সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ সংবিধানবিরোধী

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ১৯৭৯ সালে বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি চাকরি (বিশেষ বিধান) জারি হয়েছিল। তখন ব্যাংক খাতে অরাজকতা চলছিল। সেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যই মার্শাল ল অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে বিশেষ বিধানটি করা হয়। ২০১৮ সালে সরকারি কর্মচারী আইন প্রণয়নের সময় এ অধ্যাদেশটি বাতিল করা হয়। কিন্তু বর্তমান সরকার সেই পুরোনো অধ্যাদেশটি আবার ফেরত আনছে। তারা বলেন, সামরিক সরকারের সময়ে জারি করা অধ্যাদেশ বর্তমান সরকার পুনরুজ্জীবিত করেছে। বিশেষ বিধান সংবলিত অধ্যাদেশ জারি করা এই সরকারের কাজ না। মার্শাল ল অর্ডিন্যান্সকে গণতান্ত্রিক বিধি বলা যায় না। এটা সংবিধানবিরোধী কালো আইন। এটি বাতিল করা উচিত। নীতিনির্ধারণী কর্মকাণ্ডে হাত দেওয়া এ সরকারের কাজ নয় বলেও অনেকে মন্তব্য করেন। তারা বলেন, অতীতে কর্মচারীদের আন্দোলনে বড় বড় ঘটনা ঘটে গেছে। রোববার সন্ধ্যায় জারীকৃত ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা সোমবার কাছে এসব মন্তব্য করেন। তারা বলেন, কর্মচারীরা সরকারের বাইরের কেউ না। সুতরাং সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব এএসএম আব্দুল হালিম বলেন, কর্মচারীরা তাদের সমস্যা ও অধিকার নিয়ে কথা বলবেই। তারা সরকারের বাইরের কেউ না। তাদের দাবির ন্যায্যতা আছে। বিগত সময়ে সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলনে বড় বড় ঘটনাঘটে গেছে। সরকারকে বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে আসা উচিত। সেই ক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সাবেক সচিব একেএম আব্দুল আউয়াল মজুমদার বলেন, এ ধরনের অধ্যাদেশ প্রণয়ন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ না। এ সরকার একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে রাজনৈতিক সরকারের কাছে দায়িত্ব দিয়ে চলে যাবে-এটাই তাদের কাজ। নীতিনির্ধারণী কোনো কাজে হাত দেওয়া এ সরকারের কাজ না। তাদের কাজগুলো ফেলে রেখে তারা অন্যদিকে মনোনিবেশ করেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের সভা-সমাবেশ ভালো কিছুর লক্ষণ না। তিনি আরও বলেন, এ ধরনের অস্থিরতা থাকলে বিদেশি বিনিয়োগসহ সব ধরনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঝুলে যাবে। এ বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। সরকারকে কারা যে বুদ্ধিপরামর্শ দেয়, তা বোঝা মুশকিল বলে মন্তব্য করেন সাবেক এ আমলা। সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, ১৯৭৯ সালে সামরিক সরকারের সময়ে সরকারি চাকরি (বিশেষ বিধান) জারি করা হয়। এটি একটি জংলি ও কালো আইন এবং সংবিধানবিরোধী বিধান। তৎকালীন সরকার যে বিধান জারি করেছিল, বর্তমান গণতান্ত্রিক পরিবেশে একই অধ্যাদেশ কেন পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। এ অধ্যাদেশ জারি করে নাগরিক হিসাবে সব কর্মচারীর নাগরিক ও সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে। আইন ও বিধি জারি করে কর্মচারীদের তোপের মুখে রাখবে, এটা তো ঠিক না। ১৯৭৯ সালের বিশেষ বিধানের আলোকে সরকারি চাকরি আইন সংশোধনের সমালোচনা করে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান আরও বলেন, তখন বিশেষ বিধান আইন করা হয়েছিল ব্যাংকিং খাতে যে চরম অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছিল সেই প্রেক্ষাপটে এবং সেটিকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। তখন তা করা হয়েছিল মার্শাল ল অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে। তিনি আরও বলেন, মার্শাল ল অর্ডিন্যান্সকে গণতান্ত্রিক বিধি বলা যায় না। সেটিকে রিভাইভ করে সরকারি কর্মচারীদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে বিদায় করে দেবেন-বাসাবাড়িতে কাজ করে এমন কর্মচারীর ক্ষেত্রেও এরকম করা যায় না। তিনি বলেন, সরকারি চাকরি পাওয়া একটা প্রক্রিয়ার ব্যাপার। বিভিন্ন পর্যায়ে পরীক্ষা, অপেক্ষা, তারপর নিয়োগ হয়। সেক্ষেত্রে এত সহজে কর্মচারীকে চাকরি থেকে বিদায় করে দেওয়াটা কি মামাবাড়ির আবদার না! এ আইন বাস্তবায়ন করলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য গঠন করা হয়েছিল, সে কথা বলার আর সুযোগ থাকবে না। তিনি বলেন, অনেকেই অভিযোগ করে মিয়ানমারকে মানবিক করিডর দেওয়া, চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি কোম্পানিকে পরিচালনা করতে দেওয়া এবং এনবিআর দুইভাগে ভাগ করা সরকারের কাজ ছিল না। এসব করে সরকার নন ইস্যুকে ইস্যু বানিয়েছে। তাদের আসল কাজ হলো একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচণের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা। সেই কাজটি বাদ দিয়ে অপ্রয়োজনীয় কাজে হাত দিয়েছে সরকার। সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ-২০২৫ বাতিলের দাবিতে কয়েকদিন ধরেই উত্তাল সচিবালয়। এর মধ্যেই চাকরিচ্যুতির মতো শাস্তির বিধান রেখেই সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে রোববার সন্ধ্যায়। সচিবালয়ে কর্মরত নন-ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সব সংগঠনের নেতারা এক হয়ে দাবি আদায়ে আন্দোলন করছেন। নেতারা বলেন, অধ্যাদেশের অপপ্রয়োগে অনেক নিরীহ কর্মচারী চাকরি হারাবে। কর্মকর্তারা কর্মচারীদের ওপর নিপীড়ন চালাবে। কর্মচারীরা কর্মকর্তাদের রোষানলে পড়বে। মহিলা কর্মচারীদের জিম্মি করে তাদের ওপর নিপীড়ন চালানোর ক্ষেত্র তৈরি হবে।