দেড় যুগ বন্ধ ৭০ ট্রেন

১৫ মে, ২০২৫ | ৯:৫৩ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

দেড় যুগ ধরে ৭০টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলে ৩২টি এবং পশ্চিমাঞ্চলে ৩৮টি। সাধারণ যাত্রীদের সাশ্রয়ী বাহন হিসাবে পরিচিত লোকাল, মেইল ও কমিউটার ট্রেনের অস্তিত্বই এখন নেই। এ কারণে অনেক স্টেশনও বন্ধ আছে। এসব ট্রেন চলাচল না করায় লোকসানের পাল্লাও ভারী হচ্ছে। জানা যায়, রেলওয়ে প্রতিবছর গড়ে প্রায় পৌনে ৩ হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনছে। বন্ধ রাখা ট্রেনগুলো চালু হলে আয়ের সঙ্গে যাত্রীসেবাও বাড়ত। কিন্তু ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বন্ধ থাকা ট্রেন নিয়ে একেবারেই নিশ্চুপ। যদিও বিভিন্ন ওয়ার্কশপে পড়ে থাকা জরাজীর্ণ ইঞ্জিন-কোচ মেরামত করে ট্রেনগুলো পরিচালনা করা সম্ভব। রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত রেলপথমন্ত্রী-সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের বন্ধ ট্রেন কিংবা বন্ধ স্টেশন চালুর ব্যাপারে আগ্রহ ছিল না। তাদের আগ্রহ ছিল নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের দিকে। আওয়ামী লীগ সরকার গত সাড়ে ১৫ বছরে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। ওই সময়ে নেওয়া চলমান প্রকল্প রয়েছে আরও ৩৪টি। এসব প্রকল্পের ব্যয় প্রায় পৌনে ২ লাখ কোটি টাকা। কিন্তু সাধারণ যাত্রী পরিবহণে বন্ধ ট্রেন পরিচালনা করতে প্রয়োজনীয় ইঞ্জিন-কোচ কেনা হয়নি। ওয়ার্কশপে পড়ে থাকা মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন-কোচ মেরামতেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ‘মধু’ (অনিয়ম-দুর্নীতি-লুটপাট) থাকায় সবার দৃষ্টি ছিল প্রকল্পের দিকে। এ প্রসঙ্গে রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘ট্রেনগুলো দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ আছে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি, এগুলো চালাতে। কিন্তু বন্ধ ট্রেন চালাতে ইঞ্জিন-কোচের পাশাপাশি চালক-গার্ড জরুরি। এসবের স্বল্পতা এখন সবচেয়ে বেশি। বন্ধ ট্রেনগুলোর মধ্যে সবই লোকাল, মেইল ও কমিউটার। এসব ট্রেন সাধারণ যাত্রীদের জন্য খুবই সাশ্রয়ী। এগুলো চালু করা গেলে আয়ের সঙ্গে সেবাও বাড়ত।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের রেলপথ রয়েছে, স্টেশন আছে-কিন্তু রোলিং স্টক সামগ্রী না থাকায় বন্ধ ট্রেনগুলো চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া যেসব ইঞ্জিন-কোচ সংগ্রহ করা হচ্ছে, সেগুলো দিয়ে বন্ধ ট্রেন চালানোও সম্ভব নয়। এসব ট্রেনের ঐতিহ্য রয়েছে, যাত্রীদের চাহিদাও অনেক বেশি। প্রতিটি স্টেশনে বিরতি দিয়ে চলা ট্রেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। আমরা রোলিং স্টক পেলেই ট্রেন পরিচালনা করতে পারব।’ এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার গত কয়েক মাসে ৫টি নতুন ট্রেন চালু করেছে। এগুলো হলো জয়দেবপুর, নরসিংদী, বুড়িমারী ও প্রবাল-১ ও প্রবাল-২ এক্সপ্রেস। সাধারণ ট্রেনযাত্রীদের প্রত্যাশা-অন্তর্বর্তী সরকার বন্ধ ট্রেনগুলো চালুর উদ্যোগ নেবে। একই সঙ্গে মেরামতের জন্য পড়ে থাকা ইঞ্জিন ও কোচ রোলিং স্টক সংগ্রহের মাধ্যমে সচল করার উদ্যোগ নেবে। রেলওয়ে পরিবহণ দপ্তর সূত্র বলছে, বর্তমানে মোট ১২০টি রেলওয়ে স্টেশন বন্ধ রয়েছে। ট্রেন ও স্টেশন বন্ধ থাকায় স্থানীয় যাত্রীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে। রেল কর্তাদের বক্তব্য, সারা দেশে বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী নেতাকর্মী, এমপি-মন্ত্রীদের আবদার মেটাতে গিয়ে সংগৃহীত ইঞ্জিন-কোচ দ্বারা নতুন ট্রেন পরিচালনা করতে হয়েছে। বন্ধ ট্রেন পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হলেই রেলপথমন্ত্রী-সচিব থেকে বাধা আসত। কারণ নতুন ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে রাজনীতি ও ভোটের হিসাব-নিকাশ রয়েছে। রেলওয়ে পরিবহণ দপ্তর সূত্র জানায়, গত ১৫ বছর নতুন ট্রেন পরিচালনার দিকে খেয়াল ছিল আওয়ামী সরকারের। রোলিং স্টক সংগ্রহ এবং বন্ধ ট্রেন পরিচালনার ক্ষেত্রে চাহিদা অনুযায়ী কোনো বরাদ্দ দেওয়া হতো না। বরং যে সেকশন দিয়ে ট্রেন চলছে না-সেই সেকশনে অপ্রয়োজনীয় নতুন রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। নতুন নির্মিত অনেক স্টেশনে একটি ট্রেনও দাঁড়াচ্ছে না। অথচ বন্ধ থাকা ট্রেনগুলোর বেশির ভাগই চলাচল করত স্বল্প ও মাঝারি দূরত্বে। এতে স্বল্প আয়ের মানুষ খুব সহজেই ট্রেনগুলোতে চড়তে পারত। পূর্বাঞ্চলে বন্ধ থাকা ৩২টি ট্রেনের মধ্যে রয়েছে ময়মনসিংহ-দেওয়ানগঞ্জ বাজার রুটের দুটি লোকাল, ময়মনসিংহ-ভৈরববাজার রুটের চারটি লোকাল, সিলেট-ছাতকবাজার রুটের চারটি লোকাল, আখাউড়া-সিলেট রুটের দুটি মেইল, লাকসাম-চাঁদপুর রুটের দুটি কমিউটার, লাকসাম-নোয়াখালী রুটের দুটি কমিউটার, চট্টগ্রাম-নাজিরহাট রুটের ছয়টি কমিউটার, চট্টগ্রাম-চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রুটের চারটি কমিউটার, ঢাকা-হাই-টেক সিটি রুটের দুটি কমিউটার ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের চারটি কমিউটার ট্রেন। পশ্চিমাঞ্চল রেলে বন্ধ থাকা ৩৮টি ট্রেনের মধ্যে রয়েছে গোয়ালন্দ-ঈশ্বরদী ও ঈশ্বরদী-রাজবাড়ী রুটে একটি করে মিশ্র ট্রেন, রাজবাড়ী-গোয়ালন্দঘাট রুটে একটি লোকাল, ঈশ্বরদী-পার্বতীপুর রুটে দুটি লোকাল, পার্বতীপুর-চিলাহাটি রুটে দুটি মিশ্র, রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ রুটে দুটি শাটল, রাজবাড়ী-ভাঙ্গা রুটে দুটি কমিউটার, ঢাকা-ভাঙ্গা রুটে দুটি কমিউটার, সান্তাহার-পঞ্চগড় রুটে দুটি মেইল, পার্বতীপুর-লালমনিরহাট রুটে দুটি কমিউটার, পার্বতীপুর-পঞ্চগড় রুটে দুটি কমিউটার, লালমনিরহাট-পার্বতীপুর রুটে দুটি কমিউটার, রংপুর-লালমনিরহাট রুটে একটি কমিউটার, কাউনিয়া-রমনাবাজার রুটে একটি কমিউটার, রমনাবাজার-রংপুর রুটে আরও একটি কমিউটার ট্রেন, লালমনিরহাট পার্বতীপুর রুটে দুটি করে লোকাল ও মিশ্র ট্রেন, পার্বতীপুর-পঞ্চগড় রুটে দুটি করে লোকাল ও মিশ্র ট্রেন, লালমনিরহাট-বুড়িমারী রুটে দুটি করে লোকাল ও মিশ্র ট্রেন এবং সান্তাহার-লালমনিরহাট রুটে দুটি লোকাল ট্রেন। এ ব্যাপারে মঙ্গলবার রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) আহমেদ মাহবুব চৌধুরী বলেন, ‘শুধু ইঞ্জিন-কোচ নয়, ব্যাপক লোকবলেরও অভাব রয়েছে। ইঞ্জিন-কোচ মেরামত করে যে বন্ধ ট্রেন চালুর উদ্যোগ নেওয়া হবে-এজন্য তো লোকবলের সঙ্গে বরাদ্দ নিশ্চিত করা জরুরি। চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ পাওয়া গেলে ইঞ্জিন-কোচ মেরামত করা সম্ভব হতো। পর্যাপ্ত রোলিং স্টক হলে পর্যায়ক্রমে বন্ধ ট্রেনগুলো চালানো সম্ভব হবে। তাছাড়া রেলে লোকবলের অভাব চরমে উঠেছে। স্বল্পতা রয়েছে ট্রেনচালক ও গার্ডের। বন্ধ ট্রেন চালু করতে রোলিং স্টক সরঞ্জাম-ইঞ্জিন-কোচ সংগ্রহের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে।’