ব্যয় ভারের চাপে ধুঁকছে মানুষ

২১ জানুয়ারি, ২০২৩ | ৬:৪৫ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

ঋণ পেতে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত বাস্তবায়নে সরকার একের পর এক পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়াচ্ছে। ৭ মাসে ছয়বার বাড়ানো হয়েছে গ্যাস, বিদ্যুৎ, তেল ও সারের দাম। এর প্রভাবে সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাচ্ছে। এতে একদিকে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে। টাকার মান কমে গিয়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাওয়ায় মান কমে যাচ্ছে। ব্যয়ভারে সংকুচিত হয়ে পড়ছে মানুষের জীবন। একই সঙ্গে সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চাপের সৃষ্টি হয়েছে। সূত্র জানায়, জুন থেকে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে দুদফা। প্রতি দফায়ই এর দাম বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণে। ৫ জুন গ্যাসের দাম বেড়েছে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ, ১৮ জানুয়ারি বেড়েছে ১৮০ শতাংশ। এর ৭ দিন আগে ১২ জানুয়ারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ৫ শতাংশ। ২১ নভেম্বর পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। ৫ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। ১ আগস্ট সারের দাম বাড়ানো হয় সাড়ে ৩৭ শতাংশ। গত সাড়ে ৭ মাসে ৪ ধরনের সেবার দাম ছয় দফায় বাড়ানো হয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সব খাতে। শিল্পের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এর প্রভাবে বেড়েছে পণ্যের দাম। যা মানুষের জীবনযাত্রাকে ব্যয়বহুল করে তুলেছে। একইসঙ্গে গণপরিবহণ ও পণ্য পরিবহণ ভাড়া বেড়েছে লাগামহীনভাবে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে গ্যাস দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম বাড়বে। ব্যাটারিচালিত গণপরিবহণের ভাড়াও বৃদ্ধি পাবে। শিল্পকারখানায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল চালিকা শক্তি ক্যাপটিভ পাওয়ার। সেই ক্যাপটিভ পাওয়ারের দাম একলাফে ৮৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। প্রতি ঘনমিটার ১৬ টাকার জায়গায় এখন দিতে হবে ৩০ টাকা। এতে পণ্য উৎপাদন খরচ দ্বিগুণের বেশি বেড়ে যাবে। যদিও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ পাওয়া নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। সব মিলে পণ্য ও মানুষের চলাচলের খরচ বেড়ে যাবে। বিদ্যুৎ ও সারের দাম বাড়ানোর কারণে কৃষি খাতে উৎপাদন খরচ বেড়ে চলছে। জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতকে বলা হয় ‘অর্থনীতির লাইফ লাইন’, যা অর্থনীতির রক্ত সঞ্চালনের মতো। সব ধরনের পণ্য ও সেবা এবং মানুষের জীবনযাত্রায় এগুলোর প্রভাব রয়েছে। অর্থাৎ এসব পণ্য ও সেবা ছাড়া বৈশ্বিক বা মানুষের জীবনযাত্রা কল্পনাই করা যায় না। যে কারণে এসব পণ্যের দাম দেশে বা বিদেশে বাড়লে এর নেতিবাচক প্রভাব আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে দেশীয় আর্থিক ব্যবস্থাপনায়ও পড়ে। ১৮ জানুয়ারি সরকারের নির্বাহী আদেশে আকস্মিকভাবে গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে সব ধরনের পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়ে যাবে। এর নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে রপ্তানি ও শিল্প খাতে। চড়া দামে গ্যাস কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে তার খরচও বাড়বে। গ্যাস নির্ভর শিল্পের বয়লার পরিচালন খরচও বাড়বে। বিশেষ করে বস্ত্র, সিরামিক, প্লাস্টিক, লৌহ, প্রকৌশল, জাহাজ ভাঙা, ইস্পাত শিল্পে খরচ বেশি বাড়বে। এগুলোর দাম বাড়লে নির্মাণ, আবাসন, উন্নয়ন খরচসহ অনেক খাতেই খরচ বাড়বে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধি যে এখানেই শেষ তা নয়। প্রধানমন্ত্রী বুধবার সংসদে বলেছেন, ‘যে দামে সরকার গ্যাস আমদানি করবে, সেই দামেই ব্যবসায়ীদের গ্যাস কিনতে হবে।’ এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দাম এখনো চড়া। ওই দামে আমদানি করলে ডলারের ওপর চাপ বাড়বে। এতে ডলারের দাম বেড়ে গিয়ে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আরও চাপ পড়তে পারে। এ প্রসঙ্গে নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, গ্যাসের দাম যেভাবে বাড়ানো হয়েছে, তাতে উৎপাদন খরচ বেশ ভালোভাবেই বাড়বে। এর আগেও জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এর সঙ্গে কাঁচামাল ও ডলারের দাম বৃদ্ধি তো আছেই। কিন্তু তারপরও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ মিলছে না। দাম বাড়ানোর কারণে যে হারে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে তারচেয়ে বেশি বাড়ছে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে। এতে কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। উৎপাদন কম হচ্ছে। অথচ শ্রমিক ও অন্যান্য খাতে খরচ কমছে না। ফলে রপ্তানি খাত তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে। সূত্র জানায়, ২১ নভেম্বর পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। ১২ জানুয়ারি ৫ শতাংশ বাড়ানো হলো খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এখন থেকে ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম প্রতি মাসেই সমন্বয় করা হবে। অর্থাৎ ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম আরও প্রায় ১৫ শতাংশ বাড়ানো হবে। ভোক্তা পর্যায়ে নতুন করে বিদ্যুতের দাম গড়ে ৫ শতাংশ হারে বাড়ানোর ফলে সব খাতেই উৎপাদন খরচ বাড়বে। এবার গৃহস্থালি থেকে শুরু করে কৃষির সেচ, শিল্প এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্রশিল্প, নির্মাণশিল্প, ধর্মীয়, শিক্ষা এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠান, পানির পাম্প, ইলেকট্রিক যানের ব্যাটারি চার্জ, মাঝারি, বড়, ভারী শিল্প খাতে গড়ে ৫ শতাংশ হারে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর প্রভাবে কৃষি উৎপাদনে সেচের খরচ বাড়বে। এসব খাতে শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়বে। এতে বাড়বে পণ্যের দাম। বিদ্যুৎচালিত ব্যাটারি চার্জেও খরচ বাড়ায় এর ভাড়াও বাড়তে পারে। পানির পাম্পের বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে এর দামও বাড়বে। এর আগে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাবেও নিত্যপণ্য ও পরিবহণ ব্যয় বেড়েছে। যে কারণে আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে উঠেছিল। জুলাইয়ে এ হার ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। সূত্র জানায়, ডলারের দাম, জ্বালানি তেল, বিদ্যুতের দাম, গ্যাসের দাম বাড়ানো ও আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির ফলে শিল্প পণ্যের উৎপাদন খরচ ইতোমধ্যেই ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে কৃষিপণ্যের দাম। শিল্প পণ্যের দামও ৩০ থেকে ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এদিকে ভোক্তার আয় কমায় সার্বিকভাবে বিক্রি কমে গেছে। যে কারণে প্রায় সব ব্যবসায়ে মন্দা চলছে। সব মিলে ভোক্তার কাঁধে চাপ বাড়ছে। মন্দায় আয় বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না বলে ভোক্তাকে জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে আপস করতে হবে। এটি করলে খাবারে পুষ্টির মান কমবে। বিনোদন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভ্রমণ এসব খাতে ব্যয় কমাতে হবে। ফলে ওইসব খাতে আরও মন্দা ভর করবে। ইতোমধ্যেই পণ্যের বাড়তি দামে ভোক্তার নাভিশ্বাস উঠেছে। আয় না বাড়লেও ব্যয় বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে অনেকে সঞ্চয়ে হাত দিয়েছেন। নতুন সঞ্চয়ও করতে পারছেন না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যাংকে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সার ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় কৃষিতে সংকট আরও বেশি। একদিকে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় সেচের খরচ বাড়বে। বাড়তি দামেও গ্রামে বিদ্যুৎ মিলছে না। ফলে সেচ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ সেচের বড় মৌসুম চলছে এখন। মার্চ পর্যন্ত চলবে। এই সময়ে গ্রামে লোডশেডিংও বেড়েছে। এছাড়া সারের তীব্র সংকট তো আছেই। আন্তর্জাতিক বাজারে কৃষি উপকরণের দাম বেশি হওয়ায় দেশেও এর দাম বেড়েছে। এদিকে ডলার সংকটের কারণে এসব পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। ফলে দাম আরও বাড়ছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সাবেক কর্মকর্তা ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব একেএম মনোয়ার হোসেন আখন্দ বলেন, জ্বালানি বিভাগের নির্বাহী আদেশে বিইআরসিকে পাশ কাটিয়ে গ্যাসের মূল্য একতরফা বৃদ্ধি করেছে সরকার। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ১৭৯ শতাংশ দাম বৃদ্ধি করে প্রতি ঘনমিটার গ্যাস ৫.০২ থেকে ১৪ টাকায় নির্ধারণ করেছে। ২০২২ সালে বাড়ানো হয় ১৩ শতাংশ, ২০১৯ সালে ৪১ শতাংশ। ২০১৭ সালে মূল্য ছিল ৩.১৬ টাকা। একইভাবে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য মূল্য ৮৮ শতাংশ বৃদ্ধি করে ১৬ টাকা থেকে ৩০ টাকা নির্ধারণ করেছে। ২০২২ সালে বাড়ানো হয় ১৬ শতাংশ, ২০১৯ সালে ৪৪ শতাংশ। এছাড়া শিল্প প্রতিষ্ঠানের (বৃহৎ, মাঝারি, ক্ষুদ্র, কুটির) যথাক্রমে ১৫০ শতাংশ, ১৫৫ শতাংশ, ১৭৮ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধি করা হয়। যা সীমাহীন বলা যায়।