জব্দ সম্পদের রক্ষকই ভক্ষক

১৬ জানুয়ারি, ২০২৩ | ৯:০৫ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের জন্য দেশের আর্থিক খাতে আলোচিত নাম প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদার। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কারাবন্দি এই মহাদুর্নীতিবাজ বিদেশে যেমন সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, তেমনি দেশেও আছে অঢেল সম্পত্তি। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে অর্ধশতাধিক মামলা করেছে। অনেক মামলায় দাখিল করা হয়েছে চার্জশিট। আর মামলার প্রয়োজনেই তদন্ত কর্মকর্তা তার স্থাবর-অস্থাবর বিপুল সম্পদ ক্রোক ও জব্দ করেছেন। আদালতের নির্দেশ ছাড়া এসব সম্পদ কারও পক্ষে ভোগ-দখল করার সুযোগ নেই। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্যি, ক্রোক ও জব্দ করা সম্পদ দেখভাল করতে আদালত যাদের দায়িত্ব দিয়েছেন তাদের যোগসাজশে লুটপাটে নেমেছে একটি চক্র। অবস্থাদৃষ্টে দুদক কর্মকর্তারা বলেছেন, রক্ষকই এখন ভক্ষক সেজে ফুলেফেঁপে উঠছেন। এসব সম্পদের হিসাব চেয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছে চিঠিও পাঠিয়েছে দুদক। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। ক্রোকি সম্পত্তি আদালতের নির্দেশ ছাড়া ভোগদখল বা আত্মসাতের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের মুখ্য আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘ক্রোকি বা জব্দ সম্পদ আদালতের অনুমতি ছাড়া কোনো ধরনের নড়চড় করা যাবে না। কেউ এমন করে থাকলে সেটা অপরাধ। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বিষয়টি আদালতের নজরে আনতে হবে।’ দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্তকালে দেশে পিকে হালদারের যেসব সম্পদ পাওয়া গেছে, তার মধ্যে অন্যতম ময়মনসিংহের ভালুকায় অবস্থিত ‘রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড’ নামে দেশের প্রথম কুমির খামার। এই কুমির খামারের স্বপ্নদ্রষ্টা ও অন্যতম অংশীদার ছিলেন লেখক মুশতাক আহমেদ। পরে কৌশলে সেটা হাতিয়ে নিয়েছেন আর্থিক খাতের আলোচিত লোপাটকারী পিকে হালদার। রেপটাইলস ফার্মের নামে আছে ৪০ বিঘা জমি। সেখানে গড়ে তোলা খামারে আছে ছোট বড় তিন হাজারের বেশি কুমির। এই খামারের পাশে আরও আট বিঘা জমি নিজের নামে কেনেন পিকে হালদার। সেখানে গড়ে তোলেন মুরগির ফার্ম। এই ৪৮ বিঘা জায়গার দাম পাঁচ কোটি টাকা। কিন্তু এই জায়গা বন্ধক রেখে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে তিনি ঋণ নিয়েছেন ৫৮ কোটি টাকা। পিকে হালদার ভারতে কারাবন্দি থাকায় এই ঋণ আদায়ের কোনো সম্ভাবনা নেই। জানা গেছে, অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিন তদন্তে প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ায় পিকে হালদারের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। এর আগেই তার মালিকানাধীন ভালুকার এই কুমির ও পোলট্রি খামারের সম্পত্তি ক্রোক করা হয়। জব্দ করা হয় খামারে থাকা তিন হাজার কুমির ও আট হাজার মুরগি। আদালতের নির্দেশ ছাড়া এই খামারের জায়গা ব্যবহার ও মালামাল বেচাকেনা আইনত অবৈধ। এ অবস্থায় কুমির ফার্ম পরিচালনার জন্য হাইকোর্ট ছয় সদস্যের একটি পরিচালনা কমিটি করে দেন। এই কমিটির সদস্যরা (অবৈতনিক) বিনা বেতনে কাজ করবেন বলে জানিয়েছেন হাইকোর্ট। পরিচালনা বোর্ডের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর তারা দেখেন ফার্মের নামে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ৫৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন পিকে হালদার। যা সুদে আসলে ১০০ কোটি ছাড়িয়েছে। যে কারণে পরিচালনা বোর্ড এ খামার নিয়ে আশাবাদী হতে পারেনি। এখন পরিচালনা বোর্ডকে পাশ কাটিয়ে ফার্মের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ কিছু মানুষ খামার ঘিরে নানা ধরনের কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। জানতে চাইলে হাইকোর্ট কর্তৃক গঠিত পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট ড. নাঈম আহমেদ বলেন, ‘ফার্মের মালামাল ও সম্পত্তি দুদকের মামলায় ক্রোক বা জব্দ আছে কিনা-সে তথ্য আমাদের কাছে নেই। এ সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনাও নেই। এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা বা তথ্য আসলে আমরা সেভাবে ব্যবস্থা নিব।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ফার্মের ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্কসহ বিভিন্ন ধরনের কাজের সিদ্ধান্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে এনাম হকই নিয়ে থাকেন।’ অনুসন্ধানে জানা গেছে, হাইকোর্টের নির্দেশে পরিচালনার দায়িত্ব নিলেও কিছু দিনের মধ্যেই অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে যান বোর্ডের বেশির ভাগ সদস্য। এরপর ক্রোক ও জব্দ করা মালামাল লুটপাটে মরিয়া হয়ে ওঠেন চক্রের সদস্যরা। এ কাজে গড়ে ওঠা চক্রের নেতৃত্বে আছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মশিউর রহমান ও ‘রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড’ নামের কুমির খামারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী কুমির বিশেষজ্ঞ এনাম হক। এই দু’জনের যোগসাজশে ক্রোক করা এই সম্পদের ওপর ফের তিন কোটি ২৬ লাখ টাকা ঋণ দেয় ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। ঋণের অর্থ থেকে প্রতি মাসে এক লাখ ৯০ হাজার টাকা বেতন নিচ্ছেন এনাম হক। আর ৫০ লাখ টাকা খরচ করে পিকে হালদারের ক্রোক করা জমিতে (কুমির খামারের ভেতর) আদালতের নির্দেশ ছাড়াই তৈরি করা হয়েছে একটি অডিটরিয়াম। সেখানে চালু করা হয়েছে পর্যটন বাণিজ্য। কুমির খামার পরিদর্শনের জন্য দর্শনার্থী প্রবেশ ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫০ টাকা। এ খাত থেকে আসা মোটা অঙ্কের অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে চক্রের সদস্যরা আত্মসাৎ করছেন। কুমির খামার পরিচর্যার নামে ঋণের বাকি টাকাও আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুদকের মামলার জব্দ তালিকায় খামারে তিন হাজার কুমির থাকার কথা বলা আছে। কিন্তু কুমির খামার পরিচালনার কথা বলে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ঋণ নেওয়ার সময় জমা দেওয়া কাগজপত্রে উল্লেখ আছে দেড় হাজার কুমিরের সংখ্যা। কাগজে-কলমেই দেড় হাজার কুমিরের হদিস নেই। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কাগজে-কলমে মাইনাস করার পর এই দেড় হাজার কুমির এখন গোপনে বিক্রির পাঁয়তারা চলছে। যার বাজার মূল্য আট থেকে ১০ কোটি টাকা। আরও জানা গেছে, দুদকের জব্দ করা পিকে হালদারের ফার্মের আট হাজার মুরগি আদালতের নির্দেশ ছাড়াই ২৬ লাখ টাকা বিক্রি করা হয়েছে। এই টাকাও সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেছেন সিন্ডিকেট সদস্যরা। অথচ ক্রোক ও জব্দ করা সম্পদ আদালতের নির্দেশ ছাড়া বিক্রি এবং ব্যবহারের কোনো নিয়ম নেই। এমনকি মুরগি বিক্রির জন্য ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের বোর্ড সভারও কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত এমডির একক সিদ্ধান্তে এই লুটপাট চলছে। এখানেই শেষ নয়, কুমির খামার সামনে রেখে পিকে হালদারের বিশাল আয়তনের এই ক্রোকি সম্পত্তি দখলে নিয়ে অবৈধভাবে বড় পরিসরে পর্যটন ব্যবসা চালুর পাঁয়তারা করছে একটি চক্র। এই চক্রের ‘হোতা’ ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ভারপ্রাপ্ত এমডি মশিউর রহমান। তার সরাসরি হস্তক্ষেপে ৫০ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি হওয়ার পরও নিয়ম ভেঙে কুমির খামারের নামে ফের প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। যদিও আদালতের নির্দেশে এই ঋণ পাওয়ার দাবি করেছেন পরিচালনা বোর্ডের একজন সদস্য। ঋণের অর্থ থেকে প্রতি মাসে প্রায় দুুই লাখ টাকা বেতন দেওয়া হচ্ছে মসিউর রহমানের লুটপাটের সঙ্গী এনাম হককে। তার পরিকল্পনাতেই পিকে হালদারের ক্রোকি ৪৮ বিঘা জমি দখলে নিয়ে অবৈধ বাণিজ্য চালানোর পাঁয়তারা চলছে। এদিকে রোববার ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর একটি চিঠি পাঠিয়েছেন দুদক উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান। চিঠিতে জানতে চাওয়া হয়েছে, ভালুকায় অবস্থিত রেপটাইলস ফার্মের পাশে পিকে হালদারের জায়গায় অবস্থিত পোলট্রি ফার্মের আট হাজার মুরগির বর্তমান কী অবস্থা, এগুলো কী আদালত কিংবা ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের বোর্ড সভার আদেশে বিক্রি করা হয়েছে? বিক্রি প্রক্রিয়ার সঙ্গে কে কে জড়িত তাদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় ও বিক্রিলব্ধ অর্থ কি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে কিনা তার তথ্য-উপাত্ত জমা দিয়ে বলা হয়েছে চিঠিতে। একই সঙ্গে ফার্মের ভেতর মালিকপক্ষ ব্যতিরেকে তৃতীয়পক্ষ কোনো স্থাপনা নির্মাণ করছে কিনা, স্থাপনা নির্মাণের অর্থ কোথা থেকে আসছে ও কুমির বিক্রির জন্য আদালতের কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়েছে কিনা-সে তথ্যও জানতে চেয়েছে দুদক। এ ব্যাপারে জানতে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। একই নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলতে চেয়ে খুদে বার্তা পাঠালে তিনি সিন করলেও জবাব দেননি। এ ছাড়া বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও এনাম হকের সঙ্গেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।