ছড়ানো হচ্ছে গুজব

২৪ জানুয়ারি, ২০২৩ | ৭:০১ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

ধর্মের অপব্যাখ্যা ও বিজ্ঞানের সঙ্গে বিরোধ দেখিয়ে নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়ে গুজব ছড়াতে তৎপর একাধিক মহল। সাধারণ মানুষকে নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা চলছে। সবচেয়ে বেশি তৎপরতা দেখা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিভিন্ন ভিডিও কন্টেন্ট, এডিট করা ছবি ও লেখনীর মাধ্যমে চলছে অপপ্রচার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরীক্ষামূলক বইয়ে কিছু ভুল পাওয়ায় তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শুরু হয়। মূলত এ বিষয়টি পুঁজি করেই কিছু মহল গুজব ছড়াচ্ছে। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তারা জানান, এ বিষয়ে দেশের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। মানুষের বাক স্বাধীনতা থাকায় যে যার অভিমত তুলে ধরবে এটা খুবই স্বাভাবিক। তবে গুজব ছড়িয়ে যারা নিজেদের স্বার্থ হাসিল ও মানুষকে বিভ্রান্ত করছে তাদের বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। মুসলিমদের ইতিহাস-ঐতিহ্য বাদ, অন্য ধর্মকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া, বিতর্কিত তত্ত্ব, ইসলামবিরোধী ছবি, লেখা দিয়ে পাঠ্যপুস্তক ও কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয়েছে বলে ঢালাওভাবে প্রচার চালানো হচ্ছে। ছড়ানো হচ্ছে গুজব। অথচ বিবর্তনবাদের তত্ত্ব বা ডারউইনের তত্ত্ব একটি প্রতিষ্ঠিত মতবাদ। বিশ্বসেরা অক্সফোর্ড বিশ^বিদ্যালয় থেকে স্কুল পর্যায়েও এই থিওরি পড়ানো হয়ে থাকে। মূলত বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গঠনে বিরোধিতা করতেই এ বিষয়েও একটি মহল এসব প্রশ্ন তুলেছে। যা শুধু অযৌক্তিক নয় কল্পনাপ্রসূত বলে মনে করছেন দেশের প্রগতিশীল নাগরিক ও শিক্ষাবিদরা। বিজ্ঞান বইয়ের তথ্য ধরে গুজব ছড়ানো হচ্ছে বানর থেকে বিবর্তন হয়ে মানুষ হয়েছে। এ বিষয়ে একটি ছবিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু জাতীয় কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বলছে, বিজ্ঞান বইয়ে এই ধরনের কোনো ছবির অস্তিত্ব নেই। এডিট করে এ ধরনের ছবি প্রচারের মাধ্যমে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। একইভাবে নবম-দশম শ্রেণির কৃষিশিক্ষা বইয়ে আনারস চাষ পাঠ্যের আনারসের ছবির বদলে নারিকেলের ছবি ব্যবহার করে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। কিন্তু বইয়ের ১৩৬ নম্বর পৃষ্ঠায় আনারসের ছবিই দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সচেতন থাকতে আহ্বানও জানিয়েছে এনসিটিবি। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন এ বিষয়ে বলেন, সব সময় পাঠ্যবইগুলো বিতর্কিত হচ্ছে। এর মানে এই নয় যে ডারউইন পড়ানো যাবে না, এখানে ইসলামি ব্যাপার নেই এটা একটি বিশেষ মহলের কাজ। তারা সবসময় এগুলোর বিরোধিতা করেছে। আমরা যদি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে চাই, উন্নত বাংলাদেশ গড়তে চাই তা হলে আমাদেরকে বিজ্ঞানমনস্ক হতে হবে শিশুকাল থেকে। এখানে যারা পড়বেন ও যারা পড়াবেন তারা হচ্ছে মূল বিষয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ভারতের পশ্চিম বাংলার বইয়ের ছবির মলাট ব্যবহার করে বাংলাদেশের বই বলে দেখানো হচ্ছে। যা সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার। এই শিক্ষাবিদ বলেন, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ অনেক কিছু দেখলেও তা বিশ^াস করে না। মানুষ মূল ধারার গণমাধ্যমেই বিশ্বাস রাখে। এ বিষয়ে গণমাধ্যমের ভূমিকার প্রয়োজন আছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হলে এর থেকে জাতিকে মুক্ত রাখা সম্ভব বলেও মনে করেন তিনি। এনসিটিবি সূত্রে জানা যায়, এখন যে শিশু পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে। আগামী দশকে সে যখন চাকরির বাজারে প্রবেশ করবে তখন এখনকার মতো ৬০ ভাগ চাকরির বিলুপ্তি ঘটবে। সম্প্রতি একটি গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। এরই মধ্যে পাশের রাষ্ট্র মিয়ানমার তাদের পাঠ্যপুস্তক ও কারিকুলাম পরিবর্তন করেছে। কেনিয়ার মতো দেশও কারিকুলাম পরিবর্তন করেছে। এর আগে দেশের কারিকুলামেও কোনো চ্যালেঞ্জ ছিল না। কিন্তু এবার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের লক্ষ্য নিয়ে দেশ এগিয়ে চলেছে। নতুন কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তকে দুটি চ্যালেঞ্জ আছে। এর ফলে একটি বিষয়ে স্নাতক-স্নাতকোত্তর করলে তার কর্মসংস্থান নিশ্চিত হবে, তা বলা যাবে না। যে কোন পরিবর্তনের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মানিয়ে নিতে সুবিধা হয়, সেভাবেই তাদের তৈরি করা হবে। এনসিটিবি চেয়ারম্যান মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, এবারের পাঠ্যক্রমে কিছু ভুল পাওয়া গেছে। তা আমি নির্দ্বিধায় স্বীকার করি। এরই মধ্যে সেসব সংশোধনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে নতুন পাঠ্যক্রম তৈরির আগে আরও ১০২টি দেশের কারিকুলাম নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। যে ভুল ছিল, তা ঠিক করা হচ্ছে। তবে যারা গুজব ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। ৬ষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান অনুশীলন পাঠ বইয়ের ১১তম অধ্যায়ের ‘মানব শরীর’ শিরোনাম অংশে কিশোর- কিশোরীর বয়ঃসন্ধিকালে তাদের শরীরের নানা অঙ্গের বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানেও অনেক গণমাধ্যম তা উপযোগী নয় বলে দাবি করেছে। শরীর বিদ্যার এই পাঠ্যকে অনেকে রগরগে রসালো গল্প বলেও দাবি করছে। তবে চিকিৎসাবিদরা বলছেন, মূলত ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শরীরের মধ্যে যে পরিবর্তন আসে এই বইয়ে সেটিই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেখানে যারা অশ্লীল সুড়সুড়ি খুঁজছেন, তা নিছক হীন মানসিকতার বহির্প্রকাশ। জীবন ও জীবিকা, গান শোনা, নাচ, বাঁশি, হারমোনিয়াম, তবলা, গিটার ইত্যাদি যন্ত্র ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের পাশ্চাত্য ও ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। একই সঙ্গে শিল্প ও সংস্কৃতি বইয়ে সংগীত, গান, নৃত্য, মাটির পুতুল, সার্কাস ও মঙ্গল শোভা যাত্রার প্রতি উৎসাহ সৃষ্টি করা হচ্ছে বলেও সমালোচনা করা হচ্ছে। এ নিয়ে নানা মাধ্যমে চলছে গুজব। অনেকের দাবি, মেয়েদের ফুটবল খেলা, টিভি দেখা, অনলাইনে কার্টুন দেখার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি : অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলে প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি, খেলাধুলার প্রতি প্রবণতা সৃষ্টির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভ্রমণের জন্য দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দিরে যেতে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে এনসিটিবির সাবেক চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, শিক্ষার ব্যাপকতা বিশাল। এটাও ঠিক আমরা কোনটা গ্রহণ করব কোনটা করব না। কিন্তু কেউ অস্বীকার করতে পারবে না বাঁশি, হারমোনিয়াম ও তবলা আমাদের সংগীত শাস্ত্রের অংশ নয়। এসব বিষয়ে যারা আঙ্গুল তুলছেন, তারা রাষ্ট্রকে ধর্মান্ধ রাষ্ট্র হিসেবে তৈরি করতে উগ্রীব বলে মনে হচ্ছে। এ বিষয়ে সহমত প্রকাশ করে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ৩০ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া স্বদেশ, পতাকা, জাতীয় সংগীত আমাদের শ্রেষ্ঠতম আবেগের নাম। আমরা এসবের ওপর কোনো কলঙ্ক লেপন সহ্য করতে পারি না। সরকারের নির্দেশনার পরও অনেক মাদ্রাসায় জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না। শিশুদের শেখানো হয় জাতীয় সংগীত হিন্দু কবির সৃষ্টি। ভিন্ন ধর্মের কবির লেখা এ গান গাওয়া হারাম বলেও প্রচার করা হচ্ছে। এতে বিভ্রান্তি বাড়ছে সমাজে।