পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ের একাংশ ভাঙা হচ্ছে

২৬ জানুয়ারি, ২০২৩ | ৮:৪০ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

মেট্রোরেল বা এমআরটি-১ প্রকল্পের কাজের জন্য ভাঙা হচ্ছে কুড়িল-কাঞ্চন ব্রিজ এক্সপ্রেসওয়ের (পূর্বাচল) একাংশ। রাজউক ও মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের চরম সমন্বয়হীনতার কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। নতুন এই সড়ক ভাঙা ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সরকারকে মোটা অঙ্কের টাকা মাশুল দিতে হবে। আগেও সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এসব ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নিলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে-এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। জানা গেছে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউক ১০ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা ব্যয়ে কুড়িল-কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে সড়ক নির্মাণ করেছে। ২০১৫ সালে শুরু হওয়া কাজ নির্ধারিত সময় ২০২২ সালের ডিসেম্বরে সিংহভাগ শেষ হয়েছে। চলতি বছরের যে কোনো সময় প্রকল্পটির উদ্বোধন করা হবে। এ অবস্থায় শুরু হচ্ছে দেশের প্রথম পাতাল মেট্রোরেল বা এমআরটি-১ এর কাজ। ২ ফেব্রুয়ারি এমআরটি-১ এর উদ্বোধনের পর শুরু হবে সড়ক ভাঙার কাজ। রাজউক সূত্রে জানা যায়, এমআরটি-১ প্রকল্পের একটি লাইন কুড়িল প্রগতি সরণির নর্দা থেকে রূপগঞ্জের পিতলগঞ্জ পর্যন্ত যাবে। ফলে বিপুল অর্থ খরচ করে নির্মিত নতুন সড়কটি কাটতে হবে। ওই সড়কের উড়ালপথের পিলার স্থাপন ও স্টেশন নির্মাণ কাজ শুরু হলে উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা সড়কের একাংশ মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রাজউকের কুড়িল থেকে বালু নদ পর্যন্ত ৬ দশমিক ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ আট লেনবিশিষ্ট এক্সপ্রেসওয়ে সড়ক। আর ছয় লেন বিশিষ্ট সার্ভিস রোডসহ ১৪ লেনবিশিষ্ট সড়কের কাজ প্রায় শেষ। এছাড়া বালু নদ থেকে কাঞ্চন পর্যন্ত ৬ দশমিক ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ছয় লেনবিশিষ্ট এক্সপ্রেসওয়ে সড়ক ও ছয় লেনের সার্ভিস রোডসহ ১২ লেনের সড়ক নির্মাণ কাজ শেষ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজউক প্রকল্পের শুরু থেকে কুড়িল-পূর্বাচল রুটের মেট্রোরেল উড়ালপথে না করে পাতালপথে করার প্রস্তাব দেয়। কারণ এমআরটি-১ প্রকল্পের বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত বড় অংশে পাতাল পথে নির্মিত হচ্ছে। কিন্তু, ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি (ডিএমটিসিএল) কর্তৃপক্ষ, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নের কথা বলে উড়ালপথ ঠিক রাখে। রাজউক বলছে, প্রথম পর্যায়ে কুড়িল-পূর্বাচলের বিষয়েও পাতাল রেল করার পরিকল্পনা ছিল। পরে সেখান থেকে সরে আসা হয়েছে। সেজন্য উড়ালপথে এমআরটি-১ এর কুড়িল-পূর্বাচল অংশের কাজ করা হচ্ছে। আর রাজউক থেকে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে সড়কের কাজ শেষ হওয়ার আগে দ্রুততম সময়ে প্রকল্পের পিলার নির্মাণের তাগাদা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু মেট্রোরেল রাজউকের চাহিদা অনুযায়ী কাজ করতে পারেনি। পিলারগুলো আগে করে ফেললে নতুন সড়কের কোনো ক্ষতি হতো না। এমআরটি-১ প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্তরা কুড়িল-পূর্বাচল ৩০০ ফুট এক্সপ্রেসওয়ে সড়কের দুই পাশের মাঝ বরাবর একটা করে লেন মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য ছেড়ে দিতে বলা হয়েছে। মাঝখানে চার মিটার বা ১২ ফুট জায়গা রেখে দেওয়া হয়েছে। মেট্রোরেলের কাজের জন্য দুই পাশে দুই লেন দরকার। এরপরও কিন্তু কাজ করতে সমস্যা হবে বলে মনে করছে। পাশাপাশি এমআরটি-১ প্রকল্পের স্টেশন প্লাজা করতে পূর্বাচল প্রকল্পের অনেক প্লট নষ্ট করতে হবে বলে মনে করছে রাজউক। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, কুড়িল-কাঞ্চন ব্রিজ এক্সপ্রেসওয়ে সড়ক নির্মাণে বিপুল অর্থ খরচ করেছে রাজউক। ওই সড়কেই এমআরটি-১ এর কাজ হবে। এক্ষেত্রে দুটি প্রকল্পের সমন্বয় কাজ করা দরকার ছিল। এক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশন, ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) এবং সরকারের সংশ্লিষ্টদের বড় ভূমিকা রাখা দরকার ছিল। সঠিক সময়ে সেটা করতে না পারায় বিপুল অর্থের গচ্চা যাবে। তিনি বলেন, মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ যদি বলে চার মিটার মিডিয়ান বা সড়ক বিভাজক দিয়েই প্রকল্পের কাজ চালিয়ে নিতে পারবে-সেটা ভুল। এ ধরনের কাজ এত কম জায়গা দিয়ে কোনোভাবেই করা সম্ভব নয়। কাজের সময় নতুন এক্সপ্রেসওয়ে সড়কের অনেকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। খনন বাদেই ভারী যন্ত্রপাতি সড়কে রাখা এবং আনা-নেওয়া করতেই সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে। এটা রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়। এসব বন্ধে অবশ্যই সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, এ ধরনের সমন্বয়হীনতার ক্ষতির ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগেও বহু ঘটনা ঘটেছে। সেসব জায়গা থেকে সরকার শিক্ষা গ্রহণ করেনি। এজন্য যারা এ ধরনের কাজ করেন, সেখানে তাদের ব্যক্তিস্বার্থ থাকে। অন্ধের মতো উন্নয়ন হচ্ছে, এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে টেকসই ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠছে না। এ বিষয়ে রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী উজ্জ্বল মল্লিক বলেন, এমআরটি-১ দেশের প্রথম পাতাল রেল। এর একটি লাইন হযরত শাহজালাল (রহ.) বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত পাতাল রেল তৈরি করা হবে। শুরুতে কুড়িল থেকে পূর্বাচল অংশও পাতালপথে করার প্রস্তাবনা ছিল। কিন্তু, মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ মনে করেছে, এই রুটে বেশি যাত্রী পাবে না, এজন্য উড়ালপথে তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুরু থেকে রাজউক থেকে কুড়িল-পূর্বাচল অংশের মেট্রোরেলও পাতালপথে করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ সেটা শোনেনি। পাশাপাশি সড়ক নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগে তাদের প্রকল্পের পিলার তৈরির অনুরোধ জানানো হলেও তারা সেটাও শোনেনি। তিনি বলেন, এমআরটি-১ প্রকল্পের উড়ালপথের কাজের জন্য চার মিটার বা ১২ ফুট জায়গা রাখা হয়েছে। ওই জায়গা দিয়ে এতবড় প্রকল্পের কাজ করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। কাজ শুরু হলে কুড়িল-কাঞ্চন ব্রিজ এক্সপ্রেসওয়ে সড়কের একাংশ কেটে এবং ক্ষতিগ্রস্ত করে উন্নয়ন কাজ করা হবে। জানতে চাইলে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক বলেন, এমআরটি-১ প্রকল্পের দুটো লাইন তৈরি করা হবে। একটি লেন হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত। এটি পাতালপথে তৈরি করা হবে। অপর লেনটি নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত। এ অংশের কুড়িল থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত উড়ালপথে নির্মিত হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কুড়িল-কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত ৩০০ ফুট এক্সপ্রেসওয়ে সড়কে এমআরটি-১ এর নির্মাণ কাজের জন্য চার মিটার বা ১২ ফুট জায়গা রেখে দেওয়া হয়েছে। ওই জায়গা দিয়েই এমআরটি-১ প্রকল্পের কাজ করা হবে। এজন্য কোনো সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। আগামীকাল (আজ) প্রধানমন্ত্রীর এই প্রকল্পের উদ্বোধন করার কথা ছিল। সেটা পরিবর্তন হয়ে ২ ফেব্রুয়ারি করা হয়েছে। এমআরটি লাইন-১ প্রকল্পের দুটো লাইন থাকবে। একটি লাইন হযরত শাহজালাল (রহ.) বিমানবন্দর থেকে মাটির নিচ দিয়ে যাবে কমলাপুর পর্যন্ত। এই পাতালপথে রেলের স্টেশন থাকবে ১২টি। স্টেশনগুলোর নির্ধারিত জায়গার মধ্যে রয়েছে-কমলাপুর, রাজারবাগ, মালিবাগ, রামপুরা, আফতাবনগর, বাড্ডা, উত্তর বাড্ডা, নতুন বাজার, নর্দা, খিলক্ষেত, বিমানবন্দর টার্মিনাল-৩ এবং বিমানবন্দর। আর এমআরটি লাইন-১ এর অপর অংশটি নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত যাবে মাটির উপর দিয়ে উড়ালপথে। এ পথে স্টেশন থাকবে ৭টি। সেগুলোর নির্ধারিত জায়গা হলো-জোয়ার সাহারা, বোয়ালিয়া, মস্তুল, শেখ হাসিনা ক্রিকেট স্টেডিয়াম, পূর্বাচল সেন্ট্রাল, পূর্বাচল পূর্ব এবং পূর্বাচল টার্মিনাল। এমআরটি লাইন-১ প্রকল্পের মোট দৈর্ঘ্য হবে ৩১ দশমিক ২৪১ কিলোমিটার। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট খরচ হবে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এরমধ্যে ৪০ হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। বাকি ১২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা খরচ করবে বাংলাদেশ সরকার। ২০২৬ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।