ফের বাসা ভাড়ার খড়গ

২৭ জানুয়ারি, ২০২৩ | ৯:২৮ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

করোনাকালে বেসরকারি চাকরিটা হারিয়েছিলেন নজরুল ইসলাম। সে সময় রাজধানীর বাসা ছেড়ে পরিবার নিয়ে তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন গ্রামে। পরে চাকরি পেয়ে আবারও ফেরেন ঢাকায়। আগে তিন বেডরুমের ফ্ল্যাটে থাকলেও এখন মাসিক ১৫ হাজার টাকা ভাড়ায় স্বামীবাগের দুই রুমের একটি ফ্ল্যাটে উঠেছেন। অগ্রিম গুনতে হয় ৫০ হাজার টাকা। গত ডিসেম্বরেই বাড়ির মালিক আরও ২ হাজার টাকা ভাড়া বাড়িয়েছেন। নজরুল ইসলাম বলেন, 'জীবনযাত্রার খরচ অনেক বেড়ে যাওয়ায় পরিবারকে আবার গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছি।' মিরপুরের পীরেরবাগে আবু তাহের ভূঁইয়ার ৪০টি ফ্ল্যাট। করোনা মহামারিতে মানুষের রোজগার যখন কমতে থাকে, তখন ভাড়া কমিয়েও তিনি ধরে রাখতে পারছিলেন না ভাড়াটিয়া। একটা সময়ে এসে দেখেন তাঁর অর্ধেক ফ্ল্যাটই খালি! মহামারির পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ভাড়াটিয়ার আনাগোনা। এখন তাঁর কোনো ফ্ল্যাটই আর খালি নেই। তাহের ভূঁইয়া বলেন, 'করোনার সময় যে ভাড়াটা কমানো হয়েছিল, সেটা সমান করা হয়েছে। কেউ চলে গেলে নতুন ভাড়াটিয়ার কাছে ভাড়া বেশি চাইব।' বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি তেল, পানি- সাম্প্রতিক সময়ে সবকিছুরই দাম বেড়েছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সব ধরনের পণ্যের দাম। নতুন বছর আসতেই বাড়তি খরচের মিছিলে যোগ হয়েছে বাসা ভাড়া। রাজধানীর প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ থাকেন ভাড়া বাসায়। খরচের চাপে এমনিতেই নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ চিড়েচ্যাপটা। এর ওপর নতুন করে বাসা ভাড়া বেড়ে যাওয়ার খÿ সবাইকে চিন্তায় ফেলছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) 'কভিড-১৯ বাংলাদেশ :জীবিকার ওপর অভিঘাত ধারণা জরিপ' বলছে, মহামারির প্রথম চার মাসে বেকারত্ব বাড়ে ১০ গুণ। আর্থিক সংকটে পড়া ৪৬ দশমিক ২২ শতাংশ পরিবার সঞ্চয় ভেঙে এবং ৪৩ শতাংশের বেশি পরিবার আত্মীয়স্বজনের সহায়তায় সে সময় সংসার চালিয়েছে। করোনাকালে অনেক বাড়িওয়ালা স্বেচ্ছায় ঘর ভাড়া কমিয়েছিলেন, অনেকে আবার মানবিক দিক চিন্তা করে বাড়াননি ভাড়া। করোনার ধাক্কা শেষ না হতেই ২০২২ সালের মার্চে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বাড়তে থাকে একের পর এক পণ্যের দাম। এর মধ্যেই 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' হয়ে আসে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার খবর। গত আগস্টে প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে যায় ডিজেল-পেট্রোলের দাম। এর প্রভাব পড়ে সব খাতে। এর পর একে একে বাড়ে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম। এর ফলে সংসার চালাতে গিয়ে খাবি খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। জিনিসপত্রের দাম যে হারে বেড়েছে, সেভাবে বাড়েনি আয়। অনেক ক্ষেত্রে কারও কারও আয় কমেছে। ফলে যাঁরা বাড়ি ভাড়া দিয়ে সংসার চালান, তাঁদেরও খরচ বেড়েছে। এসব কারণে তাঁরাও বাড়ি ভাড়া বাড়াতে শুরু করেন। মানুষের আয় না বাড়ায় আগে যে ব্যক্তি তিন রুমের ফ্ল্যাটে থাকতেন, এখন তিনি দুই রুমের ফ্ল্যাট খুঁজছেন। ঢাকায় টিকতে না পেরে কেউ কেউ পরিবার গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন। অনেকে আবার খাবার ও বিনোদন খরচে লাগাম টানছেন। কম দামি পণ্যের দিকে ঝুঁকছেন। ভাড়াটিয়াদের ক্ষোভ :ঝিগাতলার মুন্সীবাড়ি রোডে ২৩/৯ হোল্ডিংয়ে থাকা কামরুল হাসান বলেন, গেল চার বছরে তাঁর বেতন না বাড়লেও বাসা ভাড়া বেড়েছে কয়েকবার। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি আর স্যুয়ারেজ বিলের সঙ্গে প্রতিবছর বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। এই জানুয়ারি থেকে ২ হাজার টাকা ভাড়া বাড়িয়েছেন বাড়ির মালিক। একই অভিযোগ ওয়ারীর ১৬৯/১ লালমোহন শাহ স্ট্রিটের ভাড়াটিয়া সরকারি চাকরিজীবী সোহেল চৌধুরীর। তিনি জানান, চারতলার তিনটি বেড রুম ডাইনিংসহ ফ্ল্যাটটির শুরুতে ভাড়া ছিল ১৮ হাজার টাকা। ২০১৯ সালের পরে তিন বছরে ভাড়া বেড়ে এখন ২৩ হাজারে ঠেকেছে। বসুন্ধরা শপিং মলের পেছনের ১৬/ডি গার্ডেন রোডের শিরিন ভিলার ভাড়াটিয়া সিএনজি স্টেশনের কর্মী সাদাকাত বলেন, বাসা ভাড়াসহ সবকিছুরই দাম বাড়ায় এখন ওভারটাইম করছি প্রতিদিন। তাও কুলিয়ে উঠতে পারছি না। নিয়ন্ত্রণের কেউ নেই :বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়ালেও নিয়ন্ত্রণের কেউ নেই। ভাড়া নির্ধারিত হয় বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার আলোচনার ওপর। নগরবাসীর নাগরিক সুবিধাদানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সিটি করপোরেশনেরও এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেই। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মুখপাত্র আবু নাছের বলেন, বাড়ি ভাড়া নিয়ে সিটি করপোরেশন কোনো কাজ করে না। ভাড়াটিয়াদের স্বার্থ রক্ষায় তিনটি সংগঠনের নাম পাওয়া গেলেও এগুলোর কোনোটিরই কার্যকারিতা নেই। এ তিন সংগঠনের কোনো অস্তিত্বও মেলেনি। তবে ভোক্তা স্বার্থ রক্ষাকারী সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, 'আমরা যাঁরা ভাড়া বাসায় থাকি, তাঁদের দৃষ্টিকোণ থেকে এই মুহূর্তে ভাড়া বাড়ানো কাঙ্ক্ষিত না। এখন চাহিদা বাড়লে বাড়িওয়ালারা তো সুযোগ নেবেই। আমার ভবনের কিছু ফ্ল্যাট করোনার সময় খালি ছিল, এখন নেই। বাড়িওয়ালাদের মধ্যে ভালোও আছে, মন্দও আছে। ভাড়া বাড়ার বিষয় নির্ভর করছে চাহিদার ওপর। ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করা কারও পক্ষেই সম্ভব না। আমরা বললেও কেউ কথা শুনবে না। আবার দুয়েকজন বাড়িওয়ালাও আমাকে বলছে, আমাদেরও তো চলতে হয়। গ্যাসের দাম বাড়ছে, বিদ্যুতের দাম বাড়ছে তাহলে আমরা কী করব? আমরা আশা করি, বাড়ি ভাড়া যেন অযৌক্তিক না হয়, একটি সহনীয় পর্যায়ে থাকে।' আইন ভাড়াটিয়াবান্ধব নয় :বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের (১৯৯১) বেশিরভাগ বিধানই ভাড়াটিয়াবান্ধব নয়। আবার ভাড়াটিয়ার অনুকূলে থাকা ধারাগুলোও বাড়ির মালিকরা মানতে চান না। আইনের ১০ ধারায় বলা হয়েছে, ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে কোনো বাড়ির মালিক এক মাসের ভাড়া অগ্রিম ছাড়া আর কোনো জামানত, প্রিমিয়াম বা সেলামি নিতে পারবেন না। তবে অনেক বাড়ির মালিক দুই মাসের অগ্রিম ছাড়া বাড়ি ভাড়া দেন না। এমনকি ছয় মাসের ভাড়া অগ্রিম নেওয়ারও নজির রয়েছে। ২৩ ধারায় বলা আছে, এক মাসের বেশি ভাড়া অগ্রিম বা জামানত নিলে এক মাসের ভাড়ার তিন গুণ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন বাড়িওয়ালা। তবে অনেকে বেশি ভাড়া অগ্রিম নিলেও কোনো বাড়িওয়ালার এই দায়ে দণ্ডিত হওয়ার নজির নেই। নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন একটা থাকলেও সেটা যুগোপযোগী নয়। মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণের কথা আইনে বলা হলেও সেই মানসম্মত কীভাবে বা কারা নির্ধারণ করে দেবে, তারও উল্লেখ নেই। আইনটি ভাড়াটিয়াবান্ধবও বলা যায় না। ১৫ (১) ধারায় বলা আছে, বার্ষিক ভাড়ার পরিমাণ বাড়ির বাজারমূল্যের ১৫ শতাংশের বেশি হবে না। এ ক্ষেত্রে ভাড়াটিয়ার জন্য সার্বক্ষণিক পানি, বিদ্যুৎ, লিফট সুবিধা, মানসম্মত স্যুয়ারেজ সুবিধা, ছাদ, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাসহ ভবনের প্রয়োজনীয় নাগরিক সুবিধা বাড়িওয়ালাকে নিশ্চিত করতে হবে। তবে প্রায় বাড়িওয়ালাই ভাড়াটিয়াদের জন্য এসব সুবিধা নিশ্চিত করতে পারেন না। কখনও কখনও এসব সুবিধা নিশ্চিত না করেও ১৫ শতাংশের বেশি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। ১৬ ধারায় বলা হয়েছে, বাড়ির অবস্থা বুঝে একটি মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণ করতে হবে। ভাড়া দেওয়ার দুই বছরের মধ্যে বাড়িওয়ালা কোনো ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব দিতে পারবেন না। অনেক ক্ষেত্রে এই শর্তও বাড়িওয়ালারা মানেন না। বেশি ভাড়ার প্রস্তাব পেলে ভাড়াটিয়াকে ভাড়া বাড়াতে বলেন। অন্যথায় বাসা ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেন। বাড়িওয়ালাদেরও আছে ক্ষোভ :অবশ্য ভাড়াটিয়াদের বিরুদ্ধে বাড়িওয়ালাদের অভিযোগও কম নয়। তাঁদের ভাষ্য, আইনে প্রতি মাসের ৫ তারিখের মধ্যে ভাড়া পরিশোধের নিয়ম রয়েছে। কোনো কারণে ব্যর্থ হলে তা সর্বোচ্চ ১৫ তারিখের মধ্যে পরিশোধের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে অনেক ভাড়াটিয়া এই শর্ত মানেন না। এমনকি একাধিক মাসের বকেয়াও ফেলেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মিরপুর এলাকার এক বাড়িওয়ালা বলেন, এক ভাড়াটিয়া দেব দিচ্ছি করে আট মাসের ভাড়া বকেয়া ফেলে এক সময় পালিয়ে যায়। তার ঘরে পাওয়া যায় একটি ভাঙা খাট, চেয়ার-টেবিল ও পুরোনো একটি ফ্রিজ। সেগুলো বিক্রি করলে বড়জোড় ৩০ হাজার টাকা হবে। তবে তার ভাড়া বকেয়া ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। কাফরুলের এক বাড়িওয়ালা অভিযোগ করেন, ভালো মনে করে এক বিধবা নারীকে ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়েছিলেন। পরে ওই নারী বাসায় ইয়াবা কারবার ও অসামাজিক কাজ শুরু করেন। আশপাশের বাসিন্দারা অভিযোগ দিলে উল্টো ওই নারী তাঁকেই উল্টো হুমকি দিয়ে ভাড়া দেওয়া বন্ধ করে দেন। এ নিয়ে থানা-পুলিশ করেও কোনো কাজ হয়নি। এক দিন না জানিয়েই পিকআপে মালপত্র তুলে পালিয়ে যায়। বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের চাহিদা কম : বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে প্রায় উল্টো পরিস্থিতি। ভাড়া কিছুটা কমিয়েও ভাড়াটিয়া মিলছে না। সেগুনবাগিচার আইরিস নূর জাহান অ্যাপার্টমেন্টের ফ্ল্যাট নং বি-১২ খালি আছে দুই মাস ধরে। ফ্ল্যাটের মালিক অ্যাডভোকেট নূর জাহান জানান, অনেকেই আসে। বাসা দেখে চলে যায়। ভাড়া বাড়ানো না হলেও ভাড়াটিয়া মিলছে না। কাকরাইলের কর্ণফুলী টাওয়ারের পাশের ভবনের কেয়ারটেকার জানান, সি-৭ ফ্ল্যাটের ভাড়া অনেক আগে থেকেই ৪০ হাজার টাকা। ওই ভাড়ায়ও কোনো ভাড়াটিয়া মিলছে না।