একই ছাদের নিচে দুই নারী: দ্বন্দ্ব নয়, সহাবস্থান

বাংলার ঘরোয়া সংস্কৃতিতে শাশুড়ি ও বউমার টানাপোড়েন,অবিশ্বাস,প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও একধরনের কর্তৃত্বপ্রবণতার ঐতিহাসিক সম্পর্ক প্রতীক হয়ে উঠেছে। যা একটি পুরাতন সমাজব্যবস্থার প্রতি ফলন যেখানে নারীদের পরস্পরের প্রতিযোগী হিসেবে দেখা হতো, বিশেষ করে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে সীমিত সম্পদ ও ক্ষমতার ভাগ-বাঁটোয়ারাকে ঘিরে। যেন এটি চিরন্তন এক ক্ষমতার লড়াই। অথচ সময় বদলেছে, সমাজ বদলেছে। সহমর্মিতা, সমতা ও পারস্পরিক মর্যাদা যেখানে মূল্যবোধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।সেখানে আমরা আর পিছনে ফিরে যেতে চাই না, সবাই কে মানুষ ভেবে যোগ্য সম্মান দিয়ে ঘরে তথা সমাজে শান্তি ফিরিয়ে আনতে চাই। শাশুড়ি ও বউমার সম্পর্ক প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, সহযোগিতার হতে পারে। উভয়েই নারী, উভয়েই কোনো না কোনো সময়ে কন্যা, পুত্রবধূ ও মা। এই অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে সহানুভূতি ও সহমর্মিতা গড়ে তোলা দরকার। অনেক সময় শাশুড়ি মনে করেন তিনি ‘ক্ষমতার কেন্দ্র’ এবং বউকে নিয়ন্ত্রণ করা তাঁর দায়িত্ব। আবার অনেক সময় বউ শাশুড়িকে হুমকি ভাবেন। এর বদলে পারস্পরিক মর্যাদা, ব্যক্তিগত সীমারেখা ও স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। বিভ্রান্তি, গুজব, মনোকষ্ট — অনেক সমস্যা সৃষ্টি করে। খোলামেলা, ভদ্র ও সততার সঙ্গে কথা বলার অভ্যাস তৈরি করলেই সম্পর্ক সুস্থ হয়। প্রতিটি মানুষই আলাদা — আলাদা মানসিকতা, অভিজ্ঞতা ও স্বপ্ন নিয়ে সে জীবনযাপন করে। সম্পর্কের শুরুতেই যদি আমরা কল্পনার জগৎ ছেড়ে বাস্তব মানুষটিকে বোঝার চেষ্টা করি, তবে অনেক জটিলতা দূর হয়ে যায়। পুরনো আমলের নেগেটিভ গল্প ছেড়ে নিজেদের জীবনের ছোটখাটো সুন্দর স্মৃতি ভাগাভাগি করুন। এতে সম্পর্কের ভিত শক্ত হয়, আর বয়সের ব্যবধান সেতুতে রূপ নেয়। স্বামী বা ছেলে যেন কেবল “মাঝখানে পড়ে যাওয়া মানুষ” না হন। বরং তিনি যেন সক্রিয়ভাবে দুই প্রজন্মের মধ্যে বোঝাপড়া গড়ে তুলতে সাহায্য করেন। তাঁর নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি প্রায়শই জট খুলে দিতে পারে। স্বামী বা ছেলে অনেক সময় এই দ্বন্দ্বে নিষ্ক্রিয় থাকে, কিংবা পক্ষ নেয়, যা পরিস্থিতি খারাপ করে। বরং তাঁদের উচিত হতে হবে যোগাযোগকারী, ভারসাম্য রক্ষাকারী ও দু’পক্ষকে সম্মান দেখানোর মধ্যস্থতা হওয়া। বউ শুধু একজন “পুত্রবধূ” নয়,বা বউমা শুধুমাত্র পরিবারের “নতুন সদস্য” নন, তিনি একজন পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তি মানুষ। যিনি ভালোবাসা,স্বীকৃতি ও নিরাপত্তা চান। তেমনি একজন শাশুড়িও শুধুই “মা” নন, তিনি নিজস্ব জীবন-দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একজন অভিজ্ঞ নারী। দুজনেরই ব্যক্তিগত সীমারেখা মেনে চলা সম্মানের প্রথম ধাপ।একে অপরের এই ভিন্ন পরিচয়কে সম্মান জানানো জরুরি। পরিবার যেন কেউ কারও অধীন নয়। সিদ্ধান্তগুলো যেন আলোচনার মাধ্যমে হয়, সেখানে বউয়ের মতামত যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি শাশুড়ির অভিজ্ঞতাও। এতে কেউ একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। শাশুড়ি ও বউমার সম্পর্ক প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, সহযোগিতার হতে হবে। উভয়েই নারী, উভয়েই কোনো না কোনো সময়ে কন্যা, পুত্রবধূ ও মা। এই অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে সহানুভূতি ও সহমর্মিতা গড়ে তোলা জরুরি। এমন অনেক শাশুড়িকে দেখা গেছে তার ছেলে বা মেয়ের সন্তানদেরকে খুব আদর করে আগলে রাখে। মৌলিক শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা, প্রাথমিক হাতে খড়ি শিক্ষাগুলো অনেক দাদী তার নাতিদেরকে দিয়ে থাকেন। কেননা সে তার ছেলেকে যদি সঠিক শিক্ষায় মানুষ করতে পারেন তাহলে তার নাতিদের পারবে না কেন? এই ক্ষেত্রেও আধুনিক বৌমারা শ্বাশুড়ীকে এমন কথা বলে থাকে, আপনি ওল্ড মডেল আপনি সন্তান মানুষ করতে জানেন না। বর্তমানে নারীরা শিক্ষিত হচ্ছে। দাদী বা নানীরাও শিক্ষিত। বৌমারাও আধুনিক এবং শিক্ষিত। এখন অনেক পরিবর্তন দেখতে চাই। তারপরও এক নারী আরেক নারীকে সহ্য করতে না পারার কারণ- পারিবারিক শিক্ষার অভাব। এটা আমাদের সমাজ থেকে দূর করতে হবে। অনেক সময় শাশুড়ি মনে করেন তিনি ‘ক্ষমতার কেন্দ্র’ এবং বউকে নিয়ন্ত্রণ করা তাঁর দায়িত্ব। আবার অনেক সময় বউ শাশুড়িকে হুমকি ভাবেন।যেহেতু দুই জন দুই প্রজন্মে মতভেদ হতেই পারে। কিন্তু সেই মতভেদকে ঝগড়া না বানিয়ে যদি আলোচনা, সহিষ্ণুতা ও ক্ষমার মাধ্যমে মোকাবিলা করা যায়, তাহলে সম্পর্ক আরও গভীর হয়। তাই পারস্পরিক মর্যাদা, ব্যক্তিগত সীমারেখা ও স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। শ্বাশুড়ী ও বৌমার মধ্যে বিরূপ মনোভাব বা দ্বন্দ্বের পেছনে সাধারণত কিছু নির্দিষ্ট কারণ কাজ করে। এগুলো ব্যক্তিত্ব, সংস্কৃতি, প্রত্যাশা বা পারিবারিক গতিশীলতার (Family Dynamics) সাথে জড়িত। বৌমাকে "পরিপূর্ণ গৃহবধূ" বা "আদর্শ পুত্রবধূ" হিসেবে দেখার চাপ দেন।নিজের মতো করে সব কাজ করতে চাইলে তা নিয়ে অসন্তুষ্টি।পুত্রের প্রতি বৌমার ভালোবাসা বা মনোযোগ নিয়ে ঈর্ষা বা অস্বস্তি।শ্বাশুড়ীর অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ বা হস্তক্ষেপকে স্বাধীনতায় বাধা মনে করা।"আধুনিক" ও "প্রথাগত" জীবনযাপনের ধারণার সংঘাত। সরাসরি ও স্পষ্ট যোগাযোগ না থাকলে ছোট বিষয়ও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। শব্দচয়ন বা ভাবভঙ্গিতে অনিচ্ছাকৃত আঘাত লাগতে পারে (যেমন: "আপনার রান্নায় নুন কম!" বলাকে সমালোচনা মনে হওয়া)। সাংস্কৃতিক ও মূল্যবোধে মিল না থাকা (যেমন: পোশাক, চাকরি, সন্তান লালন-পালন পদ্ধতি)। শ্বাশুড়ী রক্ষণশীল, বৌমা আধুনিক—এটি সাধারণ সংঘাতের কারণ। পরিবারের অন্য সদস্য (যেমন: ননদ, দেবর) যদি ইতিবাচক ভূমিকা না রাখে বা উসকানি দেয়। এমনকি পাড়া-প্রতিবেশীর কথায় প্রভাবিত হয়ে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে থাকে। উভয় পক্ষের সমঝোতা,ছোটখাটো বিষয় নিয়ে জেদ না করা।সীমানা নির্ধারণ করে একে অপরের ব্যক্তিগত স্থান সম্মান করা। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে খারাপের বদলে ভালো দিকগুলো খুঁজে দেখা। তৃতীয় পক্ষের সাহায্যে প্রিয়জনের মধ্যস্থতা বা কাউন্সেলিং নেওয়া। টেলিভিশন নাটক বা সিনেমা প্রায়শই এই সম্পর্ককে বিষাক্ত ও সংকটপূর্ণভাবে তুলে ধরে। অথচ ইতিবাচক উদাহরণও প্রচুর রয়েছে। আমরা যদি এমন কন্টেন্টকে উৎসাহ দিই, যেখানে নারী-নারীর সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ, তাহলে সমাজেও পরিবর্তন আসবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বিপ্লবী টিপস হলো – শাশুড়ি ও বউ যদি একে অপরকে সহযোগী ও মিত্র হিসেবে দেখেন। এই বন্ধন পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে এবং পরিবারে নারীর মর্যাদা আরও মজবুত করে তোলে। এই দ্বিমুখী সংস্কারের সূচনা পরিবারের ভিতর থেকেই করতে হবে। পরিবার সমাজের সবচেয়ে ক্ষুদ্র অথচ সবচেয়ে শক্তিশালী ইউনিট। এই ছোট পরিসর থেকেই যদি আমরা দৃষ্টিভঙ্গি বদলাই, মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখি, মর্যাদার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তুলি — তাহলে সমাজে পরিবর্তন আসবেই। শাশুড়ি ও বউ, দুটি প্রজন্মের এই দুই নারী যদি একসাথে পথ চলেন, তাহলে পুরনো দ্বন্দ্ব নয়, নতুন বন্ধুত্বের গল্পই হবে ভবিষ্যতে।