খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়তে পারে ২০ থেকে ২৫ ভাগ

৮ জানুয়ারি, ২০২৩ | ১০:০৮ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকটের কারণে গত বছরের প্রায় পুরোটা সময় অস্থির অবস্থায় কেটেছে বিদ্যুৎ বিভাগের। লোডশেডিং, সাশ্রয়সহ নানা পদক্ষেপেও স্থিতিশীলতা আসেনি শীত আসার আগ পর্যন্ত। এরই মধ্যে বাড়ানো হয় বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যহার। সঙ্গে সঙ্গেই লোকসানের শঙ্কায় খুচরা পর্যায়েও দাম বাড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লাগে বিতরণ কোম্পানিগুলো। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) জমা পড়ে দাম বাড়ানোর প্রস্তাবনাও। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আজ শুরু হচ্ছে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর গণশুনানি। জানা গেছে, কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবনার বিপরীতে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে দাম। গত ১৮ মে বিদ্যুতের পাইকারি হারে দাম বৃদ্ধি নিয়ে গণশুনানি করে বিইআরসি। বিদ্যুতের একক ক্রেতা হিসেবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে এ গণশুনানি করা হয়। গ্যাসের তৎকালীন মূল্য ধরে পিডিবি তার প্রস্তাবে প্রতি ইউনিটের দাম ৬৯ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৫৮ টাকা করার প্রস্তাব করে। গ্যাসের দাম ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি হলে ৯ দশমিক ১৪ টাকা এবং ১২৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেলে ৯ দশমিক ২৭ টাকা করার প্রস্তাব করে পিডিবি। এর রিভিউ শেষে গত ২১ নভেম্বর পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বিইআরসি। প্রতি কিলোওয়াট ৫ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ২০ পয়সা নতুন দর নির্ধারণ করা হয়। এতে করে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের দাম বাড়ে ১ টাকা ৩ পয়সা। শতাংশের হিসাবে ১৯ দশমিক ২২ শতাংশ। যা কার্যকর হয় ডিসেম্বর মাস থেকেই। এই সিদ্ধান্তের কারণে পিডিবি বছরে অন্তত ৮ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পারবে বলে দাবি করলেও লোকসানের বৃত্ত থেকেই বের হতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। তখনই বিতরণ কোম্পানিগুলো লোকসানের ভয়ে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানোর প্রস্তাবনা জমা দেয় বিইআরসি’র কাছে। গত মাসেই বিদ্যুতের খুচরা মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব জমা পড়ে বিইআরসিতে। বিইআরসি সূত্রে জানা যায়, গড়ে ১৯ দশমিক ৯২ থেকে ২৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে সঞ্চালন চার্জ বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পনি। আগামীকাল ও তার পরের দিন প্রস্তাবগুলোর ওপর গণশুনানি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে এ শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। প্রস্তাবগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গ্রাহক পর্যায়ে সর্বোচ্চ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সংস্থাটি গ্রাহক পর্যায়ে গড় মূল্যহার ২৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ তথা এক টাকা ৯০ পয়সা বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। এতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের গড় দাম বেড়ে দাঁড়াবে ৯ টাকা তিন পয়সা। বর্তমানে এ হার ৭ টাকা ১৩ পয়সা। পাশাপাশি ডিমান্ড চার্জ ও পোস্ট পেইড গ্রাহকদের জামানত বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। এছাড়া সকল থ্রি ফেজ এলটি গ্রাহকদের জন্য পাওয়ার ফ্যাক্টর সারচার্জ আরোপসহ আরও কিছু প্রস্তাব করেছে। এদিকে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জন্য ২০ দশমিক ২৯ শতাংশ বা এক টাকা ৩৫ পয়সা বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। আর ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) গড় মূল্যহার ২০ শতাংশ এবং ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) ও নদার্ন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) বাল্ক মূল্য বৃদ্ধির অনুপাতে গ্রাহক পর্যায়ে অর্থাৎ ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। পাইকারির পর খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর গণশুনানির বিষয়ে বিইআরসি চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল বলেন, যেহেতু কোম্পানিগুলো পাইকারি হারে দাম বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে সেহেতু বিষয়টি আমরা বিবেচনায় নিয়েছি। তবে এর আগে শুনানি হবে। শুনানিতে সব পক্ষের মতামতের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে যে সিদ্ধান্তই নেয়া হোক তা অবশ্যই সাধারণ গ্রাহকদের কথা বিবেচনা করেই নেয়া হবে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে একাধিকবার ইঙ্গিত দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আগামী দিনগুলোতে যে চ্যালেঞ্জ আসছে, তা মোকাবিলার জন্য যে পরিমাণ ধৈর্য দরকার, তা সবার কাছে আশা করছি। বিদ্যুতের দাম বাড়বে কিনা সেটা বিইআরসি বলতে পারবে। তবে সবাই যেন প্রস্তুত থাকে, হয় বাড়বে, না হয় বাড়বে না। তবে আমরা চাচ্ছি যতটুকু সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়। নসরুল হামিদ বলেন, এখন প্রত্যাশা বাড়ছে, দিনে দিনে আরও বাড়বে। আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ হলো নিরবচ্ছিন্ন ও সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা। সারাবিশ্বে তেল ও এলএনজি গ্যাসের দামসহ জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়েছে, সেটাকে মাথায় নিয়ে এগোনো আমাদের জন্য একটি চিন্তার বিষয়। আমরা সবকিছু মাথায় রেখেছি। আশা করছি, সামলাতে পারব। পাইকারি দাম বৃদ্ধি পেলে সেই সুযোগটি বিতরণ কোম্পানিগুলো কাজে লাগাবে সেটাই স্বাভাবিক উল্লেখ করে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সহসভাপতি জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, সেই সুযোগে কম উৎপাদনকে সামনে এনে বেশি করে দাম বৃদ্ধি চাইবে, যা কৌশলগতভাবে উপেক্ষা করার সুযোগ থাকবে না। বিশ্বজুড়ে একটা সংকট চলছে তা ঠিক আছে। ব্যয়বহুল বলে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে, একই কারণে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ। সম্প্রতি গ্যাসের দাম বেড়েছে। এরপর জ্বালানি তেলের দাম ব্যাপক পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে। সেই ধাক্কা এখনো সামাল দিতে পারছে না জনগণ। এসব দাম বৃদ্ধির কারণে নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। পাইকারি হারে বিদ্যুতের দামের প্রভাব জনগণের ওপর সরাসরি না পড়লেও খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়লে তাতে জনগণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। তাতে বাজার পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়ারও আশঙ্কা রয়েছে। ভর্তুকি কমাতে গত আগস্টে ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রোল ও অকটেনের দাম এক লাফে লিটারে ৩৪ থেকে ৪৬ টাকা বাড়িয়ে দেয় জ্বালানি বিভাগ। পরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে লিটারে ৫ টাকা কমানো হয়। পিডিবি বলছে, সরকার যে ব্যয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, বিক্রি করে তার চেয়ে কম দামে। গত অর্থবছরে (২০২১-২২) প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রি করে গড়ে তারা পেয়েছে ৫ টাকা ৯ পয়সার মতো, যেখানে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৯ টাকা। বাকি টাকা ভর্তুকি হিসেবে দেয় অর্থ বিভাগ। সরকারিভাবে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটের কথা বলা হলেও বর্তমানে সর্বোচ্চ উৎপাদন হচ্ছে ১৮ হাজার মেগাওয়াট। আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০১০ সাল থেকে গ্রাহক পর্যায়ে ৯ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে ২০১০ সালের মার্চে প্রথম বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। সে সময় বিদ্যুতের গড় দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৩ টাকা ৯২ পয়সা। পরের বছর (২০১১ সাল) গ্রাহক পর্যায়ে দুই দফা বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে বাড়ানো হয় ৫ শতাংশ ও ডিসেম্বরে ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। এতে বিদ্যুতের গড় দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৪ টাকা ৬৭ পয়সা।