খবর দিতে এসে নিজেই খবর

২০ জানুয়ারি, ২০২৩ | ৭:১২ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

মওলানা ভাসানী ১৯৬৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ‘হাট হরতালের’ ডাক দিয়েছিলেন। নিজ বাড়ি নরসিংদীর মনোহরদি থেকে সেই হাট হরতালে অংশগ্রহণ করেছিলেন আসাদ। এ কারণে তিনি পুলিশের হামলার শিকার হয়ে গুরুতর আহত হন। পরে মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়েই ঢাকায় আসেন এই খবরটি দিতে। এর কিছুদিন পরেই তিনি নিজে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে যান। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার কারণে তাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সেই সময় দৈনিক পাকিস্তানে পত্রিকাটির সহকারী সম্পাদক নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘আসাদ এসেছিল খবর দিতে, আর আসাদ আজকে এলো খবর হয়ে।’ পুলিশের গুলিতে নিহত এই ছাত্রনেতার নাম আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। তার মৃত্যুতেই ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের মোড় ঘুরে যায়। যার ধারাবাহিকতায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পান শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৪ জন। পতন ঘটে বেসিক ডেমোক্রেসির কর্ণধার স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের। তারই ধারাবাহিক আন্দোলনে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। এই ছাত্রনেতা আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানই পরে খ্যাতি লাভ করেন শহীদ আসাদ হিসেবে। যার নামে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের প্রবেশপথে একটি বিশাল তোরণ শোভা পাচ্ছে। এই তোরণ বাংলাদেশের মানুষের কাছে ‘আসাদ গেট’ নামে পরিচিত। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের এই পথিকৃৎ শহীদ আসাদের আজ ২০ জানুয়ারি মৃত্যু দিন। দিনটিকে সকল রাজনৈতিক দল আসাদ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ডাকসুসহ চার ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ), পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ)-এর নেতৃবৃন্দ ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করে এবং ছাত্রদের পক্ষ থেকে ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। তৎকালীন ইকবাল হলে ওই সময়ের ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদের ৩১৩ নম্বর কক্ষে বসেই ১১ দফার ভিত্তিতে গণআন্দোলনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ১১ দফার মধ্যে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কিত ৬ দফার সঙ্গে ছাত্র সমস্যাকেন্দ্রিক দাবি-দাওয়ার পাশাপাশি কৃষক ও শ্রমিকদের স্বার্থসংক্রান্ত দাবিসমূহ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বস্তুত ১১ দফা কর্মসূচির মাধ্যমে ছাত্র নেতারা যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তা ছিল অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং এ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করেই গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী দলগুলোর মধ্যে একটি আন্দোলনগত ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তাছাড়া এ সময় থেকেই শেখ মুজিবের মুক্তি ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের বিষয়টি প্রাধান্য পেতে শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদসহ (ডাকসু) ছাত্র সংগ্রাম কমিটির পূর্ব বাংলার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা ঊনসত্তরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষিত হওয়ার পরপরই ৮ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও মোজাফফর ন্যাপসহ আটটি রাজনৈতিক সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন কমিটি (ডাক)। তারা ফেডারেল পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার, প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবুর রহমান, খান আবদুল ওয়ালী খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ সব রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি দাবি করে এবং দাবিগুলো বাস্তবায়নের পক্ষে গণআন্দোলন জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে ‘ডাক’ভুক্ত উগ্র ডানপন্থি কয়েকটি সংগঠন ছাত্র সংগ্রাম কমিটির দেওয়া ১১ দফা কর্মসূচিকে সমর্থন করতে অস্বীকার করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আন্দোলন ক্রমেই দানা বেঁধে ওঠে এবং ১১ দফার চেতনা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি সরকারপন্থি ছাত্র সংগঠন এনএসএফের একটি অংশও তাদের ‘সংগ্রামী ২২ দফা’ কর্মসূচি নিয়ে প্রকাশ্যে সরকারবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রদের ১১ দফা এবং বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দাবির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে ছাত্র সংগঠনের নেতারা। সেই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন আসাদ। সে সময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে এমএ শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। এছাড়া তিনি ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) ঢাকা হল শাখার সভাপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান সংগঠক। ১৯৬৯ সালের ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবনের বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এটিই ছিল ১১ দফা প্রণয়নের পর সংগ্রাম কমিটির প্রথম কর্মসূচি। ওই সমাবেশ থেকে এগারো দফার বাস্তবায়ন এবং ছাত্র জনতার ওপর পুলিশ ও ইপিআর বাহিনী কর্তৃক নির্যাতন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্রতা লঙ্ঘনের প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি ২০ জানুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালনের ডাক দেয়। এই ধর্মঘট বানচালের জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খান ছাত্র আন্দোলন দমনের জন্য ১৪৪ ধারা আইন জারির নির্দেশ দেন। সরকারের পক্ষে ধর্মঘট মোকাবিলার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। এগারো দফা দাবি, বঙ্গবন্ধুসহ রাজবন্দিদের মুক্তি এবং ১৪৪ ধারার বিরুদ্ধে ১৮ ও ১৯ জানুয়ারি ছাত্ররা বিক্ষোভ করে। এসব বিক্ষোভে পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ছাত্ররা তাদের আন্দোলনের পক্ষে দুর্বার হয়ে যায়। পুলিশের বর্বরতা ও গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচির সঙ্গে ২০ জানুয়ারি পুনরায় বটতলায় সমাবেশের কর্মসূচিও দেওয়া হয়। এদিন ১১ দফার দাবিতে ঢাকাসহ প্রদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। আর বটতলার সমাবেশ যেন জনসমুদ্রে পরিণত হয়। বিভিন্ন কলেজের ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হয়। এদের সঙ্গে যোগ দেন শ্রমিক এবং সাধারণ মানুষও। দুপুর ১২টার দিকে বটতলায় এক সংক্ষিপ্ত সভা হয়। সভার সভাপতি তৎকালীন ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ তার বক্তৃতায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘যতদিন আগরতলা মামলার ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপ ধ্বংস করে শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দিকে মুক্ত করতে না পারব, ততদিন আন্দোলন চলবে। স্বৈরশাসক আইয়ুব-মোনায়েমশাহীর পতন না ঘটিয়ে বাংলার ছাত্রসমাজ ঘরে ফিরবে না।’ মুহূর্তে ফুঁসে উঠল মিছিল! কোথায় ১৪৪ ধারা! লাখ মানুষের ঢল নেমে আসে রাজপথে। শেষে প্রায় দশ হাজার ছাত্রের একটি বিশাল মিছিল ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে রাজপথে পা বাড়ায়। মিছিলটি চানখার পুলের নিকটে তখনকার পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি এলে এর ওপর পুলিশ হামলা চালায়। প্রায় ঘণ্টাখানেক সংঘর্ষ চলার পর আসাদসহ কয়েকজন ছাত্রনেতা মিছিলটিকে ঢাকা হলের পাশ দিয়ে শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ছাত্রনেতারা স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে সেøাগান দিতে দিতে এগিয়ে গেলে একজন পুলিশ কর্মকর্তা খুব কাছ থেকে রিভলবার দিয়ে আসাদকে লক্ষ্য করে গুলি করে। গুরুতর আহত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ আসাদকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আসাদের এই মৃত্যুর খবর পেয়েই তার সহযোদ্ধারা সেখানে ছুটে যান। তাদের জানানো হয়, ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার কারণে তাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়েছে। মিছিলের প্রথম সারিতেই তিনি ছিলেন। আসাদের রক্তাক্ত শার্ট নিয়ে ছাত্র নেতৃবৃন্দ সমবেত হন শহীদ মিনারে। সেখানে এক বিক্ষোভ সমাবেশ শেষে বিক্ষুব্ধ শোকার্ত ছাত্র-জনতার শোক মিছিল বের হয়। পুলিশ ও ইপিআরের হুঁশিয়ারি সতর্কতা উপেক্ষা করে রক্তাক্ত লাল পতাকা নিয়ে মিছিল মিলিত হয় পল্টন ময়দানে। সেখানেও লক্ষাধিক মানুষ অপেক্ষায়। পল্টন লোকে লোকারণ্য। সেখানে আসাদ হত্যার প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম কমিটি গোটা পূর্ব পাকিস্তানে হরতালসহ তিন দিনব্যাপী শোকের কর্মসূচি ঘোষণা করে। আসাদের এই মৃত্যুর খবর দ্রুত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং আন্দোলনের পরিবেশকে উত্তপ্ত করে তোলে। পরবর্তী চার দিন হরতাল প্রতিবাদ মিছিলসহ নানা কর্মসূচী পালিত হয়। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা দাবির সপক্ষে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আসামিদের মুক্তি দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন চলছিল। সেই অবস্থায় আসাদের মৃত্যু সবাইকে নাড়িয়ে দেয়। যা পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৪ রাজবন্দির জেল থেকে মুক্তির মধ্যদিয়ে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি শাসকগোষ্ঠীর বঞ্চনা ও শোষণ কমিয়ে উন্নয়ন দেখানোর উদ্দেশে ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবনকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপনে আইয়ুব অ্যাভিনিউ ও আইয়ুব গেট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শাসক লৌহমানব আইয়ুবের পতন ঘটলে ‘আইয়ুব অ্যাভিনিউ’ রূপান্তরিত হয় ‘আসাদ অ্যাভিনিউ’য়ে ও ‘আইয়ুব গেট’ ‘আসাদ গেট’ হিসেবে পরিণত হয়। আইয়ুব শাহীর বুলেটে প্রাণ দিয়েছিলেন আসাদ। এই মৃত্যু বাংলার জনগণের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে গণআন্দোলনের প্রথম শহীদ হিসেবে। শীতের শেষে নতুন বছরের আমেজ লাগানো এ দেশের মাটি মেঘমুক্ত নীল আকাশ থেকে অকস্মাৎ বাজ পড়ার মতোই অভাবনীয় ছিল আসাদের মৃত্যু। মৃত্যুর পর গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার ধানুয়া গ্রামে তাকে সমাহিত করা হয়। নিজ বাড়ির বকুলতলায় চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন শহীদ আসাদ। সেখানে তার নিকটাত্মীয়দের কেউ থাকেন না। ফলে তার কবরটি এখন অযতœ আর অবহেলায় পড়ে আছে। শিবপুরে আসাদের নামে একটি কলেজ থাকায় সাধারণ মানুষের কাছে নামটি পরিচিত। তবে তাকে নিয়ে যে একটি দিবস রয়েছে, তা বেশির ভাগ মানুষের অজানা। এর জন্য রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক নেতাদের উদাসীনতাকে দায়ী বলে মনে করেন তার এলাকার মানুষ।