ফ্লাইট কমাচ্ছে বিদেশি এয়ারলাইন্স

১৭ জানুয়ারি, ২০২৩ | ৭:০৭ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

ডলার সংকটে এবার ফ্লাইট গুটিয়ে নিচ্ছে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো। এ সংকটের কারণে টিকিট বিক্রির আয় নিজ দেশে পাঠাতে পারছে না তারা। এতে টিকিটপ্রতি ১৫ থেকে ২০ শতাংশ লোকসান হচ্ছে। ডলার না থাকায় এয়ারক্রাফটের জ্বালানি ক্রয়েও হিমশিম খাচ্ছে তারা। তেল কেনার মূল্য পরিশোধে ডলার বাধ্যতামূলক হওয়ায় সংকট আরও তীব্র হয়েছে। টিকিট বিক্রির ২ হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ আটকে আছে। গত বছরের মার্চ থেকে এই তহবিল পাঠানো যাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট দেশগুলোয়। নিরুপায় বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ফ্লাইট কাটছাঁট শুরু করেছে বেশির ভাগ এয়ারলাইন্স। এমনকি দুটি এয়ারলাইন্স ফ্লাইট পরিচালনা স্থগিতেরও চিন্তাভাবনা করছে। টার্কিশ এয়ারলাইন্স আগে বাংলাদেশ থেকে সপ্তাহে ১৪টি ফ্লাইট পরিচালনা করলেও এখন করছে মাত্র ৭টি। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স সপ্তাহে ১০টির জায়গায় এখন চালাচ্ছে ৭টি। মালিন্দো ও ক্যাথে প্যাসেফিক আগে সপ্তাহে ৫টি ফ্লাইট চালালেও এখন মাত্র ১টি ফ্লাইট চালাচ্ছে। আর কুয়েত এয়ারলাইন্স আগে ১২টি ফ্লাইট চালালেও এখন চালাচ্ছে ১০টি। মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স ইতোমধ্যে বাংলাদেশ থেকে ফ্লাইট পরিচালনা স্থগিতের পরিকল্পনা করছে। বর্তমানে এয়ারলাইন্সটির ৪০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ বাংলাদেশে আটকে আছে। সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইএটিএ) দ্বারস্থ হয়েছে এয়ারলাইন্সগুলো। আইএটিএ এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি দিয়েছে। একইভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্ট অব বাংলাদেশ (আটাব)। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিমান প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী বলেন, শুধু দেশে নয়, ডলার সংকট এখন বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশে ধীরে ধীরে ভালো হচ্ছে। তিনি বলেন, কয়েকটি বিদেশি এয়ারলাইন্স ফ্লাইট কমিয়েছে বলে শুনেছি। তাদের সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা চলছে। আশা করছি, আগামী সিজনে সবার ফ্লাইট আরও বাড়বে। নিয়ম অনুযায়ী বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো বাংলাদেশে যে অর্থ আয় করছে, সেই অর্থ ডলারে রেমিট্যান্স আকারে বিদেশে পাঠানোর কথা। কিন্তু গত বছরের নভেম্বর থেকে এই অর্থ ফেরত পাঠানো একদমই বন্ধ হয়ে গেছে। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ফ্লাইটের সংখ্যা হ্রাস অব্যাহত থাকলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে আন্তর্জাতিক যাত্রী পরিবহণ। এদিকে টিকিট বিক্রির অর্থ অনির্দিষ্টকাল বাংলাদেশে আটকে থাকার কারণে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো এই অর্থের ‘কস্ট অব ফান্ড’ সমন্বয়ে টিকিটের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। এ কারণে হুহু করে বাড়ছে আন্তর্জাতিক গন্তব্যের টিকিটের দাম। সংশ্লিষ্টরা জানান, ডলার সংকটের কারণে বিদেশি এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট কমে গেলে প্রবাসী কর্মী পরিবহণে মারাত্মক অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে। এতে শ্রমিক বিদেশে যাওয়া কমে যাবে এবং প্রবাসী রেমিট্যান্সের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। ধস নামবে পর্যটন খাতে। আটাব নেতারা আগামী কয়েক মাসের মধ্যে টিকিটের মূল্য আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। একই সঙ্গে তাদের আশঙ্কা এভাবে চলতে থাকলে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর ফ্লাইট ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কমে যেতে পারে। আটাব মহাসচিব আবদুস সালাম আরেফ জানান, ডলার সংকটের কারণে এয়ারলাইন্সগুলোর সম্ভাব্য ক্ষতির কারণে অনেকে বাংলাদেশে তাদের ফ্লাইট কমিয়ে আনছে। বাংলাদেশের পরিবর্তে যে গন্তব্যে তাদের মুনাফা বেশি হয়, সেখানে তারা ফ্লাইট চালাচ্ছে। আগামী ৬ মাস থেকে ১ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর ফ্লাইটের সংখ্যা ৭৫ শতাংশ কমে যাবে। পর্যটনশিল্পের উন্নয়ন ব্যাপক বাধাগ্রস্ত হবে। বাড়বে অভিবাসন ব্যয়। বিশেষ করে পর্যটনশিল্পের অন্যতম চালিকাশক্তি ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসায় ধস নামবে। ইতোমধ্যে ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর টিকিট বিক্রির পরিমাণ ৫০ শতাংশে নেমে গেছে। অনেক এজেন্সি বন্ধও হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ২০২২ সালে সৌদি আরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১১ লাখ ১৮ হাজার ৬২৬ জন নারী ও পুরুষ কর্মী বিদেশে গেছেন। চলতি বছর এই টার্গেট দ্বিগুণ করা হয়েছে। কিন্তু ফ্লাইট কমে গেলে এই টার্গেট হুমকির মুখে পড়বে। টার্কিশ এয়ারের শীর্ষ কর্মকর্তারা সম্প্রতি আটাব নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকে তারা টিকিট বিক্রির আয় নিজ দেশে পাঠাতে সৃষ্ট জটিলতা দ্রুত নিরসনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। অন্যথায় টার্কিশ এয়ারের ফ্লাইট বন্ধ করে দেবেন বলেও তারা জানিয়েছেন। আটাব নেতারা জানান, টিকিটের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিদেশগামী কর্মীরা চড়া সুদে ঋণ এবং ভিটেমাটি, গবাদি পশু বিক্রি করে অভিবাসন ব্যয় জোগাচ্ছেন। ৩ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিনিময় হার বাড়িয়ে ১০৩ টাকা ৩৩ পয়সা নির্ধারণ করেছে। এতে বিদেশগামী কর্মী ও ওমরাহ যাত্রীদের প্রতি টিকিটের দাম ৩ হাজার ৪২০ টাকা বেড়ে গেছে। ২ জানুয়ারি পর্যন্ত ডলারের বিনিময় হার ছিল ৯৯ টাকা ৯১ পয়সা। এছাড়া আগে এয়ারলাইন্সগুলো যখন টিকিট বিক্রি করেছে, তখন ডলারের রেট ছিল ৮৫ থেকে ৯৮ টাকা। সেই ডলার এখন ১০৭ থেকে ১১৫ টাকা। ১৫ শতাংশের বেশি অর্থ তারা এখানেই লোকসান দিয়েছে। তার ওপর অর্থ বিদেশে নিতে না পারায় এখন তারা নিরুপায়। জানা যায়, নয় মাস ধরে এয়ারলাইন্সগুলোর রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ রয়েছে। তাছাড়া শিডিউল ব্যাংকগুলোর নানাবিধ সীমাবদ্ধতার কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা বাংলাদেশ বিমান, বেসরকারি এয়ারলাইন্স ইউএস-বাংলা, সালাম এয়ার, এমিরেটস এয়ারলাইন্স, ইতিহাদ এয়ারলাইন্স, ফ্লাই দুবাই, সাউদিয়া অ্যারাবিয়ান, কাতার এয়ারলাইন্স, কুয়েত এয়ারলাইন্স ও ওমান এয়ারলাইন্স। এই রুটে টিকিটের দাম এখন আকাশচুম্বী। কারণ, ডলারের রেট বেশি এবং ফ্লাইট কমে যাওয়া। ইউরোপের বিভিন্ন গন্তব্যেও এখন টিকিটের দাম দ্বিগুণের বেশি। করোনা-পরবর্তী বিশ্ব পরিস্থিতির মধ্যেও গত এক বছরে জনশক্তি রপ্তানিতে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। বিগত ৯ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গত বছরের জানুয়ারি থেকে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১১ লাখ ১৮ হাজার ৬২৬ নারী-পুরুষ কর্মীর বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে। ৩০ ডিসেম্বর এ সংখ্যা আরও বাড়বে বলে জনশক্তি রপ্তানিকারকরা আশা করছেন। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বেশি অভিবাসী শ্রমিক নেওয়ার দেশ সৌদি আরবের নিয়োগকর্তারা অভিবাসী কর্মী আমদানির ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি ও শর্তহীনভাবে বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। ফলে জনশক্তি রপ্তানির সর্বোচ্চসংখ্যক নারী-পুরুষ কর্মী সৌদিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছেন। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৩ সালে জনশক্তি রপ্তানিতে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হবে বলে মনে করছেন জনশক্তি রপ্তানিকারকরা। সিভিল এভিয়েশন সূত্র জানায়, ২০২১ সালে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সসহ বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো ৩৮ লাখ ৮৩ হাজার ৬৭৬ জন যাত্রী পরিবহণ করেছে। এর মধ্যে ডিপার্চার যাত্রীর সংখ্যা ২০ লাখ ৩৭ হাজার ৯৬৬ জন এবং অ্যারাইভাল যাত্রী ১৮ লাখ ৪৫ হাজার ৭১০ জন। সূত্রমতে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বিমানসহ বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো সর্বমোট যাত্রী পরিবহণ করেছে ৫৮ লাখ ৮৪ হাজার ৪৫০ জন। এর মধ্যে ডিপার্চার ৩২ লাখ ৫৯ হাজার ৩২২ জন এবং অ্যারাইভাল ২৬ লাখ ২৫ হাজার ১২৮ জন। টার্কিশ এয়ারলাইন্স সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সার্ভিস, জেড ফুয়েল কেনা থেকে শুরু করে সব মিলিয়ে বাংলাদেশে ফ্লাইট অপারেশন খরচ অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক। টার্কিশ এয়ারলাইন্সের হেড অব সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং আব্দুস সাত্তার সিদ্দিকী বলেন, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং নিয়ে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর নানা সমস্যা হচ্ছে। পরপর কয়েকটি ফ্লাইট একসঙ্গে অবতরণ করলে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যায়। ঠিকমতো ইকুইপমেন্ট পাওয়া যায় না। ব্যাগেজ লোড-আনলোড মারাত্মক সমস্যা হয়।