রেলে আয় বাড়ানোর উদ্যোগই নেই!

৭ জানুয়ারি, ২০২৩ | ৮:২৮ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

বাংলাদেশ রেলওয়েতে দিন দিন লোকসান বাড়ছেই। সঙ্গে বাড়ছে ব্যয়। কিন্তু সে অনুপাতে বাড়ছে না আয়। গত কয়েক বছরে রেলের অবকাঠামো উন্নয়নে দৃশ্যমান বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে বা ব্যয় অনুপাতে আয় বাড়ানোর কার্যকর কোনো উদ্যোগই দেখা যায়নি। বরং এ সময়ে ট্রেনের গতি আরও কমেছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমেছে সেবার মানও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু সদিচ্ছা থাকলেই বর্তমান অবকাঠামো ও ইঞ্জিন-কোচ দিয়ে ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটিয়ে আয় অন্তত তিনগুণ বাড়ানো সম্ভব। ১৩ বছরে সরকার রেলে ১ লাখ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করেছে। চলমান রয়েছে আরও প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকার ৩৭টি প্রকল্প। এসব প্রকল্পে ৯০ শতাংশ অর্থই ব্যয় হচ্ছে রেলপথ নির্মাণ, স্টেশন ভবন ও প্ল্যাটফরমের উন্নয়নে (কিছু অংশ কোচ ও ইঞ্জিন কেনায়)। সেবা বাড়াতে এসবের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু ট্রেন সঠিক সময়ে পরিচালনা, ট্রেনের গতি বাড়ানো, যাত্রী ও পণ্য পরিবহণের সক্ষমতা বাড়ানো, বন্ধ স্টেশন চালু, বিনাটিকিটি যাত্রী রোধ, টিকিট বিক্রি প্রক্রিয়া সহজ করা ও কালোবাজারি রোধ, ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণ অর্থাৎ সার্বিক সেবা বাড়ানোর উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনার উন্নয়নমূলক কাজ কমই দেখা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আয় বাড়াতে চাইলে এসবে নজর দেওয়ার বিকল্প নেই। সূত্রমতে, গত অর্থবছরে (২০২১-২২) রেল আয় করেছে ১ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। ব্যয় করেছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে (২০১৯-২০) ১ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা। ব্যয় হয়েছে ৪ প্রায় হাজার কোটি টাকার বেশি। বিগত দুই অর্থবছরে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ হাজার কোটি টাকা। আয় হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৫৩২ কোটি। অর্থাৎ গত দুই অর্থবছরে শুধু রেল পরিচালনায় লোকসান গুনতে হয়েছে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন পরিচালনায় দুই বছরে গড়ে ৭০০ কোটি টাকা করে আয় হয়েছে। রেলওয়ে অপারেশন ও ট্রাফিক বিভাগ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন রেলপথ নির্মাণেই ৮০ শতাংশের বেশি ব্যয় করা হচ্ছে। কিন্তু চলমান রেলপথ সংস্কার, ডাবল লাইনে রূপান্তর ও যথাসংখ্যক কোচ দিয়ে ট্রেন পরিচালনার উদ্যোগ নেই বললেই চলে। চলমান ৩৬৬টি ট্রেন ৪ থেকে ১৬টি কোচ নিয়ে চলাচল করছে। এর মধ্যে মাত্র ৩৬টি ট্রেন ১০ থেকে ১৬টি বগি নিয়ে চলছে। মাত্র দুটি ট্রেন (সুবর্ণা ও তিস্তা) ১৮টি বগি নিয়ে চলছে। অথচ চলমান ইঞ্জিন দিয়েই এক একটি ট্রেন কমপক্ষে ২৪ থেকে ২৮টি কোচ নিয়ে চলাচল করতে পারে। এমনটা নিশ্চিত করা হলে শুধু যাত্রী পরিবহণেই বর্তমানের দুই থেকে তিনগুণ আয় করা সম্ভব হতো। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিটি ট্রেনই কোচ স্বল্পতা নিয়ে চলছে। আবার কোনো কোনো ট্রেনে কাগজে-কলমে যে সংখ্যক কোচ রয়েছে, বাস্তবে তারও কম নিয়ে চলছে। যেমন : ঢাকা-চিলাহাটি রুটে চলাচলকারী নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেন কাগজে-কলমে ১২টি যাত্রীবাহী কোচ নিয়ে চলছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিশেষ সময় ছাড়া এক বছরে ট্রেনটি ১০টির বেশি কোচ নিয়ে চলেনি। এ ট্রেনে আসন সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫শ। অথচ এ ট্রেনে নিয়মিত চলাচলকারী বেশ কয়েকজন যাত্রী জানান, চাহিদা অন্তত চারগুণ। দুই হাজার আসন নিয়ে ট্রেনটি চললেও কখনো কোনো আসন ফাঁকা যাবে না। অন্যান্য ১০৩টি আন্তঃনগর ট্রেনের ৯০ শতাংশেরই অবস্থা প্রায় একই। আবার ঢাকা-পঞ্চগড় রুটের একতা, দ্রুতযান ও পঞ্চগড় এক্সপ্রেস, ঢাকা-চিলাহাটি রুটের নীলসাগর এক্সপ্রেস, ঢাকা-রংপুর-কুড়িগ্রাম রুটের রংপুর, লালমনি ও কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ট্রেনগুলো গত এক মাসে একদিনও সঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছায়নি। এসব ট্রেন দুই ঘণ্টা থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত দেরিতে চলাচল করেছে। কয়েকটি ট্রেন বাতিলও করতে হয়েছে। ঢাকা-খুলনা, ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-বেনাপোল রুটে চলাচলকারী ট্রেনগুলোর অবস্থাও প্রায় একই। ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রুটের ট্রেনগুলো মোটামুটি ঠিক সময়ে চললেও এগুলোতেও আধা ঘণ্টা থেকে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত লেট ছিল। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শুধু রাজনৈতিক কারণে একের পর এক জোড়াতালি দিয়ে নতুন ট্রেন উদ্বোধন করা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, চলমান ট্রেনের কোচ কেটে নতুন ট্রেন চালু করা হচ্ছে। এতে ব্যয় বাড়ছে লাফিয়ে, কিন্তু আয় বাড়ছে না। আরও অভিযোগ রয়েছে, বাস মালিকদের সঙ্গে যোগসাজশের কারণে বছরের পর বছর ট্রেন সময়মতো চালানো হয় না, বাড়ানো হয় না কোচ। বাড়ানো হয় না সেবা। সূত্র জানায়, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত রেলে গত অর্থবছরে এক ধাক্কায় ৩৮ শতাংশ আয় বেশি করেছে। মোট ৯৫ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে রেলের আয়। সম্প্রতি ভারতীয় রেল কর্তৃপক্ষের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ২০২১ সালের তুলনায় ’২২ সালে আয় বেড়েছে ২৫ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। যা গত বছরের তুলনায় ১১৬ শতাংশ বেশি। অপরদিকে মোট আয়ের প্রায় ৬৬ হাজার কোটি টাকা আয় করেছে মালবাহী ট্রেন পরিচালনায়। এদিকে বাংলাদেশে মালবাহী ট্রেন পরিচালনায় মোট আয়ের মাত্র ৩ শতাংশ আয় করে রেল। রেলওয়ে পরিকল্পনা দপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত এক বছরে রেল উন্নয়ন খাতে খরচ করেছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। এ খরচের প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকাই খরচ হয়েছে লাইন নির্মাণ ও ইঞ্জিন-কোচ কেনায়। যার প্রায় পুরোটাই বিদেশি ঋণে। যেসব উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে, সেগুলোর আর্থিক ব্যয় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা। ব্যয় অনুযায়ী আয় খুবই কম। ফলে বিনিয়োগে করা ঋণ ফেরত আয় থেকে দেওয়া সম্ভব হয় না। চলতি অর্থবছরে ১৪ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বিনিয়োগসহ রেল খাতে খরচ ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি অর্থবছরে আয় আরও কমতে পারে-ব্যয় বাড়তে পারে আরও বেশি। পরিকল্পনা দপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জানান, আয় বাড়ানোর সঙ্গে ব্যয় কমাতে হবে, যা রেলসংশ্লিষ্টদের মধ্যে একেবারেই তৎপরতা নেই। আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে গত ১ বছর ধরেই বলা হচ্ছে ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধি করতে। ভাড়া বাড়ানো হলে আয় বাড়বে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। আর কোচ বৃদ্ধিসহ টিকিট কাটা নিশ্চিত করা হলে আয় বাড়বে হাজার কোটি টাকার বেশি। সে হিসাবে ভাড়া বাড়ানোর চেয়ে কোচ বাড়ানো বেশি যুক্তিসংগত। রেলওয়ে হিসাবে, বছরে ৯ কোটি ২৭ লাখ যাত্রী ট্রেনে ভ্রমণ করে। অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় ২ লাখ ৫৩ হাজার যাত্রী। এ যাত্রীর বড় অংশই বিনাটিকিটে চলাচল করে। এ হিসাবের বাইরে লক্ষাধিক যাত্রী অতিরিক্ত চলাচল করে, যাদের প্রায় সবাই বিনাটিকিটে চড়ে। রেলওয়ে অপারেশন ও ট্রাফিক দপ্তর সূত্র বলছে, রেলে লোকবলের অভাব রয়েছে। বিভিন্ন সময় নামমাত্র একটি স্টেশনে ঘণ্টাখানেক অভিযান চালালে বিনাটিকিটি ধরা পড়ে শত শত। এক একটি স্টেশন থেকে গড়ে ৫০ হাজার থেকে ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা আদায় করা হয়। ৯৫ শতাংশ স্টেশন উন্মুক্ত থাকায় অভিযান পরিচালনার সময় মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বিনা টিকিট ধরে জরিমানা করা সম্ভব হয়। কমলাপুর স্টেশন সূত্র বলছে, শুধু বিনাটিকিটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে টিকিট বিক্রয়ের দ্বিগুণ আয় হতো। প্ল্যাটফরম টিকিটও নামে মাত্র বিক্রি হয়। বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর, কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রতিদিন প্রায় ১৫ থকে ২৫ হাজার যাত্রী চলাচল করে। এদের মাত্র ৫ শতাংশ যাত্রী টিকিট কাটে। বাকি ৯৫ শতাংশই বিনাটিকিটে চড়ে। রাজধানীর কমলাপুর-বিমানবন্দর, বিমানবন্দর-কমলাপুর রুটে টিকিট কাটা নিশ্চিত করা হলে প্রতিদিন ৬ লাখ টাকা আয় বাড়ত। রেলওয়ে ভূসম্পত্তি দপ্তর সূত্রে জানা যায়, রেলে বর্তমানে প্রায় ৪ হাজার একর জমি বেদখলে রয়েছে। অপরদিকে ১০৪ জোড়া যাত্রীবাহী ট্রেন ‘লোকসানের’ কারণে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। অনেকেরই দাবি, ট্রেন বন্ধ না করে, লোকসান কমাতে রেলের দখলকৃত জমি উদ্ধার করে আয় বাড়াতে পারে। টিকিটধারী যাত্রীদের বক্তব্য, ট্রেনের ভেতর চেকিং হয় যেন, নিজেদের (টিটিই) পকেট ভরতে। এক একটি ট্রেনে যে পরিমাণ বিনাটিকিটি ভ্রমণ করে, সবাইকে জরিমানার আওতায় আনতে গেলে প্রতি ট্রেনে ন্যূনতম আরও বেশি টিটিই প্রয়োজন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক জানান, চলমান রেলপথ দিন দিন আরও ঝুঁকিতে পড়ছে। ট্রেনগুলো স্বল্প কোচ নিয়ে চলছে। স্টেশনগুলো উন্মুক্ত। পদে পদেই লাইনচ্যুতসহ লেভেলক্রসিংগুলোতে হরহামেশা দুর্ঘটনা ঘটছে। দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা নতুন লাইন নির্মাণ, প্রকল্প গ্রহণে ব্যস্ত। অধিকাংশ প্রকল্পে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা না থাকায় এসব নির্মাণে ব্যয় আরও বাড়বে। লোকসানও বাড়বে। যা আছে তা দিয়ে আয় না বাড়িয়ে, একের পর এক বাহারি প্রকল্পের দিকে ধুঁকছে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাই। রেলওয়ে মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. কামরুল আহসান জানান, আয় বাড়াতে আমরা বিশেষ পরিকল্পনা নিচ্ছি। কোচ আসছে, পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন ট্রেনে যুক্ত করা হবে। লোকসান কমাতে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমরা কাজ করছি। একই সঙ্গে অব্যবহৃত জমিতে বাণিজ্যিকভাবে লিজ দিয়ে আয় বাড়ানো হবে। বিনাটিকিট বন্ধে সাধারণ মানুষ তথা টিকিটধারী যাত্রীদেরও সচেতন হতে হবে। রেলপথমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন জানান, রেলকে ধ্বংসের মুখ থেকে আওয়ামী লীগ সরকার তুলে এনেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দৃষ্টিতে রেলে ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে রেলে আমূল পরিবর্তন আসবে। রেল সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। তবে আয় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। ভাড়া বাড়ানোও উচিত। আমরা নতুন ইঞ্জিন-কোচ রেলবহরে যুক্ত করছি। স্বল্প কোচ নিয়ে চলা ট্রেনগুলোতে আরও কোচ সংযুক্ত করা হবে। এতে যেমন আয় বাড়বে, তেমনি খরচও কমবে। এক ইঞ্জিনে-একই তেলে বহু যাত্রী বহন করা যাবে। জমি উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী জমি বরাদ্দ দিয়ে আয় বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।