প্রশিক্ষণের নামে কোটি কোটি টাকা অপচয়

১৫ মে, ২০২৫ | ৯:৫১ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নূরুজ্জামান আহমেদের তদবিরের প্রকল্পে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যপূরণ হয়নি। উলটো প্রশিক্ষণের নামে অপচয় হয়েছে বিপুল অঙ্কের টাকা। যেখানে প্রতি ১ টাকা খরচে লাভ আসার কথা ছিল ৯ টাকা ৬২ পয়সা; সেখানে পাওয়া গেছে মাত্র ৩৬ পয়সা। আর আর্থিক ও সামাজিক উপকার মিলেছে যৎসামান্য। ‘অনগ্রসর হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য আত্মকর্মসংস্থানমূলক কাজের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন’-প্রকল্পে দেখা গেছে এমন চিত্র। প্রকল্পটির প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদনের খসড়ায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে এটি তৈরি করছে। আগামী মাসে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। নূরুজ্জামানের নিজ জেলা লালমনিরহাটসহ জামালপুর, ভোলা এবং পটুয়াখালীতে আর্থসামাজিক বৈষম্য দূর করতে প্রকল্পটি হাতে নেয় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এটি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয়ে ২০২১ সালের জুনে বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু পরে এক বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুনে সমাপ্ত করা হয়। এটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এর প্রায় পুরোটাই খরচ হয়েছে। অর্থাৎ আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এছাড়া সার্বিকভাবে প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে শতভাগ। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি। কেননা এটির মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রকল্পভুক্ত তিন জেলার ২৫টি উপজেলার অসহায়, হতদরিদ্র ও এতিম অষ্টম শ্রেণি বা এসএসসি পাশ ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। তাদের ড্রাইভিং, কম্পিউটার বা আইটি এবং গ্রাফিকস ডিজাইন প্রশিক্ষণ দিয়ে আত্মকর্মসংস্থান নিশ্চিত করা। পাশাপাশি ই-মার্কেটিং ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আর্থ- সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো। আইএমইডির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ ভোটার তুষ্টির জন্য প্রকল্পের সঙ্গে তার নির্বাচনি এলাকা লালমনিরহাটকে যুক্ত করেছিলেন। সেই সঙ্গে এটি অনুমোদনে তিনি ব্যক্তিগতভাবে তদবিরও করেছিলেন তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রীর কাছে। পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পেয়েছিলেন তার পছন্দের প্রতিষ্ঠান ও লোকজন। এটা একটি অসফল প্রকল্প। অপচয় ছাড়া কিছুই নয়। প্রতিবেদন বলছে, প্রকল্পের মোট যে বিনিয়োগ (৩৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা); এর বিপরীতে বেনিফিট কস্ট রেশিও (বিএসআর) শূন্য দশমিক ৩৬ টাকা অর্জিত হয়েছে। এটি নির্দেশ করে যে, প্রতি ১ টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে ৩৬ পয়সা অর্জিত হয়েছে। অথচ এর প্রাক্কলিত লক্ষ্য ছিল ৯ টাকা ৬২ পয়সা, এটি অর্জন হয়নি। এছাড়া প্রকল্পের নমুনা জেলায় ২ হাজার ৬৪০ জন অংশগ্রহণকারী কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এর মধ্যে বর্তমানে কম্পিউটার পেশায় নিয়োজিত আছেন মাত্র ১২১ জন। এটি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম। যারা কাজে যুক্ত হয়েছেন তাদের মাসিক গড় আয় ১৫ হাজার ১৩৬ টাকা ৭৫ পয়সা। সে হিসাবে তাদের বার্ষিক আয় ২ কোটি ১৯ লাখ ৭৮ হাজার ৫৬১ টাকা। কিন্তু প্রকল্পের প্রাক্কলিত আয় ছিল ৫৪ কোটি ৪৯ লাখ ২৩ হাজার টাকা। এছাড়া নমুনা জেলায় ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ২ হাজার ৫৪৫ জন, কিন্তু পেশায় নিয়োজিত আছেন মাত্র ৭২ জন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মাসিক আয় গড়ে ১৫ হাজার ৯১৬ টাকা ৬৭ পয়সা। সেই হিসাবে তাদের বার্ষিক আয় ১ কোটি ৩৭ লাখ ৫১ হাজার ৯২৮ টাকা। এক্ষেত্রে প্রকল্পের প্রাক্কলিত আয় ধরা ছিল ৭৩ কোটি ৮২ লাখ ১১ হাজার ১৩৫ টাকা। প্রকল্পের ৩ বছরের মেয়াদকালে মোট উপকারিতা হিসাব করা হয়েছে ১০ কোটি ৭১ লাখ ৯১ হাজার ৪৬৭ টাকা, যা প্রাক্কলিত উপকারিতা ৩৮৪ কোটি ৯৪ লাখ ২ হাজার ৪০৫ কোটি টাকার তুলনায় অনেক কম। তাই প্রকল্পটি বিনিয়োগের তুলনায় সামান্য লাভজনক। প্রকৃত কর্মসংস্থান ও আয় অর্জন প্রাক্কলিত লক্ষ্যের তুলনায় অনেক কম হওয়ায় প্রকল্পের আর্থিক ও সামাজিক উপকারিতা সীমিত হয়েছে। এছাড়া এটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের দক্ষতা উন্নয়ন ও আর্থসামাজিক পরিবর্তনে আংশিক অবদান রেখেছে। এ ব্যাপারে আইএমইডির সাবেক সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, এ প্রকল্পে যেরকম অপচয় হয়েছে তেমন যাতে ভবিষ্যতে না হয় সেজন্যই এই মূল্যায়ন। সমাপ্ত হয়ে যাওয়া প্রকল্পটি কেন সফল হতে পারেনি, কোথায় কোথায় ঘাটতি ছিল সব বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ তুলে ধরা দরকার। তাহলে এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আগামীতে প্রশিক্ষণসংক্রান্ত যে কোনো প্রকল্প নেওয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রকল্পটি পুরোপুরি ব্যর্থ বলা না গেলেও কাঙ্ক্ষিত সফলতা যে আসেনি সেটি সত্য। তাই ভবিষ্যতে চোখ-কান খোলা রেখে সতর্কভাবে প্রকল্প নিতে হবে। আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির সবচেয়ে দুর্বল দিক ছিল প্রশিক্ষণের সময়কাল মাত্র ২১ দিন; যা প্রশিক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত নয়। এছাড়া কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের সনদ এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার কোনো সংস্থান ছিল না। কোভিড-১৯ এর কারণে বাস্তবায়নে দেরি হওয়া। পাশাপাশি সময়মতো বরাদ্দ না পাওয়া। এসব দুর্বল দিকের কারণে প্রকল্পের ফলাফল দীর্ঘমেয়াদি এবং টেকসই হয়নি। ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নেওয়া জামালপুরের মাদারগঞ্জের হাসিবুল ইসলাম জানান, ২১ দিন প্রশিক্ষণের মেয়াদকালে প্রাকটিক্যাল সময় পেয়েছিলেন মাত্র ৮ থেকে ১০ মিনিট। প্রশিক্ষণকালীন যাতায়াত বা নাস্তার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এছাড়া প্রশিক্ষণের সময় দক্ষ প্রশিক্ষক ও উপকরণের অভাব ছিল। প্রায় একই মন্তব্য করেন আরও একাধিক প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী।