খেলাপি লাখ কোটি টাকা বকেয়া ২ লাখ কোটি

২৭ মে, ২০২৫ | ৮:০৯ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

ব্যাংক খাত ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের বা বিএফআইইউ এখন পর্যন্ত তদন্তে বহুমুখী অনিয়ম ও জালিয়াতির তথ্য পেয়েছে। বিদেশে টাকা পাচারের ঘটনাও পাওয়া গেছে। তাদের বিষয়ে দেশে-বিদেশে আরও তদন্ত হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে এসব গ্রুপের নেওয়া মোট ঋণের মধ্যে যেগুলোর পরিশোধ করার সময় উত্তীর্ণ হয়েছে, কিন্তু এখনো তা করা হয়নি-এমন অপরিশোধিত (বকেয়া) ঋণের অঙ্ক বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকায়। এসব গ্রুপের মোট ঋণের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো বা সিআইবিতে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে-এমন ঋণের অঙ্ক ১ লাখ কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউর হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এদিকে সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা-উল্লিখিত অপরিশোধিত ঋণও খেলাপির পথে এগোচ্ছে, সেক্ষেত্রে খেলাপি আরও ২ লাখ কোটি টাকা বেড়ে যেতে পারে। এখন পর্যন্ত তদন্তে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের স্বনামে ঋণ পাওয়া গেছে ৫৩ হাজার ৪২ কোটি টাকা। মোট ২৪টি ব্যাংক থেকে তিনি এসব ঋণ গ্রহণ করেছেন। এই ঋণের মধ্যে সরকারি খাতের জনতা ব্যাংক থেকে ৪৭ শতাংশ ও সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন আইএফআইসি ব্যাংক থেকে ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ ঋণ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকগুলো খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করে ২০ হাজার ৫১৭ কোটি টাকার ঋণের তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিআইবিতে পাঠিয়েছে। বাকি ঋণও খেলাপিযোগ্য। অনেক ঋণের বিপরীতে জামানত নেই বলে ব্যাংকগুলো খেলাপি করেছে। কিন্তু সে তথ্য এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো হয়নি। কারণ গ্রাহকের ব্যবসা সচল রাখতে নতুন ঋণ দিয়ে কিছু খেলাপি ঋণ নবায়ন করেছে। এর আগে বেক্সিমকোর ৫৩ হাজার কোটি টাকাই খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। বেক্সিমকো গ্রুপের বেনামে আরও ঋণ রয়েছে। সেগুলোর বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। পলাতক ব্যবসায়ী সাইফুল আলম মাসুদের মালিকানাধীন এস আলম গ্রুপের মোট ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ঋণের বিপরীতে যথেষ্ট জামানত না থাকায় দেড় লাখ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি করেছিল। পরে সম্পত্তির নিলাম করে কিছু ঋণ আদায় করেছে। তাদের প্রত্যাবাসিত রপ্তানি বিল থেকেও কিছু ঋণ আদায় করেছে। তবে ব্যাংকগুলো এখনো পুরো খেলাপি ঋণের তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রতিবেদন আকারে পাঠায়নি। কারণ এতে এস আলম গ্রুপ ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো বা সিআইবিতে খেলাপি হয়ে পড়লে গ্রুপের ওই কোম্পানি আর নতুন ঋণ পাবে না। এলসি খুলতে পারবে না। এজন্য ব্যবসা সচল রাখতে ব্যাংকগুলো কিছুটা শিথিলতা দেখাচ্ছে। তবে ব্যাংকগুলো নিজেরা অনেক ঋণ খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করেছে। এর অঙ্ক ৬০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এস আলম গ্রুপ সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক থেকে। এছাড়া তার দখল করা আরও পাঁচ ব্যাংক ও সরকারি জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছে। গ্রুপের ঋণের মধ্যে এখন পর্যন্ত পরিশোধের সময় উত্তীর্ণ হয়েছে, কিন্তু পরিশোধ করা হয়নি, এমন অপরিশোধিত ঋণের অঙ্ক ৬৪ হাজার কোটি টাকা। জনতা ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক গ্রুপের ৬০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করেছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানাধীন আরামিট গ্রুপ নামে-বেনামে ব্যাংক থেকে কমপক্ষে হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। এর মধ্যে বেনামি ঋণসহ ব্যাংকগুলো ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপি করেছে। বেশির ভাগ ঋণই নিয়েছে নিজের মালিকানাধীন ব্যাংক ইউনাইটেড কর্মাশিয়াল ব্যাংক থেকে। এখন পর্যন্ত গ্রুপটির অপরিশোধিত ঋণ ১ হাজার ১০ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলো সাইফুজ্জামানের গ্রুপের নিজ নামে দেওয়া ঋণের মধ্যে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে ৬৩৯ কোটি টাকার। তিনি দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ায় তার ঋণের বিষয়ে এখন ব্যাংকে কোনো আলোচনা হচ্ছে না। নাবিল গ্রুপের অপরিশোধিত ঋণ ৯ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক থেকেই বেশি ঋণ নেওয়া হয়েছে। ওই ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৭ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণ নানাভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়েছে। নাসা গ্রুপের মোট ঋণের মধ্যে যেসব ঋণ পরিশোধের মেয়াদ পার হয়েছে, কিন্তু পরিশোধ করা হয়নি-এমন অপরিশোধিত ঋণের পরিমাণ ৯ হাজার ২১৫ কোটি টাকা। গ্রুপের ব্যবসা সচল রাখার জন্য কিছু খাতে ছাড় দেওয়া হয়েছে। তাদের মোট ঋণের মধ্যে জনতা, ইসলামীসহ কয়েকটি ব্যাংক ১ হাজার ২২৭ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করেছে। ওরিয়ন গ্রুপের অপরিশোধিত ঋণ ১০ হাজার ১২ কোটি টাকা। জনতা ও রূপালী ব্যাংক থেকে বেশির ভাগ ঋণ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ১ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। গ্রুপটি এসব ঋণ নিয়মিত করতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। জেমকম গ্রুপের অপরিশোধিত ঋণ ২ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ১৯৩ কোটি ১১ লাখ টাকার ঋণ। এসব ঋণ নিয়মিত করতে গ্রুপটি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে। সিকদার গ্রুপের মোট অপরিশোধিত ঋণ ১৩ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০ হাজার ২৩৩ কোটি টাকার ঋণ গ্রুপের উদ্যোক্তাদের নামে রয়েছে। বাকি ২ হাজার ৯৪০ কোটি টাকার ঋণ তাদের নয় বলে গ্রুপটি দাবি করে আসছে। এ বিষয়ে আদালতে রিট করলে ওই ঋণের ওপর আদালতের স্থগিতাদেশ রয়েছে যে, বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ওই ঋণ সিকদার গ্রুপের নামে দেখানো যাবে না। গ্রুপটি ঋণের বেশির ভাগই নিয়েছে তাদের মালিকানাধীন ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে। কিছু ঋণ নিয়েছে এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে। গ্রুপটির বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৯৫ কোটি টাকা। দেশের অপর একটি শিল্পগ্রুপের মোট অপরিশোধিত ঋণ ৩৪ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা। তারা মোট ঋণের ইউসিবি থেকে ১৬ শতাংশ, ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ১১ শতাংশসহ মোট ৪২টি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। তাদের মোট ঋণের মধ্যে এখন পর্যন্ত খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে ৭ হাজার ৮১১ কোটি টাকার। গ্রুপটির ঋণ নবায়নের বিষয়ে ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। কিছু ঋণ নবায়নের প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া সামিট গ্রুপের ঋণের মধ্যে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করার কথা, কিন্তু পরিশোধ করা হয়নি, এমন অপরিশোধিত ঋণ হচ্ছে ১ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা।