সন্তানদের ডাকে ঘুম ভাঙলেও ওদের বাঁচাতে পারলাম না

১৪ জানুয়ারি, ২০২৩ | ৮:৪৯ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

চার কক্ষের সেমিপাকা ঘরে মা-বাবা ও স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকতেন খোকন বসাক (৪২)। নিজের একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ছিল। সেটি চালিয়ে ভালোই চলছিল ছয়জনের সংসার। কে জানত ঘুমন্ত অবস্থায় আগুনে পুড়ে মারা যাবেন মা, বাবা, স্ত্রী ও দুই সন্তান। আগুনে ঘরের সামনে রাখা অটোরিকশাটিও পুড়ে গেছে। ছেলেমেয়েদের ‘বাবা বাবা’ ডাকে ঘুম ভাঙলে আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে পান খোকন বসাক। নিজে কোনোমতে প্রাণ নিয়ে ঘর থেকে বের হতে পারলেও আগুন থেকে বাঁচাতে পারেননি বাবা-মা, স্ত্রী ও সন্তানদের। তারা ঘরের মধ্যেই আগুনে পুড়ে অঙ্গার হন। শরীরের প্রায় ৩০ শতাংশ দগ্ধ নিয়ে খোকন বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। আপনজন হারানোর কষ্ট এবং দগ্ধ হওয়ার যন্ত্রণা যেন ঘিরে ধরেছে খোকনকে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়ায় খোকনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক আনিসুর রহমান বলেন, ‘খবর পেয়ে রাঙ্গুনিয়া ফায়ার স্টেশনের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। এ সময় জানালার গ্রিল কেটে পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। অগ্নিদগ্ধ একজনকে উদ্ধার করে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গেলে চিকিৎসক চমেক হাসপাতালে প্রেরণ করেন।’ শুক্রবার চমেক হাসপাতালের ৩৬ নম্বর বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে গিয়ে দেখা যায়, মাথা, মুখে, হাতে ও পিঠে দগ্ধ হওয়া খোকন বসাক যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। বেড না থাকায় মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল তাকে। দুই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল তার। কিছুক্ষণ চুপ থাকলেও আবার কেঁদে উঠছেন। কথা বলার অবস্থা তার নেই। তারপরও তিনি বলতে থাকেন-‘বাসায় এক রুমে আমার বাবা, এক রুমে মা ও দুই সন্তান এবং অপর একটি রুমে আমরা স্বামী-স্ত্রী থাকতাম। আগুন লাগার পর পাশের রুম থেকে আমার ছেলেমেয়ে চিৎকার করে বলে বাবা আগুন, ঘুম থেকে ওঠো। এরপর সবাই বারান্দায় একত্রি হয়ে বারান্দায় গিয়ে দেখি আগুনের লেলিহান শিখা। এরপর সবাইকে আমার পেছন পেছন দৌড় দিতে বলে আমি বের হয়ে পড়ি। কিন্তু ওরা কেউ বের হতে পারেনি। ঘরেই পুড়ে অঙ্গার হয়ে মারা গেছে ওরা। যাদের ডাকে ঘুম ভাঙল সেই ছেলেমেয়েকেও বাঁচাতে পারলাম না। সবকিছু হারিয়ে এখন আমি নিঃস্ব।’ হাসপাতালে জেলা পুলিশের এএসআই আলাউদ্দিন তালুকদার বলেন, অগ্নিদগ্ধ খোকনের মাথা, মুখের বামপাশ, দুই হাত ও পিঠসহ শরীরের প্রায় ৩০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে বলে চিকিৎসক জানিয়েছেন। তার শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। কথা বলতে পারছেন না। শনিবার (আজ) তাকে ঢাকা পাঠানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বর্তমানে তিনি বার্ন ইউনিটের ১/এ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন। পারুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এখতেহার হোসেন বলেন, ‘খোকনের চিকিৎসার খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনে তাকে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হবে। স্থানীয় সংসদ সদস্য তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ নিজে বিষয়টি তদারকি করছেন। খোকন সুস্থ হলে তার জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ রান্নাঘরের চুলা থেকে আগুন লাগে। খোকন বসাকের পরিবারের যে ৫ সদস্য মারা গেছেন তারা হলেন তার বাবা কাঙ্গাল বসাক (৭০), মা ললিতা বসাক (৬০), স্ত্রী লাকি বসাক (৩২), ছেলে সৌরভ বসাক (১২) ও মেয়ে শায়ন্তী বসাক (৬)। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, ‘বেড খালি না থাকায় মেঝেতে রেখেই খোকন বসাককে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়া রোগীর অবস্থা প্রথমদিকে ভালো থাকলেও পরে খারাপ হয়ে যায়। তার চিকিৎসার ব্যাপারে শনিবার (আজ) চিকিৎসকরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’