পর্ব -২

টিনএজার ও কিছু কথা

২৩ জানুয়ারি, ২০২৩ | ৯:২০ পূর্বাহ্ণ
ড. আব্দুস সাত্তার, ওয়াশিংটন ডি,সি , ইউ এস বাংলা ২৪

বর্তমান যুগে সন্তানের বয়স যতই টিনএজের দিকে এগিয়ে যায় ততই যেন আজকাল মা-বাবার সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে শুরু করে। ১৩-১৯ বছর বয়সের সময়কে টিনএজ বয়স বলা হয়ে থাকে। সাধারণত বয়ঃসন্ধির সময় হরমোন ও শারীরিক পরিবর্তনের কারণে টিনএজারদের ব্যবহারেও বেশ পরিবর্তন আসে। বয়ঃসন্ধির সময় যেসব শারীরিক পরিবর্তন ঘটে তাও বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটায়। চলমান শারীরিক পরিপূরক প্রক্রিয়া চাহিদা, আগ্রহ এবং মেজাজ পরিবর্তন করার জন্য সরাসরি শরীর ও মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে। আপনার ছেলেটি- যার ত্বক ছিল কোমল, গলার স্বর ছিল স্বাভাবিক, হঠাৎ তার গলার স্বর হয়ে গিয়েছে ভারী, মুখে দাড়ি উঠেছে ,চুল বড় রাখা, চুল কালার করা অথবা কান ছিদ্র করা ইত্যাদি সহ আরও কিছু শারীরিক পরিবর্তন এসেছে। ঠিক তেমনই শারীরিক পরিবর্তন হয়েছে আপনার মেয়ে সন্তানটিরও। যেই মেয়েটি আগে হয়তো খুব হই-হুল্লোড় করে বেড়াতো, সেই মেয়েটি তার নিজের পরিবর্তনগুলোর সাথে খাপ খাওয়াতে পারছে না। শুধু তাইনয় নতুন নতুন মুভি ও প্রিয় তারকাদের কনসাট গুলো দেখতে যেতে দেয় না। এমনকি তাদের পছন্দের জামা কাপড়,চুল কালার বা চুল বড় করলে দুনিয়ার বানী শুনিয়ে দেয়। এই সব কিছুই টিনএজারদের কাছে বিরক্তিকর মনে হয়। অধিকাংশই বাবা-মা সহজভাবে এইগুলো মেনে নিতে পারেন না, অপরদিকে ছেলে-মেয়েরাও ভয় বা সংকোচে বলতে পারেনা। ফলে সূচনা হয় পারস্পারিক দূরত্বের। একসময় দূরত্ব ও ভুল বোঝাবুঝি থেকেই অনেক ছেলে-মেয়ে পা বাড়ায় ভুল পথে। আর তাই এই সময়টায় সন্তানের পাশাপাশি মা-বাবার আচরণও সংযত হতে হবে। এই বয়সে এসে তাদেরও যে নতুন করে শিখে সন্তানের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে সেই বিষয়টি মাথায় রাখা দরকার। সন্তানের বন্ধু হয়ে ওঠার চেষ্টা করুন। বন্ধু হয়ে ওঠার চেষ্টা মানে এই নয় যে, কে কার সঙ্গে প্রেম করছে সেই খবর নেবেন। স্কুলের পড়াশোনার খবর নেওয়ার পাশাপাশি বাচ্চাকে নিয়ে উইকএন্ডে ঘুরতে যান। তবে সব সময় পেছন পেছন ঘুরবেন এই মানসিকতাও রাখবেন না। সন্তানকে যথেষ্ঠ স্পেস দিন। সব মানুষের জীবনেই একটা স্পেসের প্রয়োজন হয়। আর সেটা আপনাকেই বুঝতে হবে। সন্তানকেও যেমন আগলে রাখবেন তেমনই শ্রদ্ধাও করবেন। আর তাই সন্তানের ফোন/ কম্পিউটার পাসওয়ার্ড জানলেও টেক্সট/মেইল খুলে পড়বেন না। এই ভুল যদি সন্তান করে থাকে তাহলে তাকেও শেখানোর দায় কিন্তু আপনারই। সন্তানের সঙ্গে সম্পর্ক, যোগাযোগ সব সময় ভালো রাখুন। এমন কোনও আচরণ করবেন না যাতে সন্তান দূরে চলে যায়। সন্তানের সামনে ড্রিংক কিংবা অন্যান্য সম্পর্ক এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। মনে রাখবেন সন্তান কিন্তু আপনাকেই দেখে শিখবে। আর তাই ওর মধ্যে কোনও নেগেটিভ প্রভাব পড়তে দেবেন না। বরং সন্তানের সঙ্গে কোয়ালিটি সময় কাটান।সন্তানের সঙ্গে এমন কোনও আচরণ করবেন না, যাতে সে বাড়িতে থাকতে না চায়। প্রতি মুহূর্তে রাগ, অভিমান করতে হয়। বাড়িতে সুন্দর পরিবেশ দেওয়ার চেষ্টা করুন। অযথা চিৎকার, স্বামী স্ত্রীয়ের ঝামেলা কিংবা অফিসের সমস্যা বাড়িতে টেনে আনবেন না। যে কোনও বাচ্চারই বেড়ে ওঠা মা-বাবাকে দেখে। বাড়ির পরিবেশ থেকে। তাই সবসময় সন্তানের ভুল না ধরে বরং সন্তানের পাশে থাকার চেষ্টা করুন। সন্তানের ভালো কাজে উৎসাহ দিন। সেই সঙ্গে সন্তান কোনও ভুল করলে অবশ্যই তা ধরিয়ে দিন। কিন্তু অযথা বকবক / খারাপ ব্যবহার করবেন না। আপনার বাসায় টিনএজার থাকা মানে যেন একটা পারমাণবিক চুল্লী থাকা ,যেটা যে কোন সময় বিস্ফোরিত হতে পারে। টিনএজ আগ্নেয়গিরির লাভা সবকিছু ভস্মীভূত করে দিতে পারে। তাই সকল বাবা মা টিনএজারদের সাথে বন্ধু সুলভ আচরণ করা। তাদের চাওয়া -পাওয়ার নিয়ে তাদের সাথে খোলামেলা আলাপ করা। না থাকা সময় থেকে একটু সময় নিয়ে টিনএজদেরকে সময় দেওয়া। ট্রাস্ট বা বিশ্বাস যে কোন সম্পর্কের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি আপনার টিনেজ সন্তানকে আপনার কথা শুনাতে চান, তাহলে আপনাকেও কিন্তু তার কথা শোনার সময় ও ধৈর্য থাকতে হবে। আপনাকে তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। একটি খোলা সম্পর্ক রাখুন সন্তানের সাথে, যেখানে আপনারা একে অপরের সাথে কিছু ভাগ করতে পারেন। যখন আপনি আপনার জীবন এবং কর্ম সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো আপনার টিনেজ সন্তানের সাথে ভাগ করেন, তখন আপনার সন্তান জানবে যে আপনি তাকে গুরুত্ব দেন এবং তার জীবনের বিষয়ে আপনার কাছে খোলাখুলি হতে পারে। সন্তানের মূল অভিভাবক পরিবার। পরিবার থেকে যদি সন্তানকে সুশিক্ষা দেয়া হয়, ধর্মীয় অনুশাসন শিক্ষা দেয়া হয়, নৈতিক শিক্ষার পরিবেশ দেয়া হয়, তাহলে টিনএজদের বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা অনেক কম যাবে। আমরা জানি, প্রত্যেক মানুষ ভিন্ন, তার নিজস্ব গুনে স্বকীয়। জন্মলগ্ন থেকেই তাদের এই নিজস্বতা কিছু না কিছু প্রকাশ পায়। তাই আমার সন্তান স্বভাব-চরিত্রে আমার মতই হতে হবে বা তার ভবিষ্যৎ আমার ইচ্ছানুযায়ী তৈরি হবে এমনটা আশা না করে এর চেয়েও ভাল কিছু আশা করুন। সে তার নিজের পছন্দ, যোগ্যতা ও মেধা অনুযায়ী যদি তার ক্যারিয়ার গড়ে তবে তা হবে অসাধারণ। তাদের অবশ্যই নিজের ফ্রিডম অব চয়েস আছে। এটা ওদের ব্যক্তিত্ব গঠনেও সহায়ক। আমার ছেলের ক্ষেত্রে তাঁর নিজের জিনিসগুলো ওকেই চয়েস করতে দেই, তবে ভালমন্দের একটা ধারণা আগেই দিয়ে দেই যেন ফাইনাল সিলেকশনে ভুল না হয়। এ অভ্যাস তাঁর পরবর্তীতে নিজের শিক্ষা, ক্যারিয়ার, চাকুরী এমনকি সাহায্য করবে জীবনসাথী বেছে নিতে।