পানি ছিটিয়ে আর সভায় গলা ফাটিয়ে কর্ম শেষ

২৭ জানুয়ারি, ২০২৩ | ৯:২৬ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

ঢাকার বাতাস দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে আরও বিপজ্জনক। মানুষের নিঃশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে ঢোকা এ বাতাস মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়। রাজধানীর গাবতলী, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ, বনানী, গুলশান, শাহবাগ, তেজগাঁওসহ সবখানেই উড়ছে ধুলা। সকাল-বিকেল কিংবা রাত- কোনো সময়ই এই দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি নেই। ধুলা আর ধোঁয়াকে সঙ্গী করেই ছুটছেন নগরবাসী। অথচ দূষণ নির্মূলের দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলো কর্ম সারছে পানি ছিটিয়ে আর সভা-সেমিনারে গলা ফাটিয়ে। হাইকোর্ট বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে যে ৯ নির্দেশনা দিয়েছিলেন এর মধ্যে শুধু পানি ছিটানো কাজই মাঝে মাঝে চোখে পড়ে। উল্টো সরকারি সংস্থাই বাড়াচ্ছে দূষণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি সংস্থাগুলোর অবহেলা, গাফিলতি ও বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ সরকারের অগ্রাধিকারে না থাকায় দূষণ বাড়ছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারকে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করার ব্যাপারে জোর দেন তাঁরা। বাড়ছে দূষণ, সঙ্গে ক্ষতিও : গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ঢাকার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) স্কোর ছিল ৩৭২। গত বুধবার একই সময়ে ওই স্কোর ছিল ৩১৯। যা বিপজ্জনক ও দুর্যোগপূর্ণ। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার সারাবিশ্বের বায়ুর মান লাইভ আপডেট দেয়। ওই সংস্থার ওয়েবসাইটে বিশ্বের ১০০ দেশের মধ্য ঢাকার নাম ১০ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই দিনের কোনো না কোনো সময় শীর্ষে উঠে এসেছে। গত মে মাসে বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত 'গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ' শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু পরিবেশ দূষণের কারণে ২০১৯ সালে বিশ্বজুড়ে ৯০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে মারা গেছে ২ লাখের বেশি। দূষণে মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। সরকারি সংস্থাই বাড়াচ্ছে দূষণ : রাজধানীর ফার্মগেট ও তেজগাঁও রেলগেট এলাকায় কয়েক বছর ধরে চলছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ। কখনও মাটি খোঁড়া হচ্ছে, আবার কখনও নালা কাটা হচ্ছে। খোলা জায়গায় ফেলে রাখা হয় বালু-সুরকি। রাস্তায় ধুলাবালুর স্তর। তা যানবাহন গেলেই বাতাসে উড়ছে। আগারগাঁও থেকে দিয়াবাড়ী পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হয়েছে। বাকি অংশের নিচে গাছ লাগানোর কাজ চলছে। রাজধানীর ফার্মগেটে খামারবাড়ির সামনে দেখা গেছে, মেট্রোরেলের নিচের অংশ রেলিং তৈরি করে সেখানে মাটি দিয়ে চলছে গাছ লাগানোর আয়োজন। সেই মাটি রাস্তায়ও ছড়িয়ে পড়ছে। সে মাটির ধুলা যেন উড়ছে ঝড়ের মতো। সরকারি অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানকেই নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখতে দেখা যায়নি। অথচ ২০২০ সালের জানুয়ারিতে হাইকোর্ট বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে যে ৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন, এর মধ্যে নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, পানি ছিটানো এবং খোঁড়াখুঁড়ির ক্ষেত্রে দরপত্রের শর্ত মানার বিষয়গুলো ছিল। ঢাকায় চলছে কালো ধোঁয়া ছড়ানো পুরোনো যানবাহন। ইটভাটার পুরোনো সমস্যা তো রয়েছেই। এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে নিম্নমানের ডিজেলের ব্যবহার। এর মধ্যে আবার গত ১২ জানুয়ারি শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে ডিজেলের মানমাত্রায় ছাড় দেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও বায়ুমানবিষয়ক গবেষক আবদুস সালাম বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর দূষণ কমাতে ভালোমানের ডিজেল ব্যবহার নিশ্চিতের জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। এ অবস্থায় নিম্নমানের ডিজেল আমদানির জন্য মানমাত্রায় ছাড় দেওয়া উদ্বেগজনক। এতে বায়ুদূষণ আরও বাড়াবে। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, একসময় কালো ধোঁয়া বন্ধে নিয়মিত অভিযান চলত। ২০২০ সালের মার্চে করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে অভিযান হয় না বললেই চলে। যানবাহনের কালো ধোঁয়ার দূষণের মাত্রা পরিমাপ করার মতো কোনো যন্ত্র বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছে নেই। ঢাকা মহানগর পুলিশেরও নেই এমন কোনো যন্ত্র। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পরিবেশ সার্কেল থাকলেও কালো ধোঁয়া বন্ধে তাদের কোনো পদক্ষেপ নেই। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুম লীয় অধ্যয়ন কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, বায়ুদূষণ রোধে সরকারি সংস্থাগুলো ঠিকমতো কাজ করলে দূষণ অর্ধেকের বেশি কমানো যেত। হাইকোর্টের ৯ নির্দেশনার বাস্তবায়ন নেই :২০২০ সালের জানুয়ারিতে এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত থেকে ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তর এবং ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে ৯ নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে- ঢাকা শহরে মাটি, বালু বা বর্জ্য পরিবহন করা ট্রাক ও অন্যান্য গাড়িতে মালামাল ঢেকে রাখা; নির্মাণকাজ চলা এলাকায় মাটি, বালু, সিমেন্ট, পাথর ঢেকে রাখা; সিটি করপোরেশন এলাকার রাস্তায় নিয়মিত পানি ছিটানো; রাস্তা, কালভার্ট, কার্পেটিং, খোঁড়াখুঁড়ির কাজে দরপত্রের শর্ত পালন নিশ্চিত করা; সড়ক পরিবহন আইন অনুসারে গাড়ির চলাচল সময়সীমা নির্ধারণ ও সময়সীমার পরে গাড়ি চলাচল বন্ধ করা; পরিবেশগত সনদ ছাড়া চলমান টায়ার ফ্যাক্টরি বন্ধ করা; বিপণিবিতান অথবা দোকানের প্রতিদিনের বর্জ্য ব্যাগে ভরে রাখা ও বর্জ্য অপসারণ নিশ্চিত করতে সিটি করপোরেশনের পদক্ষেপ নেওয়া। এ নির্দেশনাগুলো দেওয়ার পর ২০২০ সালের নভেম্বরে আদালত তা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেন। দুই বছর পেরিয়ে গেলেও মাঝে মাঝে সড়কে পানি ছিটানো ও সভা-সেমিনার ছাড়া আর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। গত দুই বছরে দূষণ দূর করতে আদালত ২০ বারের বেশি রুল জারি ও তলবসহ নানা নির্দেশনা দেন। সর্বশেষ গত ১৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) অস্বাস্থ্যকর, অতি অস্বাস্থ্যকর ও বিপজ্জনক বায়ু থেকে জনসাধারণকে রক্ষায় অ্যালার্ট সিস্টেম চালু না করার বিষয়ে আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন না করার অভিযোগ এনে সরকারকে নোটিশ দেওয়া হয়। প্রকল্পের টাকা উড়লেও বন্ধ হচ্ছে না বায়ুদূষণ :পরিবেশ অধিদপ্তর গত ১২ বছরে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু বড় প্রকল্প হাতে নেয়। এত প্রকল্পেও বায়ুরমান ভালো হয়নি। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তর বায়ুমান ব্যবস্থাপনা প্রকল্প (একিউএমপি) নামে আরেকটি প্রকল্প করেছিল। এর পর দুই বছর বিরতি দিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঋণের অর্থে 'নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ' নামে প্রকল্পের (কেইস) মাধ্যমে ২২১ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। তবে অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ ১২৩ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে প্রশিক্ষণের নামে- কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর, পরামর্শক ফি, গাড়ি কেনা ও ভবন নির্মাণে। ২০০৯ সালে শুরু হয়ে প্রকল্পটি শেষ হয় ২০১৯ সালের জুনে। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় প্রায় ৩০ কোটি টাকায় ২০টি সড়ক ঝাড়ূ দেওয়ার যন্ত্র (রোড সুইপার) কিনে ২০২১ সালের শুরুর দিকে সিটি করপোরেশনগুলোকে দেয়। সেই যন্ত্র অকার্যকর প্রমাণিত হওয়ায় এখন বসিয়ে রাখা হয়েছে। বায়ুদূষণ রোধে 'বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল সাসটেইনেবল ট্রান্সফরমেশন (বেস্ট)' শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গত ডিসেম্বরে পরিবেশ অধিদপ্তরকে ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মো. আবদুস সালাম বলেন, 'পরিবেশ অধিদপ্তর বায়ু, পানিসহ পরিবেশগত নানা দূষণ নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। তবে তাদের তেমন কার্যকর পদক্ষেপ আমরা দেখি না।' বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'টানা দূষণে ঢাকা শীর্ষে থাকলেও কোনো ধরনের স্বাস্থ্য সতর্কতা ছাড়াই নগরবাসী স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য সতর্কতা না থাকায় দেশে প্রতিবছর বায়ুদূষণজনিত রোগে প্রায় দেড় লাখ মানুষ মারা যায়।' এ প্রসঙ্গে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, 'প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে দূষণ কমানোর কার্যকর উদ্যোগগ্রহণের বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। তবে সব সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ের অভাবে ঠিকভাবে কাজ হয়নি। বায়ুদূষণ নির্মূল শুধু পরিবেশ অধিদপ্তরের কাজ নয়, সবার দায় আছে। আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে আমরা কাজ করছি। এরই মধ্যে অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, নতুন করে কোনো ইটভাটার লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে না। নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে।