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির সুপারিশ মোতাবেক যুবক কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত। এ সংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। এক্ষেত্রে রিট পিটিশনের আদেশের আলোকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে যুবক কমিশনের বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন আদালতে দাখিলের সুযোগ নেই। জানা যায়, যুবকের সব সম্পত্তি সরকারি হেফাজতে গ্রহণ ও বিক্রি করে গ্রাহকের টাকা পরিশোধ সংক্রান্ত সরকারের সব স্তরের নির্দেশনা রহস্যজনক কারণে আলোর মুখ দেখে না। এমনকি এই সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন ছয় বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি। এছাড়া দুই বছর আগে একই বিষয়ে যুবকে প্রশাসক নিয়োগ করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বর্তমান অর্থমন্ত্রীর অনুরোধও অদ্যাবধি কার্যকর হয়নি। পাশাপাশি যুবক নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে সাড়ে সাত বছর আগে সরকারের একটি আন্তঃমন্ত্রণালয়ের কমিটির সুপারিশ ঝুলে আছে। প্রায় এক যুগ আগে সরকারের পৃথক দুটি কমিশন যুবকের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সেগুলোও আলোর মুখ দেখেনি। শুধু তাই নয়, প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নেওয়া অভিযোগের মামলায় যুবকের প্রতিষ্ঠা নির্বাহী পরিচালক হোসেন আল মাসুমসহ সাতজনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেয় সিআইডি। এরপর গত ডিসেম্বরে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদলত। কিন্তু গ্রেফতার তো দূরের কথা, রীতিমতো নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়ান তারা-এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, মাথায় গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়েই যুবকের কয়েকশ কোটি টাকার সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছেন তারা। অথচ তিন লাখ গ্রাহক আড়াই হাজার কোটি টাকা হারিয়ে পথে বসেছেন। অনেকে ইতোমধ্যে মারাও গেছেন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন-যুবকের খুঁটির জোর কোথায়? তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কি কেউ নেই? প্রসঙ্গত, ১৯৯৪ সালে সদস্যদের মধ্যে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের মধ্য দিয়ে যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি (যুবক) কার্যক্রম শুরু করে। এরপর প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকদের টাকা হাতিয়ে নেয়। যুবকের বিষয়ে অতিরিক্ত সচিব রফিকুল ইসলাম কমিশন বলেছে, ২৫৮৮ কোটি টাকা গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে যুবক। ৩ লাখ ৩ হাজার ৭০০ গ্রাহকের কাছ থেকে এ টাকা নেওয়া হয়। প্রথম কমিশন ড. ফরাস উদ্দিন বলেছিলেন, যুবকের মোট গ্রাহক ২ লাখ ৬৭ হাজার ৩০০ জন। এসব গ্রাহক যুবকের কাছে পাওনা হচ্ছেন ২ হাজার ১৪৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। তবে যুবকের সম্পদ বিক্রি করে গ্রাহকের দায়দেনা পরিশোধ সম্ভব।