পাক-ভারতের দুই হায়দরাবাদ, দুই বেকারি, দুই রকম ভাগ্য

এই গল্পটি দুটি শহরের— দুটিই নামকরণে এক, হায়দরাবাদ। একটি ভারতের দক্ষিণে, অন্ধ্রপ্রদেশে। অপরটি পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে। কিন্তু এই দুটি হায়দরাবাদ শহরের ভিন্ন রাজনৈতিক বাস্তবতা দুই বেকারির নিয়তিকে দাঁড় করিয়েছে দুই বিপরীত মেরুতে। একদিকে ভারতের হায়দরাবাদের ঐতিহ্যবাহী ‘করাচি বেকারি’, অন্যদিকে পাকিস্তানের হায়দরাবাদের ‘বোম্বে বেকারি’। দুটি প্রতিষ্ঠানই শুধু ব্যবসা নয়, উপমহাদেশের বিভক্ত ইতিহাসের জীবন্ত স্মারক। ভারতের হায়দরাবাদে ১৯৪৭ সালে গঠিত হয় করাচি বেকারি। দেশভাগের সময় করাচি থেকে ভারতে পাড়ি জমানো এক হিন্দু শরণার্থী পরিবার এটি প্রতিষ্ঠা করে। পূর্বপুরুষদের শহরের প্রতি ভালোবাসা ও স্মৃতিকে ধারণ করেই বেকারির নাম রাখা হয় ‘করাচি’। দীর্ঘ সাত দশক ধরে এটি কেবল বেকারি নয়, হয়ে উঠেছে স্থানীয় ও প্রবাসী ভারতীয়দের এক ধরনের আবেগ, ঐতিহ্য ও আত্মপরিচয়ের অংশ। তাদের ফল কেক, প্লাম কেক, বিস্কুট ভারতের নানা প্রান্তে সুপরিচিত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-পাকিস্তান রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সীমান্ত সংঘর্ষের পর ‘করাচি’ নামটি হয়ে দাঁড়িয়েছে কিছু উগ্র জাতীয়তাবাদীর টার্গেটে। হিন্দু উগ্রবাদীরা করাচি বেকারির বিভিন্ন শাখায় হামলা চালায়, পাকিস্তানের পতাকা পোড়ায়, এমনকি সাইনবোর্ডে ‘করাচি’ লেখা ঢেকে ফেলতে বাধ্য করে। পাক-ভারতের দুই হায়দরাবাদ, দুই বেকারি, দুই রকম ভাগ্য ২০১৯ সালে বেঙ্গালুরুর শাখাও একই ধরনের বিদ্বেষের শিকার হয়। একজন গ্রাহক টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে বলেন, ঘৃণায় এতটাই অন্ধ হয়ে গেছে মানুষ, যে বোঝার চেষ্টাও করছে না— কে এই বেকারির মালিক, কী তার উদ্দেশ্য। তবে হায়দরাবাদের অনেকেই এখনো এই ঐতিহ্য রক্ষায় এগিয়ে আসছেন। একজন স্থানীয়, হরিশ জানান, আমরা ভালোবাসা দিয়ে প্রতিবাদ করব। আরও কেক কিনব, আরও সমর্থন জানাব। অন্যদিকে, পাকিস্তানের হায়দরাবাদের বোম্বে বেকারি এক শান্ত ও গর্বিত অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯১১ সালে হিন্দু ব্যবসায়ী পহলাজরাই গঙ্গারাম থাদানি এই বেকারির সূচনা করেন। দেশভাগের পরও পরিবারটি এই প্রতিষ্ঠান ধরে রাখে। পাক-ভারতের দুই হায়দরাবাদ, দুই বেকারি, দুই রকম ভাগ্য পরবর্তী প্রজন্মের একজন সদস্য ইসলাম গ্রহণ করে হন সালমান শেখ। বর্তমানে বেকারিটি পরিচালিত হচ্ছে পরিবারের চতুর্থ প্রজন্মের মাধ্যমে। এক সময়ের কর্মচারী আজিজ ভাই আজিজ, যিনি ১৯৬১ সালে কাজ শুরু করেন, এখনো প্রতিষ্ঠানটির অংশ। তিনি বলেন, পাক-ভারত উত্তেজনা যতই বাড়ুক, আমাদের এই গলিতে কখনো আতঙ্ক দেখিনি। বোম্বে বেকারির নাম নিয়ে কখনোই আপত্তি ওঠেনি পাকিস্তানে। বরং তাদের বাদাম কেক, চকলেট কেক, কফি কেক দেশের নানা প্রান্তে পরিচিত। অতিথি আপ্যায়ন, উৎসব বা পরিবারের মুহূর্ত— সব কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই বেকারির নাম। স্থানীয় এক বাসিন্দা রাফায় খান বলেন, আমরা করাচি বেকারিতে হামলার তীব্র নিন্দা জানাই। বোম্বে বেকারি শুধু একটি দোকান নয়, এটি হায়দরাবাদের আত্মা। এই দুই বেকারির ভিন্ন ভাগ্য আমাদের সামনে একটি বড় প্রশ্ন তোলে—আমরা কি শুধু নাম দেখে মানুষ বা প্রতিষ্ঠানকে বিচার করব, নাকি তাদের ইতিহাস, অবদান ও মানবিক মূল্যবোধকে বিবেচনায় নেব? করাচি বেকারি ও বোম্বে বেকারি— দুটিই এক অভিন্ন অতীতের উত্তরসূরি। কিন্তু একটিকে আজ ঘৃণা গ্রাস করছে, আরেকটি রয়ে গেছে ভালোবাসা আর ঐতিহ্যের আশ্রয়ে। এটাই দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতা— যেখানে ইতিহাসের কিছু অংশ সংরক্ষিত থাকে, আর কিছু হারিয়ে যায় রাজনীতির কুয়াশায়। সূত্র : টিআরটি ওয়াল্ড, ডন নিউজ