নিউইয়র্কে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিকবৃন্দের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় উপলক্ষে মান্যবর রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি জনাব মোহাম্মদ আব্দুল মুহিতের বক্তব্য

১৮ জানুয়ারি, ২০২৩ | ৫:২৪ অপরাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
শুভ সন্ধ্যা ।
সবাইকে ইংরেজি নববর্ষ ২০২৩ এর শুভেচ্ছা। শুরুতেই আমি আপনাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই আজকের এই অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ সাদরে গ্রহণ করার জন্য এবং আপনাদের সদয় উপস্থিতির জন্য। আমি বিগত আগস্ট ২০২২ এই মিশনে স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করার পর এটাই আপনাদের সাথে আমার প্রথম আনুষ্ঠানিক মতবিনিময় সভা। আজকের এই সন্ধ্যায় আমি মিশনের বিগত ১ বছরের উল্লেখ্যযোগ্য কার্যক্রম তুলে ধরব এবং ২০২৩ সালে আমাদের পরিকল্পনা নিয়ে আপনাদের সাথে কথা বলব। এরপর আপনাদের সুচিন্তিত পরামর্শ, মতামত ও মন্তব্য শুনব। ২০২২ সালে জাতিসংঘে মিশনের কার্যক্রম: ২০২২ সালটি আমাদের জন্য অত্যন্ত কর্মমূখর একটি বছর ছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ , জলবায়ু পরিবর্তন, করোনা মহামারিসহ অন্যান্য বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মুখে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ ও অন্যান্য সংস্থাসমূহ বিশ্বের সকল মানুষের দুঃখ-দুর্দশা কমিয়ে, ভবিষ্যতে সকলের জন্য টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতের লক্ষ্যে কাজ করে গেছে। এসকল বৈশ্বিক ইস্যুতে এবং জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় অবস্থান নেয়ার পাশাপাশি রোহিঙ্গা ইস্যু, টেকসই উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, নারীর ক্ষমতায়ন, জাতিসংঘে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমসহ আমাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে আমাদের মিশন সরব ছিল। প্রথমত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ। আপনারা জানেন, ২০২২ সালের ১৮-২৫ সেপ্টেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে অংশগ্রহণ করে। এটা আমাদের জন্য বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম সময়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের জন্য আমাদের বিভিন্ন ধরনের বৈঠক সংক্রান্ত প্রস্তুতি নিতে হয়। এছাড়া সফর সংক্রান্ত অন্যান্য কার্যাবলীও সম্পাদন করতে হয়। এবারের অধিবেশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ অত্যন্ত সফল ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সাধারণ বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন এবং বরাবরের মত বাংলায় বক্তব্য প্রদান করেন। এ সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেশ কয়েকটি উচ্চ পর্যায়ের সভায় অংশগ্রহণ করেন। যেমন: জাতিসংঘের ৭৭তম অধিবেশনের সভাপতির আমন্ত্রণে বিশ্বের নারী নেতৃবৃন্দের অংশগ্রহণে আয়োজিত উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক; বিশ্বব্যাপী খাদ্য, জ্বালানী ও আর্থিক সংকটের প্রেক্ষাপটে গঠিত গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স গ্রুপ (জিসিআরজি) এর উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক; এন্টি-মাইক্রোবিয়াল রেসিসটেন্স বিষয়ে “ওয়ান হেল্থ গ্লোবাল লিডার্স গ্রুপ অন এএমআর” শীর্ষক গ্রুপের বৈঠক; বাংলাদেশ, বতসোয়ানা, স্লোভাক রিপাবলিক এবং ইউএন হ্যাবিট্যাটের যৌথ আয়োজনে টেকসই আবাসন বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের সাইড ইভেন্ট; বাংলাদেশ মিশন আয়োজিত রোহিঙ্গা বিষয়ক একটি হাই লেভেল সাইড ইভেন্ট। এছাড়াও এবারের জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন চলাকালে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এর মধ্যে রয়েছে জাতিসংঘের মহাসচিব, স্লোভেনিয়ার রাষ্ট্রপতি, ইকুয়েডরের রাষ্ট্রপতি, কসোভোর রাষ্ট্রপতি, কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী, জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর, ইউএন হ্যাবিট্যাট-এর নির্বাহী পরিচালক, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার মহাপরিচালক, জাতিসংঘের এলডিসি বিষয়ক হাই রিপ্রেজেনটেটিভ, মেটা’র গ্লোবাল এফেয়ার্স প্রেসিডেন্ট এবং ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের নির্বাহী চেয়ারম্যান। এ সকল দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পারস্পরিক ও বৈশ্বিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন।
-০২- দ্বিতীয়ত, আসি সারা বছরব্যাপি আমাদের অন্যান্য কার্যক্রম প্রসঙ্গে।
[ক] রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানকল্পে মিশনের কার্যক্রম: ২০২২ সালে মিশনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আমাদের নিরলস কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। রাশিয়া ও ইউক্রেণ যুদ্ধ, আফগানিস্তান সংকটসহ অন্যান্য বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মুখেও আমরা আমাদের অব্যাহত প্রচেষ্টার মাধ্যমে জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে এ বিষয়টি আলোচনায় রেখেছি। সাধারণ পরিষদে এবার আমরা গতবছরের চাইতেও জোরালো একটি রেজুল্যুশন এনেছি যা বিপুল সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত হয়েছে। রেজুল্যুশনটি ১০৯ টি দেশ কো-স্পন্সর করেছে যা ২০১৭ সাল থেকে এ যাবত সর্বোচ্চ। বিগত ২১ ডিসেম্বর ২০২২ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে প্রথমবারের মত “মিয়ানমারের পরিস্থিতি” বিষয়ক একটি রেজুল্যুশন গৃহীত হয়। মিয়ানমারের বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, জরুরি অবস্থা, বন্দি মুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া হয়। রেজুল্যুশনটির উপর ভোট আহবান করা হলে তা ১২-০ ভোটে অনুমোদিত হয়। উল্লেখ্য, এই প্রস্তাবনার বিপক্ষে কোন সদস্য ভোট দেয়নি অথবা কোন স্থায়ী সদস্য ভেটো প্রদান করেনি। বলা বাহুল্য, এই রেজুল্যুশনটি রোহিঙ্গা বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থানের প্রতি জাতিসংঘের সবচেয়ে ক্ষমতাধর অঙ্গটির শক্তিশালী সমর্থনেরই বহিঃপ্রকাশ। রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটসহ অন্যান্য বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষাপটে গৃহীত রেজুল্যুশনটি রোহিঙ্গা সংকটের প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আরো সুসংহত করতে সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়। রেজুল্যুশনটিতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়, নিরাপত্তা ও মানবিক সহযোগিতা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করা হয়। পরিষদ রোহিঙ্গা সঙ্কটের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে তাদের নিরাপদ, টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবসনের নিমিত্ত অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে আহবান জানায়। মিয়ানমারের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা যে রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ বাসভূমি মিয়ানমারে প্রত্যাবসনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করবে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলবে, সে বিষয়টি দৃঢ়ভাবে তুলে ধরা হয়। এছাড়া, এ সমস্যার সমাধানে আসিয়ানের সদস্য রাষ্ট্রসমূহের ২০২১ সালে গৃহীত পাঁচ দফা ঐক্যমত্যের দ্রুত ও পূর্ণ বাস্তবায়নের উপর গুরুত্বারোপ করা হয় এবং এর বাস্তবায়নে জাতিসংঘের কোন সহযোগিতার প্রয়োজন হবে কিনা সে বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব এবং মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূতকে আগামি ১৫ মার্চ ২০২৩ তারিখের মধ্যে নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রতিবেদন পেশ করার জন্য অনুরোধ করা হয়। জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন রেজুল্যুশনটিতে বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
[খ] জাতিসংঘের রেজুল্যুশনে জাতির পিতার মহান উক্তি "সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়” সন্নিবেশিত করা হয়: বিগত ০৬ ডিসেম্বর ২০২২ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি রেজুলেশন সন্নিবেশন করা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ও মহান উক্তি “সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়" যা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির মূল ভিত্তি। বিশ্বমানবতা ও বিশ্বশান্তির অন্যতম প্রবক্তা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক উক্তিটি এবারই প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ রেজুল্যুশনে সন্নিবেশিত হলো।
-০৩- [গ] শান্তিরক্ষা কার্যক্রমঃ আগের বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালেও বাংলাদেশ সেনা/পুলিশ সরবরাহকারী দেশগুলোর মধ্যে প্রথম অবস্থানে ছিল। বর্তমানে আমাদের শান্তিরক্ষীর সংখ্যা ৭৩৭০ জন। আমাদের এ অবস্থান বাংলাদেশের বৈশ্বিক ইমেজ এবং আমাদের শান্তিরক্ষীদের উপর জাতিসংঘের গভীর আস্থারই স্বীকৃতি। সাউথ সুদান এর আবেয়ি (Abeyi)-তে আমরা গত বছর হতে শান্তিরক্ষী পাঠানো শুরু করেছি। আমাদের নারী শান্তিরক্ষীদের সংখ্যা ক্রমান্বয়েই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের শান্তিরক্ষীদের সার্বিক কার্যক্রমের গুণগত মান বৃদ্ধির পাশাপাশি মিশনের এ সংক্রান্ত কার্যক্রম বাংলাদেশকে প্রথম অবস্থান বজায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ২ জন ডেপুটি ফোর্স কমান্ডার, ৪ জন সেক্টর কমান্ডার ও ০১ জন চীফ অব স্টাফ পদে অধিষ্ঠিত আছেন। বাংলাদেশ উইমেন পিস এন্ড সিকিউরিটি (WPS) Chief of Defence Network-এর বর্তমান সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে।
[ঘ] আমাদের নেতৃত্ব প্রদানকারী ভূমিকা: ২০২২ সালে আমাদের মিশন জাতিসংঘের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা/বোর্ডের সভাপতিসহ অন্যান্য দায়িত্ব পালন করে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তি-বিনির্মাণ কমিশনের ২০২২ সালের জন্য সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে পিস বিল্ডিং কমিশনের সদস্য। বাংলাদেশ ২০২২ সালে জাতিসংঘ উইমেন এর নির্বাহী বোর্ডের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে। উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশ জাতিসংঘ উইমেন এর নির্বাহী বোর্ডের একজন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন পর্যালোচনা ফোরামের অগ্রগতি ঘোষণাটি প্রথবারের মতো ২০২২ সালের মে মাসে জাতিসংঘে গৃহীত হয় এবং বাংলাদেশ লুক্সেমবার্গের সাথে এ প্রক্রিয়ার নেগশিয়শনে কো-ফ্যাসিলিটেটর এর দায়িত্ব পালন করে। ১৭ মার্চ ২০২২ তারিখে স্বল্পোন্নত দেশগুলির জন্য জাতিসংঘে ২০২২-২০৩১-এই একদশকব্যাপী দোহা কর্মসূচী (DPOA) গৃহীত হয় । বাংলাদেশ কানাডার সাথে LDC5 সম্মেলনের প্রস্তুতি কমিটির সহ-সভাপতিত্ব করে এবং দোহা কর্মসূচি প্রণয়নে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে।
[ঙ] জাতিসংঘ এবং এর বিভিন্ন সংস্থার নির্বাচন: বাংলাদেশ গত বছর জাতিসংঘের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংস্থায় নির্বাচিত হয়েছে। হিউম্যান রাইটস্ কাউন্সিল এ ২০২৩-২৫ মেয়াদে নির্বাচনে জয়লাভ এর মধ্যে অন্যতম। এছাড়াও বাংলাদেশ বর্তমানে কমিশন অব স্টাটাস অব উইমেন -এ ২০১৯-২০২২ মেয়াদে এবং ইউনিসেফ ও ইউএন উইমেন এর নির্বাহী বোর্ড এ ২০১৯-২০২১ মেয়াদে সদস্য। গত বছর বাংলাদেশ জাতিসংঘে শান্তি বিনির্মাণ কমিশনে ২০২৩-২৪ মেয়াদে পুন: নির্বাচিত হয়েছে। এছাড়াও জাতিসংঘের UNDP/UNFPA/UNOPS এর নির্বাহী বোর্ডের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছি। এটি বহুপাক্ষিক কুটনীতিতে একটি দায়িত্ববান দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উপর বিশ্বসম্প্রদায়ের আস্থারই প্রতিফলন। বাংলাদেশ এ বছর ৫ম বারের মতো জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে নির্বাচিত হয়েছে। আফ্রিকা ও এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে ৪টি শূন্য আসনের বিপরীতে ৭টি দেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, যা স্মরণকালে মানবাধিকার কাউন্সিলের সর্বোচ্চ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন। এই ৭টি প্রার্থী দেশ হল - আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, বাহরাইন, মালদ্বীপ, দক্ষিণ কোরিয়া, কিরঘিজিস্তান ও ভিয়েতনাম। আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও প্রচারণায় এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে সর্বোচ্চ ১৬০টি ভোট পেয়ে বাংলাদেশ নির্বাচিত হয়।
-০৪- [চ] জাতিসংঘে শান্তির সংস্কৃতি বিষয়ক রেজুলেশন ও এ সংক্রান্ত উচ্চ পর্যায়ের সভায় নেতৃত্ব প্রদান: জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রবর্তিত একটি বার্ষিক ফ্লাগশীপ রেজুলেশন হল শান্তির সংস্কৃতি। বাংলাদেশ ১৯৯৯ সালে সর্বপ্রথম এটি জাতিসংঘে প্রবর্তন করে । সেই থেকে বিগত ২৩ বছর ধরে এটি প্রতি বছর জাতিসংঘে উত্থাপিত হয় এবং বিপুল সংখ্যক সদস্য রাষ্ট্রের কো-স্পন্সরশিপ ও সমর্থনে অনুমোদিত হয়। সদস্য রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক এই রেজুলেশনের বিভিন্ন দায়বদ্ধতা বাস্তবায়নের ফলো-আপ হিসেবে প্রতিবছর সাধারণ সাধারণ পরিষদে এ সংক্রান্ত একটি উচ্চ পর্যায়ের সভা আহবান করা হয়। অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও জাতিসংঘে ৭ই সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে একটি উচ্চ পর্যায়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।
[ছ] জাতিসংঘ সদর দপ্তরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন: আমরা গত বছর ৫ম বারের মত জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ভাষা শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠান আয়োজন করি। এতে সাধারণ পরিষদের সভাপতি বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্রের কুটনীতিক, জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ের নেতৃবৃন্দ, UNESCO এবং বিভিন্ন ভাষার প্রতিনিধিত্বকারী উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিগণ অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া, সারা বছরব্যাপী বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য জাতীয় দিবসগুলো যেমন- ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ, জাতীয় শিশু দিবস, জাতীয় গণহত্যা দিবস, মহান স্বাধীনতা দিবস, জাতীয় শোক দিবস, মহান বিজয় দিবস যথাযথ মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যে পালন করেছি। [জ] জনকূটনীতি: বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন বিশ্ববাসীর নিকট তুলে ধরার জন্য এবং আমাদের জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখতে আমরা বছরব্যাপি জাতিসংঘে আমাদের বিভিন্ন প্রাধিকার বিষয় যেমন: অভিবাসন. অটিজম, গণহত্যা, এসডিজি বাস্তবায়ন, তথ্যে প্রবেশাধিকার, সৃজনশীল সরকারি সেবা প্রদান, সমুদ্র সম্পদের সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার নিয়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং খ্যাতনামা থিঙ্ক ট্যাঙ্কদের সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন ইভেন্ট আয়োজন করেছি।
[ঝ] মিডিয়ার সাথে সম্পর্ক: আমরা বছরব্যাপি চেষ্টা করেছি জাতিসংঘে আমাদের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম, অবদান বা অর্জনকে আপনাদের নিকট পৌঁছাতে বা সেগুলো আপনাদের দ্বারা কাভার করাতে। আমাদের পক্ষ থেকে যোগাযোগ আরও বৃদ্ধির জন্য আমরা এ বছরও সচেষ্ট থাকবো। আমরা এ বিষয়ে আপনাদের সহযোগিতা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি এবং আরও বেশী সহযোগিতা পাবার আশা রাখছি। ২০২৩ সালে মিশনের কার্যক্রমের পরিকল্পনা : ২০২২ সালের ন্যায় ২০২৩ সালে আমাদের মিশন বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণে সদস্য রাষ্ট্রসমূহের সাথে জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে কাজ করে যাবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ২০২৩ সালেও জাতিসংঘের কাজকে প্রভাবিত করবে বলে ধরে নেয়া যায়। এ যুদ্ধের সমাধানে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ এবং নিরাপত্তা পরিষদ ব্যস্ত থাকবে বলে প্রতিয়মান হয়। সাধারণ পরিষদ এবং নিরাপত্তা পরিষদে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রস্তাবনা আসতে পারে । আমাদের সরকারের এ বিষয়ে নীতিগত অবস্থান রয়েছে। আমরা সরকারের সেই নীতিগত অবস্থান থেকে এ বিষয়ে জাতিসংঘে কাজ করে যাব। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে সাধারণ পরিষদ এবং নিরাপত্তা পরিষদে সক্রিয় থাকব। এতদিন নিরাপত্তা পরিষদে এ সংক্রান্ত কোন রেজুল্যুশন ছিলনা । সম্প্রতি একটি রেজ্যল্যুশেন গৃহীত হয়েছে। আমরা নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশসমূহের সঙ্গে একযোগে এ রেজুল্যুশনের বিভিন্ন শর্তাদি যাতে মিয়ানমার এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলো বাস্তবায়ন করে, সে বিষয়ে কাজ করে যাব। এ বিষয়ে ওআইসি, আসিয়ান ও ইইউ-এর সাথে আমাদের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।
-০৫-
আপনারা জানেন, ২০২৩ সালের জুলাই মাসে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন অভিষ্ঠ লক্ষ্য শীর্ষক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া এ বছরের সেপ্টেম্বর বিশ্ব নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে ২য় এসডিজি রিভিউ সামিট অনুষ্ঠিত হবে। আমাদের মিশন বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের এ বৈঠকসমূহে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণের সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করবে। জাতিসংঘ উন্নয়ন অভিষ্ঠ লক্ষ্য অর্জনে বছরব্যাপি অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের সাথে একযোগে কাজ করে যাব। করোনা মহামারি ও অন্যান্য বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের কারণে সারা বিশ্বব্যাপী শিক্ষা-ব্যবস্থায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা আরো গভীরভাবে অনুভূত হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণা কাজে লাগিয়ে জাতিসংঘের উন্নয়ন অভিষ্ঠ লক্ষ্য অর্জনগুলোকে আরো কিভাবে ত্বরান্বিত করা যায় সে বিষয়ে জাতিসংঘের অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের সাথে কাজ করে যাব। জলবায়ু পরিবর্তন, নারীর ক্ষমতায়ন, জনস্বাস্থ্য, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ দমন, দারিদ্র্য দূরীকরণ, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, পানি নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা, সমুদ্র আইন, পরিবেশ সংরক্ষণ, অভিবাসন সংক্রান্ত বৈশ্বিক বিষয়গুলোতে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান তুলে ধরব এবং সংরক্ষণে কাজ করে যাব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতিসংঘে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অর্জনগুলো তুলে ধরার উদ্যোগ গ্রহণ করব। বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে যে সকল যুগান্তকারী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন সেগুলো বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা অর্জনে কাজ করে যাব। আমরা এখন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ। এ অবস্থান ধরে রাখতে সকল ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করব। এছাড়া, আমাদের শান্তিরক্ষীদের স্বার্থ সংরক্ষণে বহুপাক্ষিক আলোচনায় আমরা আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখব। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি যারা এখানে আশ্রয়ে আছে, তদেরকে দেশে ফেরত নেয়ার জন্য সকল ধরণের সহযোগিতা প্রদান করতে প্রস্তুত থাকব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল জাতিসংঘের ৭৮তম অধিবেশনে যাতে আরও ভালোভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে, সে বিষয়ে এখন থেকেই আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি । এটা অব্যাহত থাকবে। আমরা বিভিন্ন জাতীয় দিবসগুলো, যেমন ভাষা শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, জাতীয় শোক দিবস, বিজয় দিবস ইত্যাদি আপনাদের সকলকে নিয়ে যথাযথ মর্যাদায় পালন করব। ২৫ মার্চ আমাদের জাতীয় গণহত্যা দিবস। এটি আন্তর্জাতিকরণ এখন সময়ের দাবি। আমরা বহুদিন ধরে জাতিসংঘের সাথে এ বিষয়ে কাজ করে আসছি এবং এ বছরও এ বিষয়টি নিয়ে আমরা জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহের সাথে কাজ করে যাব। জাতিসংঘের যে সকল অঙ্গসংস্থা এ বিষয়ে কাজ করে তাদের সাথে সম্পৃক্ত থাকব। এই বছরে আমাদের হাতে সারা বছরের জন্য বেশ কিছু সভা ও বৈঠক রয়েছে। মার্চ ২০২৩-এ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কাতারে “LDC5” সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবেন। নিউইয়র্কে একই মাসের ২২-২৪ তারিখে UN Water Conference হবে। এই সম্মেলনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ সফল করতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করছি আমরা। ফেব্রুয়ারী ২০২৩ এ “Biodiversity Beyond National Jurisdiction” সম্মেলনের চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হবে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ দমনে জাতিসংঘ ২০০৬ সালে “Global Counter Terrorism Strategy” অনুমোদন করেছে। এটা প্রতি দুই বছর পর পর রিভিউ করা হয়। এ বছর মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত নিউইয়র্কে এটা রিভিউ করা হবে।
-০৬-
আগামি ০৬-১৭ মার্চ ২০২৩ তারিখে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে Commission on the Status of Women এর ৬৭তম অধিবেশন বসবে। বাংলাদেশ মিশন এতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে। ২০২৩ সালে আমাদের মিশন বেশ কিছু জাতিসংঘ ভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেবে। তার মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বের কথা আপনাদের কাছে তুলে ধরছি। বাংলাদেশ ২০২৩ সালের জন্য জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)/ জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)/জাতিসংঘ প্রকল্প সেবাসমূহের কার্যালয় (ইউএনওপিএস) এর নির্বাহি বোর্ডের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছে। সহ-সভাপতি হিসাবে বাংলাদেশ জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ এই সংস্থা তিনটির নিয়মিত কার্যক্রমে কৌশলগত দিক-নির্দেশনা দিতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশ ০২ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ থেকে জাতিসংঘ শান্তি বিনির্মাণ কমিশনের সহ-সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করবে এবং এর ফলে ২০২৩ সালেও আমরা বিশ্বব্যাপী শান্তি বিনির্মানে আমাদের ভূমিকা অব্যাহত রাখতে পারব। বাংলাদেশ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮ তম অধিবেশনের তৃতীয় কমিটির সহ-সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করবে। রোহিঙ্গা, মানবাধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন, মাদকদ্রব্য নিরাময়, যুব উন্নয়ন ও শিশু অধিকারের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে এই কমিটি । এই দায়িত্ব গ্রহণের ফলে বাংলাদেশ সদস্য রাষ্ট্রসমূহের কল্যাণে জাতিসংঘের এ সকল কর্মসূচী বাস্তবায়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করার সুযোগ পাবে। বাংলাদেশ ২০২২-২৪ মেয়াদে ইউনিসেফ এর নির্বাহী বোর্ডের সদস্য। আপনারা জানেন, সংস্থাটি সারাবিশ্বে শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করে। একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে ২০২৩ সালে আমরা এই সংস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বের শিশুদের অধিকার রক্ষায় কাজ করার সুযোগ পাব। বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এর ৫০ বছর পূর্তি হবে ২০২৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। আমরা এই উrসব অত্যন্ত জাঁক-জমকভাবে পালনের প্রস্তুতির অংশ হিসাবে ২০২৩ সালের শেষনাগাদ হতে কাজ শুরু করব। সাউথ সাউথ কোঅপারেশনের এই মূহুর্তে মন্ত্রী পর্যায়ের কোন ফোরাম নেই। বাংলাদেশ এ সংক্রান্ত একটি ফোরাম গঠনের জন্য কাজ করে যাবে। রোহিঙ্গা বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের অব্যাহত প্রচেষ্টাকে আরো ত্বরান্বিত করতে আমাদের মিশন আসিয়ান এবং ওআইসির মধ্যে ডায়লগের ব্যবস্থা করবে।