লঞ্চের ট্রিপ ৬ মাসে কমে অর্ধেক

১৪ জানুয়ারি, ২০২৩ | ৮:৫৭ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

পদ্মা সেতুতে যান চলাচল শুরুর ৬ মাসের ব্যবধানে ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের রুটগুলোতে চলা বেসরকারি লঞ্চের ট্রিপ সংখ্যা কমে প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। সরকারি হিসাবে এসব রুটে যাত্রী কমেছে ২৩-২৫ শতাংশ। আর মালিকদের ভাষ্যমতে, এ হার ৫০ ভাগ। যাত্রী সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে বেশ কয়েকটি রুটের লঞ্চ। ওই লঞ্চগুলো অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বা অলস পড়ে আছে। অনেক লঞ্চ ভেঙে ফেলা হয়েছে। এমনকি সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ করপোরেশনের ঢাকা-বরিশাল-মোড়েলগঞ্জ রুটের যাত্রীবাহী লঞ্চ বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়ে পড়েছেন এসব নৌযানের বিপুলসংখ্যক কর্মী। অনিশ্চয়তায় দিনাতিপাত করছেন এসব শ্রমিকের পরিবারের সদস্যরা। এছাড়া যেসব রুট সচল রয়েছে সেগুলোতেও যাত্রীর অভাবে রোটেশন পদ্ধতিতে লঞ্চ চলছে। এসব কারণে আয়ও কমেছে সরকার ও লঞ্চ মালিকদের। পদ্মা সেতু চালুর আগের ৬ মাসের তুলনায় পরের ৫ মাসে (জুলাই থেকে নভেম্বর) ঢাকা নদীবন্দর থেকেই বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) আয় কমেছে পৌনে এক কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে। লঞ্চ মালিকরা জানান, যাত্রীখরায় তাদের দুরবস্থা চলছে। ৩-৪ দিনেও অনেক লঞ্চ ট্রিপ পায় না। ফলে কর্মচারীদের বেতন দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে। ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৬ জুন থেকে সেতুতে যানবাহন চলাচল শুরু হয়। এতে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে ঢাকার দূরত্ব কমে গেছে। এখন কম সময়ে খুলনা, বরিশাল বিভাগসহ দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর যাত্রীরা ঢাকায় যাতায়াত করতে পারছেন। যাত্রীর অভাবে লঞ্চ মালিকরা বড় সংকটে আছেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ লঞ্চ মালিক সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি ও পারাবত লঞ্চের মালিক মো. শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, লঞ্চ ব্যবসা আগের মতো নেই। খুব দুরবস্থার মধ্যে আছি। লঞ্চে গড় যাত্রী ৬০ শতাংশ কমে গেছে। তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, ঢাকা-বরিশাল রুটে ১৮টি লঞ্চের রুট পারমিট রয়েছে। প্রতিদিন ঢাকা থেকে ৮-৯টি লঞ্চ ছেড়ে যাওয়া এবং বরিশাল প্রান্ত থেকে একই সংখ্যক লঞ্চ ঢাকায় আসার কথা। কিন্তু যাত্রী না থাকায় প্রতিদিন ৪-৫টি লঞ্চ যাতায়াত করছে। বাকিগুলো ট্রিপ না পেয়ে বসে থাকছে। লঞ্চ মালিকদের বিকল্প নৌপথ খোঁজার পরামর্শ দিয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক বলেন, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ঢাকা নদীবন্দর (সদরঘাট) থেকে প্রচুর মানুষ নৌপথে বনভোজন করেছেন। এতেই প্রমাণ হচ্ছে, নৌপথে ট্যুরিজমের বিস্তর সুযোগ রয়েছে। মালিকরা সেই সুযোগ নিতে পারেন। এছাড়া যেসব রুটে ছোট ও পুরোনো নৌযান চলাচল করছে সেখানে ভালো লঞ্চ প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, লঞ্চ মালিকরা এখনও কোনো প্রণোদনা চাননি। লঞ্চের ট্রিপ কমেছে : বিআইডব্লিউটিএ ও মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে ১০২৭টি লঞ্চ চলাচলের রুট পারমিট আছে। ঢাকা নদীবন্দর থেকে ৪২টি রুটে ২২৬টি লঞ্চের অনুমোদন রয়েছে। সবচেয়ে বেশি যাত্রী যাতায়াত করেন ঢাকা-বরিশাল রুটে। গত বছরের (২০২১ সাল) ডিসেম্বরে এ রুটে ঢাকা থেকে বরিশাল ছেড়ে যাওয়া লঞ্চের ট্রিপ ছিল ২৯৪টি। ওই বছরের নভেম্বরে ট্রিপের সংখ্যা ছিল ২৬২টি। এক বছরের ব্যবধানে তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। ডিসেম্বরে (২০২২ সালে) লঞ্চের ট্রিপ সংখ্যা ছিল ১২৭টি ও নভেম্বরে ছিল ১১০টি। চলতি বছর পদ্মা সেতু চালুর আগের মাসে (মে মাসে) ঢাকা থেকে এ রুটের ট্রিপের সংখ্যা ছিল ২৫১টি। আর জুনে তা আরও কমে দাঁড়ায় ১৮৪টিতে। একইভাবে গত মে মাসে ঢাকা-পটুয়াখালী লঞ্চের ট্রিপ ছিল ১৩৬টি। জুনে পদ্মা সেতু চালুর ৬ মাস পর ডিসেম্বরে ট্রিপের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৫৬টি। নভেম্বরে ট্রিপ ছিল মাত্র ৪৯টি। একই চিত্র ঢাকা-বরগুনা রুটের। মে মাসে ঢাকা থেকে বরগুনা ছেড়ে যাওয়া লঞ্চের ট্রিপের সংখ্যা ৫১টি। অথচ ডিসেম্বরে তা কমে দাঁড়ায় ২৯টিতে। এসব রুটে পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় বাসে ৬ ঘণ্টায় যাতায়াত করা যাচ্ছে। লঞ্চে ওই গন্তব্যে যেতে ৮-১২ ঘণ্টা লাগে। পদ্মা সেতুর সুফল অন্যান্য জেলার তুলনায় ভোলার বাসিন্দারা তুলনামূলক কম পাচ্ছেন। নদীবেষ্টিত এ জেলায় ফেরি সার্ভিস রয়েছে। তবুও ঢাকা-ভোলা রুটেও ট্রিপ সংখ্যা কমেছে। মে মাসে ঢাকা থেকে ভোলা ছেড়ে যাওয়া লঞ্চের ট্রিপ সংখ্যা ছিল ৬৭টি। নভেম্বরে তা কমে ৪৭টি ও ডিসেম্বরে ৫৯টি হয়েছে। তবে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছে ঢাকা-চাঁদপুর নৌরুট। নভেম্বরে ঢাকা থেকে চাঁদপুর ছেড়ে যাওয়া লঞ্চের ট্রিপের সংখ্যা ছিল ৩৫৯টি ও ডিসেম্বরে ছিল ৩৭০টি। অথচ মে মাসে ট্রিপের সংখ্যা ছিল ৪১৭টি। বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তারা জানান, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে স্কুল বন্ধ ও শীত মৌসুম প্রচুরসংখ্যক যাত্রী যাতায়াত করেন। এ কারণে ডিসেম্বরে লঞ্চের ট্রিপের সংখ্যা বেড়ে যায়। অন্যান্য সময়ে যাত্রী সংখ্যা আরও কম থাকে। তখন লঞ্চের ট্রিপও কমে যায়। তারা আরও জানান, পদ্মা সেতু চালুর প্রভাব সবকটি রুটেই পড়েছে। যাত্রীর অভাবে ঢাকা-টরকী, ঢাকা-তুষখালী-রায়েন্দা, ঢাকা-গোমা ও ঢাকা-মাদারীপুর রুটে লঞ্চ চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। কীর্তনখোলা-১, রাজধানীসহ কয়েকটি লঞ্চ স্ক্র্যাপ করা হয়েছে। যাত্রী ও আয় দুই কমেছে : বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা নদীবন্দরে প্রবেশ করলে একজন যাত্রীকে ১০ টাকা মূল্যের টিকিট সংগ্রহ করতে হয়। ওই টিকিটের ১৫ শতাংশ ভ্যাট সরকার পায়। ১০ টাকা থেকে দুই টাকা যাত্রী কল্যাণ ফান্ডে জমা হয়। এছাড়া লঞ্চ ঘাটে ভেড়া ও ছেড়ে যাওয়ার জন্য চার্জ দিয়ে থাকে। যাত্রী ও ট্রিপ সংখ্যা কমে যাওয়ায় শুধু ঢাকা নদীবন্দর থেকেই বিআইডব্লিউটিএ’র জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ মাসেই আয় কমেছে ৭৪ লাখ ৭২ হাজার টাকা। ১ জানুয়ারি পদ্মা সেতু চালুর আগে ২৫ জুন পর্যন্ত সদরঘাট থেকে আয় ছিল ৩ কোটি ৪১ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। ২৬ জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আয় হয়েছে ২ কোটি ৬৬ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। ৫ মাসে আয় কমেছে পৌনে এক কোটি টাকা। প্রবেশ ফির পরিমাণ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পদ্মা সেতু চালুর আগে মে মাসে সদরঘাটে প্রবেশ করেছেন ৪ লাখ ৯৮ হাজার মানুষ। অথচ ডিসেম্বরে সদরঘাটে প্রবেশ করা মানুষের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৬৩০ জন। নভেম্বরে সেই সংখ্যা আরও কম ছিল। ওই মাসে প্রবেশ করেন ৩ লাখ ২০ হাজার মানুষ।