বেপরোয়া বাইক

২৩ জানুয়ারি, ২০২৩ | ৬:৫২ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

রাজধানীর মগবাজার মোড়। রাত সাড়ে ৯টা। বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন এক যাত্রী। কিছুক্ষণ পর পর বাসের দিকে তাকাচ্ছিলেন তিনি। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর বাস না পেয়ে এক সিএনজি চালিত অটোরিক্সা চালকের কাছে জানতে চাইল যাত্রাবাড়ী যাবে কিনা। উত্তরে সিএনজি চালক বলল, যাব কিন্তু ভাড়া লাগবে ৫০০ টাকা। এত টাকা শুনে সিএনজিকে বিদায় করে দিলেন তিনি। এর কিছুক্ষণ পর এক মোটরবাইকের চালক বলল, ‘ভাই কই যাইবেন? যাত্রাবাড়ী? চলেন। ভাড়া হবে ২০০ টাকা।’ ওই যাত্রী বললেন, অ্যাপসে ভাড়া কত? চালক জানান, অ্যাপসে এখন আর বাইক চলে না। সবাই চুক্তিতে চলে। অ্যাপসে যাত্রাবাড়ীর ভাড়া আসে ১২৭ টাকা। এতে তাদের পোষায় না। কারণ এই ভাড়ার ১৫ শতাংশ টাকা অ্যাপস কোম্পানি কেটে নেয়। এছাড়া তেলের দাম বাড়ানোর পরও অ্যাপস কোম্পানি আগের রেটেই ভাড়া নির্ধারণ করে। এতে তাদের লোকসান হয়। এই বলে মোটরসাইকেল চালক চলে গেল। এর মধ্যে আট থেকে দশ মোটরসাইকেল চালক জড়ো হয়েছে ওই যাত্রীর চারপাশে সবার একই কথা ‘কই যাইবেন ভাই’। অবশেষে মোটরসাইকেল বা সিএনজিতে কোনোটাতে না উঠে বাসেই গন্তব্যে যেতে দেখা গেল তাকে। ঢাকার রাস্তায় এই দৃশ্য এখন প্রতিদিনের ঘটনা। রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে সাধারণ গণপরিবহনের চেয়ে চুক্তিভিত্তিক যাত্রী পরিবহনকারী মোটরসাইকেলের সংখ্যা এখন বেশি দেখা যায়। ঢাকার প্রতিটি ট্রাফিক সিগন্যালে ৫-১০টি অন্য গণপরিবহনের সঙ্গে শতাধিক মোটরসাইকেল অপেক্ষা করতে দেখা যায়। সিগন্যাল শেষ হওয়ার আগেই বেপরোয়া গতিতে চলাচল করে এ সব মোটরসাইকেল। শুধু ঢাকা নয় এই মোটরসাইকেলের বেপরোয়া গতি ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশের সড়ক ও মহাসড়কে। নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বাড়ছে। বেসরকারি তথ্যমতে, গত এক বছরে সারাদেশে ২ হাজার ৯৭৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৯১ জন নিহত ও ২ হাজার ১৫৪ জন আহত হয়েছেন। নিহতের মধ্যে ৭৬ দশমিক ৪১ শতাংশ ১৪ থেকে ৪৫ বছর বয়সী। যাদের বেশিরভাগই যুবক ও শিক্ষার্থী। তাই সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে শুধু ব্যবস্থা ও সিদ্ধান্ত নিলে হবে না এর সঙ্গে কঠোর জবাবদিহিতা রাখার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। এ বিষয়ে বুয়েটের অধ্যাপক মো. সামছুল হক বলেন, ‘বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মোটরসাইকেল একটি ঝুঁকিপূর্ণ বাহন। চার চাকার বাহনের তুলনায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ঝুঁকি ৩০ গুণ বেশি। মানুষ নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এ বাহনটির দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। শহরের বিভিন্ন জায়গায় সুযোগ পেলেই বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো কিংবা ফুটপাতের ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল চালানো একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। তীব্র যানজটের কারণে সবাই দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য এটা ব্যবহার করছে। কিন্তু এতে দীর্ঘ মেয়াদি ঝুঁকিতে পড়ছে বাংলাদেশ।’ এটা এখনই নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দেন তিনি। অবৈধ মোটরসাইকেলের সংখ্যা নেই বিআরটিএ’র কাছে ॥ তবে ঢাকা ও সারাদেশে কি পরিমাণ মোটরসাইকেল চলাচল করে, এর কোন পরিসংখ্যান নেই সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)’র কাছে। পদ্মা সেতু ছাড়া আর কোন কোন মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধÑএই তথ্যও জানা নেই বিআরটিএ’র কর্মকর্তাদের। এর আগে ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশন বন্ধ ঘোষণা করেছিল সংস্থাটি। কিন্তু এর সময়সীমা তিন দফা পিছিয়ে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে বিআরটিএর পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, ‘সারাদেশে কি পরিমাণ মোটরসাইকেল চলাচল করে এর তথ্য আমার কাছে নেই। এছাড়া পদ্মা সেতুসহ কোন কোন মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধÑএটাও আমার জানা নেই। সারাদেশের দুর্ঘটনার কোনো পরিসংখ্যান আমরা রাখি না। পুলিশ থেকে যে তথ্য পাই তাই রাখা হয়। তবে সড়ক ও মহাসড়কে মোটরসাইকেলসহ ছোট ছোট মোটরযান নিয়ন্ত্রণে একটি নীতিমালার খসড়া তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।’ এছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যতীত মোটরসাইকেল নিবন্ধন প্রদানের সময়সীমা আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে জানান তিনি। গত বছরে ঢাকায় নামছে ৫ লাখের বেশি মোটরবাইক ॥ বিআরটিএ’র তথ্যমতে, সারাদেশে এ পর্যন্ত অর্ধ কোটির বেশি মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ঢাকায় নিবন্ধনকৃত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৪০ লাখের বেশি। গত এক বছরে সারাদেশে ৬ লাখ ২৭ হাজার ৭৬০টি মোটরসাইকেল নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ঢাকা মহানগরীতে ৫ লাখ ৬ হাজার ৯১২টি মোটরসাইকেল নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। এর বেশির ভাগই রাজধানীতে চলাচল করছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। ২০১৬-১৭ সালে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে রাইড শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে মোটরসাইকেল চলাচল শুরু হলে বেড়ে যায় এর চাহিদা। ঢাকা শহরে যানজটের মধ্যে সহজে চলাচলের জন্য লোকে মোটরবাইক ব্যবহার করেন। তাই টাকা আয়ের পথ হিসেবে অনেকেই রাইড শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন। কিন্তু রাইড শেয়ারিং ছাড়া এখনো চুক্তিভিত্তিক যাত্রী পরিবহন করছে বেশিরভাগ মোটরসাইকেল চালকরা। রাজধানীর বাংলামোটর এলাকায় মিলন নামের এক মোটরসাইকেল চালক জানান, আগে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে তিনি চাকরি করতেন। তখন মাসে ৮-৯ হাজার টাকা বেতন ছিল। বছর দুই হলো তিনি বাইকে যাত্রী পরিবহন করেন। এতে তার মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা আয় হয়। কিন্তু অ্যাপসের মাধ্যমে চলাচল করলে এত টাকা আয় হতো না। মিলন বলেন, ‘ঢাকায় যানজটের কারণে মানুষ মোটরসাইকেল ব্যবহার করে। এখন অ্যাপস থেকে চুক্তিতে বেশি চলাচল হয়। বিভিন্ন সময় পুলিশ ধরে। মামলা দেয়। তখন টাকা দিয়ে ছাড়া পাই। এটা এখন আমাদের একটি পেশা।’ আঞ্চলিক সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেশি ॥ তবে এখন মোটরসাইকেল শুধু সড়ক ও মহাসড়ক নয়, পল্লী অঞ্চলের মাটির সড়কেও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অনেক এলাকায় সরকারি নিবন্ধন ছাড়াই চলছে এ সব মোটরবাইক। তাই সড়ক দুর্ঘটনাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত তিন থেকে চার বছরের মধ্যে মোটরসাইকেলের দুর্ঘটনা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বেসরকারি সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০২২ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৯৭৩টি, নিহত হয়েছে ৩০৯১ জন এবং আহত ২১৫৪ জন। অন্য যানবাহনের সঙ্গে মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটেছে ২১ দশমিক ২৬ শতাংশ, মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩২ দশমিক ২২ শতাংশ, মোটরসাইকেলে ভারি যানবাহনের চাপা ও ধাক্কা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে ৪৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ৩৮ দশমিক ৩১ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্য মোটরসাইকেল চালক এককভাবে দায়ী ছিল। দুর্ঘটনার জন্য বাসের চালক দায়ী ১১ দশমিক ৯৭ শতাংশ, ট্রাক চালক দায়ী ২৯ দশমিক ১৬ শতাংশ, কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি-ট্যাংকার চালক দায়ী ৯ দশমিক ১১ শতাংশ, প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাস চালক দায়ী ২ দশমিক ৮৪ শতাংশ, থ্রি-হুইলার ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ, বাইসাইকেল, প্যাডেল রিক্সা, রিক্সাভ্যান চালক দায়ী ০ দশমিক ৯৪ শতাংশ এবং পথচারী দায়ী ৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণ দায়ী ০ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ৩২ দশমিক ৩৫ শতাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে জাতীয় মহাসড়কে, ৪১ দশমিক ১৩ শতাংশ ঘটেছে আঞ্চলিক সড়কে, ১৫ দশমিক ২৮ শতাংশ ঘটেছে গ্রামীণ সড়কে এবং ১১ দশমিক ২৪ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে শহরের সড়কে। অপ্রাপ্ত বয়সের কিশোর-যুবকরা বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালানোর কারণে দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ‘মোটরসাইকেল ৪ চাকার যানবাহনের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু দেশে গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত ও সহজলভ্য না হওয়া এবং যানজটের কারণে মানুষ মোটরসাইকেল ব্যবহারে উৎসাহিত হচ্ছে এবং দুর্ঘটনা বাড়ছে। মোটরসাইকেল চালকদের বিরাট অংশ কিশোর ও যুবক। এদের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা এবং না মানার বিষয়টি প্রবল। কিশোর-যুবকরা বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালিয়ে নিজেরা দুর্ঘটনায় পড়ছে এবং অন্যদেরকেও ফেলছে। এদের বেপরোয়া মোটরসাইকেলের ধাক্কায় পথচারী নিহতের ঘটনাও বাড়ছে।’ সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকার প্রতিটি সড়কে দিন দিন বাড়ছে ব্যক্তিগত পরিবহন মোটরসাইকেল চলাচলের সংখ্যা। এর মধ্যে ব্যক্তিগত চলাচল থেকে চুক্তিভিত্তিক যাত্রী পরিবহন বেশি করতে দেখা গেছে। মোটরসাইকেল চালকদের বিরুদ্ধে বেপরোয়া আচরণের অভিযোগও জোরালো হচ্ছে। ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করার অভিযোগ রয়েছে মোটরসাইকেল চালকদের বিরুদ্ধে। সড়কের সিগন্যালে অপেক্ষার ধৈর্যও তাদের থাকে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া অনেক মোটরসাইকেল আরোহীরা যখন-তখন ফুটপাতের ওপর উঠিয়ে দেয় বলে পথচারীরা অভিযোগ করেন। রাজধানীর কাওরানবাজার এলাকায় সফিক নামের এক ট্রাফিক পুলিশ বলেন, ‘ঢাকায় কি পরিমাণ মোটরসাইকেল বাড়ছে তা প্রতিটি ট্রাফিক সিগন্যালের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। একটি বাসের পাশে ১০টি করে মোটরসাইকেল হিসাব করলেও বেশি হবে। কাওরানবাজার এলাকায় প্রতিটি সিগন্যালে ৩-৪ মিনিটে পর পর প্রায় ১০০ মতো মোটরসাইকেল জমা হয়। এদের বেশিরভাগই যাত্রী পরিবহন করে। এদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে মামলা ও জরিমানা করা হয়। কিন্তু যাত্রীরা আমাদের সহযোগিতা করে না।’ আরোহীদের সচেতনতা ও মানসিকতা না বদলালে এটি পুরোপুরি বন্ধ করা মুশকিল বলে জানান তিনি।