দুর্নীতিতে ডুবছে পিআইএল

২৩ জানুয়ারি, ২০২৩ | ৯:১২ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

দুর্নীতিতে ডুবছে রাষ্ট্রায়ত্ত একমাত্র গাড়ি সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠান প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (পিআইএল)। বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের (বিএসইসি) অধীনে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন কাজে অনিয়ম করাটা যেন ‘স্থায়ী সংস্কৃতি’তে পরিণত হয়েছে। নিয়োগে অস্বচ্ছতা, টেন্ডার ছাড়া মালামাল কেনা, অনুমোদনহীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া, প্রকল্পের কাজ না করেই অর্থব্যয়, সরকারি তেল ব্যবহারে অনিয়মসহ নানা অভিযোগ এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এসব অনিয়মের নেপথ্য নায়ক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তৌহিদুজ্জমান-এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যয়ে এসব অনিয়ম বিভিন্ন সময়ে লিখিতভাবে জানানো হলেও অদ্যাবধি নেওয়া হয়নি কোনো দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা। উলটো একরকম নির্বিঘ্নে চলছে সব অনিয়ম। নির্বিকার কর্তৃপক্ষ। নিজস্ব অনুসন্ধান, পিআইএল ও বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেশ কয়েকটি খাতে এমডির ব্যয় নিয়ে আপত্তি তুলেছে সরকারের বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর। এরমধ্যে আছে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর) লঙ্ঘন করে টেন্ডার ছাড়াই ২২ কোটি ৭০ লাখ টাকার বেশি ব্যয়ে ডাবল কেবিন পিকআপ গাড়ি কেনা। আরও জানা গেছে, রাজধানীর তেজগাঁও প্রগতি টাওয়ার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১১ সালে। প্রকল্পটি অনুমোদন হয় ২০১৬ সালে। কাজ শুরু না করেই ২০২১ সালে প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করে বিএসইসি। কারণ, কাজ শুরুর আগেই সেখানে হরিলুটের চিত্র উঠে আসে। এমডি তৌহিদুজ্জামান নানা খাত দেখিয়ে ব্যয় করেন প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। তিনি নিজেই প্রকল্প পরিচালক হিসাবে কব্জায় নেন দুটি গাড়ি। যার নাম্বার ঢাকা মেট্রো গ-১১-৩৫৮৩ ও ঢাকা মেট্রো-গ-১৫-৭৮৪৯। শুধু তাই নয়, প্রগতির এমডির নিয়োগ হয়েছে অনিয়মের মধ্য দিয়ে। মহাব্যবস্থাপক পদে আবেদন করে অকৃতকার্য হয়ে আবেদন ছাড়াই চাকরি নেন এক ধাপ নিচের পদে (অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক)। সেখানে লঙ্ঘন হয়েছে বয়সসীমা। আর অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে দেওয়া হয়েছে মিথ্যা তথ্য। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১১ নভেম্বর শিল্প প্রতিমন্ত্রীর কাছে করা এক অবেদনে পিআইএল কোম্পানি বোর্ডের পরিচালক জসিম উদ্দিন রাজিব উল্লেখ করেন, ২০১১ সালের ৭ মে বিএসইসি মহাব্যবস্থাপক ও উপ-মহাব্যবস্থাপকসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিএসইসি। মহাব্যস্থাপক পদে বয়স সীমা ছিল সর্বনিম্ন ৪৫ বছর। কিন্তু এই পদে অবেদন করার সময় তৌহিদুজ্জামানের বয়স ছিল ৪৪ বছর। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্ত অনুযায়ী যেসব অভিজ্ঞতার প্রয়োজন ছিল সেসবের বিষয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে তিনি চাকরির অবেদন করেন। এ পদে চাকরির পরীক্ষায় তিনি পাশ করতে পারেননি। পরে গোপালগঞ্জের লোক পরিচয়ে অবেদন ছাড়াই অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসাবে চাকরি নেন। বিএসইসি চাকরি প্রবিধানমালা অনুযায়ী এই পদে নিয়োগের জন্য বয়স সীমা অনূর্ধ্ব ৪২ বছর। কিন্তু তৌহিদুজ্জামান নিয়োগ পান ৪৪ বছর বয়সে। তিনি মহাব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি পেয়েছেন ২০১৭ সালের ২২ মার্চ। একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর মাধ্যমে বিএসএসির তৎকালীন চেয়ারম্যানকে চাপ প্রয়োগ করে তিনি ওই বছরের ৯ আগস্ট পিআইএলের এমডি পদে নিয়োপ্রাপ্ত হন। যেহেতু তার নিয়োগটি অবৈধ, তাই তার পদোন্নতিও বৈধ নয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক থাকা অবস্থায় ২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর তৌহিদুজ্জামানকে প্রগতি টাওয়ার নির্মাণে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির এমডি পদে নিয়োগ পাওয়ার পরও তিনি ৩ বছরের বেশি সময় প্রকল্প পরিচালকের পদ ধরে রাখেন। কিন্তু প্রকল্পের কোনো কাজ করেননি। একপর্যায়ে কোনো অগ্রগতি ছাড়াই প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। অথচ প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে থাকাকালে প্রকল্পের নানা কাজ দেখিয়ে তিনি প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় করেন। ওই প্রকল্পে কোনো কনসালট্যান্ট না থাকলেও কনসালট্যান্টের নামে ৭৯ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। শিল্প প্রতিমন্ত্রীর কাছে দেওয়া এক অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক পদমর্যদার এক কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, প্রগতির উৎপাদন কাজে ব্যবহারযোগ্য প্রসেস অ্যান্ড অ্যাক্সিলারি ম্যাটারিয়াল কেনার জন্য ২০১৭-১৮ অর্থবছরে টেন্ডারে অকৃতকার্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিম্নমানের মালামাল কেনা হয়েছে। ৯৬ লাখ টাকার এ টেন্ডারে তিনি (তৌহিদুজ্জান) ব্যাপক দুর্নীতি করেছেন। টেন্ডারের শর্ত অনুযায়ী জাপানের তৈরি মালামাল সরবরাহ করার কথা থাকলেও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশ করে থাইল্যান্ড, ভারত এবং মালয়েশিয়ার তৈরির মালামাল গ্রহণ করেছেন। সরবরাহকারীকে বিধিবহির্ভূতভাবে কয়েক দফায় সরবরাহের মেয়াদ বাড়িয়েছেন তিনি। মালামালের অভাবে কারখানায় কয়েক মাস উৎপাদন বন্ধ থাকলেও সরবরাহকারীকে যথারীতি বিল পরিশোধ করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে ওই কর্মকর্তা আরও উল্লেখ করেন, তৌহিদুজ্জামান চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এবং গোপালগঞ্জে যাতায়াত করেছেন। সরকারি নিয়মে তিনি প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ২০০ লিটার জ্বালানি তেল ব্যবহারের প্রাধিকারভুক্ত। কিন্তু তিনি ব্যবহার করেছেন ৪৫০ লিটার তেল। যেসব তারিখে প্রগতির গাড়িতে ভ্রমণ করেছেন ওইসব তারিখেও ভ্রমণ বিলে তিনি বিমান ভাড়া গ্রহণ করেছেন। সেসব বিষয়ে অডিট আপত্তি রয়েছে সে সবের মধ্যে প্রসেস অ্যান্ড অক্সিলিয়ারি ম্যাটারিয়াল কেনা এবং জ্বালানি তেলের বিষয়ও আছে। পিআইএল পরিচালক স্বাক্ষরিত ৮ সেপ্টেম্বর শিল্পমন্ত্রীকে দেওয়া এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘তৌহিদুজ্জামান ফৌজদারি মামলার আসামি। দরপত্র ছাড়া পিকআপ চুক্তি করে তিনি ১২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। প্রগতি টাওয়ার নির্মাণ প্রকল্প থেকে ১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা এবং গাড়ি উৎপাদন কারখানা উন্নতিকরণের নামে তিন কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তিনি একজন প্রমাণিত দুর্নীতিবাজ। তাই তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হলো।’ প্রতিবেদনে বলা হয়, তৌহিদুজ্জামানের সীমাহীন দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের কারণে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কোনো অনুমোদন ছাড়াই তাকে ২০১৭ সালে অবৈধভাবে মহাব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ২০১৬ সাল থেকে ২০ সাল পর্যন্ত প্রকৃত তথ্য গোপন করে এবং পিপিআর লঙ্ঘন করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে ৭১ লাখ ৬৯ হাজার টাকা বিল পরিশোধ করেছেন। শিল্পমন্ত্রীর কাছে দেওয়া পিআইএল’র পরিচালক জসিম উদ্দিন রাজিবের এক অভিযোগপত্রে বলা হয়, ডিপিপিতে জিপ গাড়ি কেনার সংস্থান নেই। কিন্তু নিয়মবহির্ভূতভাবে প্রকল্পের জন্য জিপ গাড়ি ক্রয় ও ব্যবহারে ৭৭ লাখ ২৬ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়। এছাড়া কোনো টেন্ডার ছাড়াই নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করে ডাবল কেবিন পিকআপের কম্পোনেন্ট সরবরাহ করা হয়। এ ক্ষেত্রে গাড়িপ্রতি তিন লাখ ২২ হাজার টাকা করে অতিরিক্ত মূল্য ধরা হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে অবৈধ প্রক্রিয়ায় গাড়ি কেনার কারণে সরকারের কোটি কোটি টাকার অর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এই অর্থ তৌহিদুজ্জামানের কাছ থেকে আদায় করার প্রস্তাব দেন তিনি। আরও বলা হয়, বগুড়াতে সার্ভিস সেন্টারের কোনো চাহিদা না থাকলেও সেটি তৈরির নামে সরকারের আট কোটি টাকার বেশি ক্ষতি করেছেন তৌহিদুজ্জামান। ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশ করে সেখান থেকে দুই কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। একই কায়দায় খুলনাতে সার্ভিস সেন্টার তৈরির নামে ২৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গাড়ির অক্সিলিয়ারি সরঞ্জাম কেনার নামে ৯৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। পিআইএল এমডির বিরুদ্ধে পরিচালক যেসব অভিযোগ উত্থাপন করেছেন সেগুলোর সত্যতা মিলেছে বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের উপপরিচালক হুমায়ুন কবির স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে। ৪ জুলাই তিনি এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরি করেন। জানতে চাইলে পিআইএল’এ এমডি তৌহিদুজ্জামান বলেন, আমি যে পদে আবেদন করেছিলাম সে পদে নিয়োগ পাইনি। কিন্তু এক ধাপ নিচের পদে পেয়েছি-এটা সত্য। কিন্তু বিষয়টি আমার হাতে ছিল না। যথাযথ কর্তৃপক্ষ নিচের পদে যোগ্য বিবেচনা করেই আমাকে লিখিত প্রস্তাব দিয়েছিল। আমি সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেছি। অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ওসব নিয়ে পিবিআই, শিল্প মন্ত্রণালয়, বিএসইসি এবং দুদকসহ বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত করেছে। এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে বলে জানা নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি চাকরিতে আসার আগেই প্রগতি টাওয়ার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। আমি যখন প্রকল্প পরিচালক হই, তখন টাওয়ারটি ১৪ তলা নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। পরে মন্ত্রণালয়ের সভায় সেটি ৩৭ তলা করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু আমাদের কাছে এত টাকা না থাকার কারণে ৩৭ তলা ভবন নির্মাণের কাজে হাত দিতে পারিনি। তাই শেষ পর্যন্ত ১৪ তলা ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু ততদিনে রাজউকের অনুমোদনের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এ কারণে ভবন নির্মাণের কাজে হাত দিতে পারিনি। অতিরিক্ত জ্বালানি তেলের ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী আমার জন্য ২০০ লিটার তেল বরাদ্দ থাকলেও ওই তেল আমার জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাই কোম্পানি আইন অনুযায়ী বেশি জ্বালানি তেল ব্যবহার করেছি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তৌহিদুজ্জামান বলেন, ‘ভ্রমণ বিলে আমি কখনো দুই নম্বরি করিনি। অনেকেই করেছে বা করছে। যারা দুই নম্বরি করে তারাই আমার জন্য অতিরিক্ত বিল তৈরি করে দিয়েছে। কিন্তু আমি তা গ্রহণ করিনি। অডিট আপত্তির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অডিট কর্মকর্তারা সবকিছু ভালো বোঝেন না। তারা আমার-আপনার কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয় জেনে বোঝার চেষ্টা করেন। অনেক সময় ধান্ধা করার চেষ্টা করেন। তারপরও বলব, অডিট আপত্তি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটা অতীতে ছিল। এখন আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। আশা করছি, ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে সব অপত্তি নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। মালামাল ক্রয়ে দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একজন লোক সব সময় মালামাল সরবরাহ করত। আমি এটা জানার পর সর্বনিম্ন দরদাতাকে দিয়ে মালামাল সরবরাহ করিয়েছি। আগে জাপানে তৈরি মালামালের কথা বলে ভারত, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়াসহ অন্য দেশ থেকে মালামাল সরবরাহ করা হতো। আমি জাপান থেকে মালামাল আনার উদ্যোগ নিলে দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট কেম্পানি প্রায় ৩০ বছর ধরে জাপানে মালামাল তৈরি করে না। ভারত, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়া চাহিদাকৃত মামলামাল তৈরি করে। তাই ওইসব দেশ থেকে মালামাল সরবরাহ করা হয়েছে।