সাড়ে ৪ হাজার মামলার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

২৫ জানুয়ারি, ২০২৩ | ১০:০০ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

জাতীয় ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাব গত ৩ মাস ধরে অচল। এ সময়ে ল্যাবে জমেছে প্রায় দেড় হাজার মামলার আলামত। এছাড়া ২০০৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত আরও ৩ হাজার মামলার আলামত পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পড়ে আছে । রিপোর্ট না পাওয়ায় সব মিলিয়ে সাড়ে ৪ হাজার মামলার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। ধর্ষণ, হত্যা, পিতৃত্ব নির্ণয় ও অজ্ঞাত লাশের পরিচয় নির্ধারণসহ স্পর্শকাতর বিভিন্ন মামলায় ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড) টেস্ট করা হয়। ধর্ষণের অভিযোগে মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং অপরাধের শিকার ব্যক্তির ডিএনএ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করেছেন আদালত। এ অবস্থায় সারা দেশ থেকে পরীক্ষার জন্য নমুনা আসছে। কিন্তু সময়মতো রিপোর্ট না পাওয়ায় একদিকে তদন্ত কর্মকর্তারা মামলার চার্জশিট দিতে পারছেন না। ফলে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। আবার এ ধারায় যারা মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলায় গ্রেফতার আছেন তারাও জামিন নিতে পারছেন না। বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ড্যামেজ হয়ে যাচ্ছে আলামতগুলো। ফলে এগুলো থেকে শতভাগ সঠিক ফলাফল মিলছে না। সিআইডির এক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সারা দেশে দুটি ল্যাবের মধ্যে জাতীয় ডিএনএ ল্যাব বন্ধ থাকায় তাদের ল্যাবে চাপ বাড়ছে। তার মতে, আলামত যত দ্রুত পরীক্ষা শেষ হবে, ততই ভালো ফলাফল আসে। রিপোর্টে হেরফের হলে সুবিচার বাধাগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা থাকে। জাতীয় ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জাবেদুল আলম বলেন, রিঅ্যাজেন্ট না থাকায় ২৭ অক্টোবর থেকে ল্যাবের কার্যক্রম বন্ধ। ফলে এ পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার মামলার আলামত জমে গেছে। যথাসময়ে অধিদপ্তরকে জানালেও এখনো রিঅ্যাজেন্টের ব্যবস্থা করা হয়নি। এর আগে জেনেটিক অ্যানালাইজার মেশিনের একটি পার্টস নষ্ট থাকায় ২০২১ সালের আগস্ট থেকে ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত ল্যাবের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এভাবে মাঝেমধ্যেই অচলাবস্থা তৈরি হয়। তিনি জানান, অনিয়মিত বেতনসহ নানা অসঙ্গতির কারণে ল্যাবের অভিজ্ঞ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা চাকরি ছেড়ে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। যোগাযোগ করা হলে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মালটিসেক্টরাল প্রোগ্রাম প্রকল্পের পরিচালক নাহিদ মঞ্জুরা আফরোজ বলেন, প্রকল্প অফিস থেকে ল্যাবের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হয়। আমরা তাদের বকেয়া বেতন পরিশোধের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। আর যন্ত্রপাতি ও রিঅ্যাজেন্টের ব্যবস্থা করে ডিএনএ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। কার্যক্রম বন্ধের বিষয়টি তারা ভালো বলতে পারবেন। জাতীয় ডিএনএ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অতিরিক্ত সচিব আবেদা আকতার বলেন, আমরা চেষ্টা করছি রিঅ্যাজেন্ট সরবরাহ করতে। খুব শিগগিরই ল্যাবের কার্যক্রম শুরু হবে। ২০০৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এ ল্যাবে ৮৪৪০টি মামলার ২৬ হাজার ৯৬৮টি আলামত পাঠানো হয় ডিএনএ পরীক্ষার জন্য। এর মধ্যে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৯৫৩টি রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। বাকি ৪ হাজার ৪৮৭টি মামলার রিপোর্ট দেওয়া সম্ভব হয়নি। রিপোর্ট না দেওয়ার ব্যাপারে নানা রকম অজুহাত দেখাচ্ছেন ল্যাব সংশ্লিষ্টরা। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এ ল্যাব থেকে প্রতিবছর ৫০ শতাংশ কিংবা তারও কম মামলার ডিএনএ রিপোর্ট পুলিশ কিংবা আদালতকে সরবরাহ করা হচ্ছে। বাকি নমুনাগুলোর রিপোর্ট নানা কারণে সরবরাহ করা হয় না। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, মাসের পর মাস ধরনা দিয়েও ল্যাব থেকে রিপোর্ট পাওয়া যায় না। খুলনার পাইকগাছা থানার এসআই বন্দনা রানী পাল ২০২১ সালের ৮ মার্চ একটি ধর্ষণ মামলার ভুক্তভোগী এবং অভিযুক্তের ডিএনএ আলামত পাঠিয়েছিলেন এ ল্যাবে। অদ্যাবধি তিনি ডিএনএ রিপোর্ট হাতে পাননি। যে কারণে তিনি মামলার চার্জশিট জমা দিতে পারেননি আদালতে। বন্দনা রানীর মতো বিভিন্ন থানার পুলিশ কর্মকর্তা প্রতিদিন ডিএনএ রিপোর্টের জন্য ধরনা দিচ্ছেন ল্যাবে। কিন্তু কোনো উত্তর পাচ্ছেন না। এ ব্যাপারে আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট মঞ্জিল মোরশেদ বলেন, ডিএনএ ও ফরেনসিক এভিডেন্স খুবই টাইম সেনসেটিভ। বেশিরভাগ সময় নারী নির্যাতনের অভিযোগে মিথ্যা মামলা হয়। ধর্ষণ মামলায় দ্রুত বিচার, নারী নির্যাতন মামলায় সত্যতা নিশ্চিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ডিএনএ টেস্ট চালু করা হয়। আমি বলব, ডিএনএ রিপোর্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে ল্যাবসংশ্লিষ্টরা যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে পারছেন না। তাদের ব্যর্থতার কারণেই ল্যাবে টেস্ট বন্ধ রয়েছে। ল্যাব বন্ধ রাখা বিচারের ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করেন তিনি। ২০০৬ সালে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মালটিসেক্টরাল প্রোগ্রামের আওতায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে ডিএনএ ফরেনসিক ল্যাবরেটরির কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর ২০১০ সালের এপ্রিলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসের নিউক্লিয়ার মেডিসিন ভবনের ১১ তলায় আরেকটু বড় পরিসরে এই ল্যাবরেটরি স্থানান্তর করা হয়। প্রতিনিয়ত এ পরীক্ষার গুরুত্ব বাড়তে থাকায় পরে ডিএনএ ল্যাবরেটরি ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর গঠন করা হয়। ল্যাবরেটরির কার্যক্রম সারা দেশে সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিভাগীয় সদরের সাতটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিভাগীয় ডিএনএ স্ক্রিনিং ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়। বিভাগীয় ল্যাবরেটরিগুলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে গৃহীত মামলায় ভুক্তভোগী ও অভিযুক্তের নমুনা সংগ্রহ করে ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রফাইলিং ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার জন্য পাঠিয়ে থাকে।