ফররুখ আহমদের স্মৃতিধন্য বসতভিটা ধ্বংসের পথে

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান পুরুষ কবি সৈয়দ ফররুখ আহমদ। সাম্প্রদায়িকতা ও সামাজিক অবক্ষয়ের মধ্যেও তিনি মানুষের অধিকার ও মর্যাদার কথা বলেছেন। সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে বাংলার মুসলিম সমাজসহ দেশের সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য জাগরণের বাণী প্রচার করেছেন; তারই স্মৃতিধন্য বসতভিটাটি আজ ধ্বংসের পথে। মাগুরার মধুমতী নদীর পারে মাঝাইল গ্রাম। এ গ্রামেই জন্মেছেন রেনেসাঁর কবিখ্যাত ফররুখ আহমদ। মাগুরা শহর থেকে রাজধানী ঢাকার পথে কালো পিচ-পাথরে মোড়া মসৃণ মহাসড়ক ধরে ১২ কিলোমিটার পেরোলেই ওয়াপদা বাস স্টপেজ। এখান থেকে মধুমতী নদীর পুরোনো ফেরিঘাটে যেতে পথেই মাঝাইল গ্রাম। আর এ গ্রামের বর্ধিষ্ণু মুসলিম পরিবারে ১৯১৮ সালের ১০ জুন কবির জন্ম। বাবা সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন পুলিশ ইনস্পেকটর। মায়ের নাম রওশন আক্তার। বাবা পুলিশের কর্মকর্তা হওয়ায় মাঝাইল গ্রামের বাড়িটি একসময় দারোগা বাড়ি হিসাবে পরিচিত থাকলেও এখন সবাই কবির বাড়ি বলেই চেনে। বাড়িটির বেশ আগে মূল সড়কের পাশে কবির নামে ফটক, বাড়ির সামনে নামফলক, গ্রামের সোঁদাগন্ধ জড়ানো মাটি কবির অধিকারের প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। কবিকে নিয়ে স্মৃতিচারণের মতো সমসাময়িক কাউকেই পাওয়া যায়নি সারা গ্রাম ঘুরে। তবে অল্প সময়ের ব্যবধানে কবির স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটির ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী হতে হবে আমাদের, এমন শঙ্কা গ্রামের সবার। সরেজমিন মাঝাইল গ্রামে গিয়ে কবির বাড়ির প্রধান ফটকে দাঁড়াতেই দেখা যায় মধুমতী নদী। সেখানে দিনরাত কাজ করছেন রেল কোম্পানির শ্রমিকরা। ইতোমধ্যেই নদীর বুকে জায়গা করে নিয়েছে মোটা কংক্রিটে গড়া ভারী ভারী স্তম্ভ। এর ওপর দিয়ে দূরের পথ থেকে ধেয়ে আসবে রেলগাড়ি। তাই ছেড়ে দিতে হবে পথ। যে পথে বিলীন হওয়ার শঙ্কা কবির বাড়িটি। টিনের ছাউনিতে শালকাঠে ঘেরা শতবর্ষ আগে তৈরি যে ঘরটিতে কবি জন্মেছিলেন, সেটিতে এখন বসবাস করছেন তার ভাই মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মারুফ আহমদ মাক্কু এবং সৈয়দ মোস্তাক আহমদের পরিবারের সদস্যরা। উভয় পরিবার কবির ঘরটিকে ঐতিহ্যের স্মারক হিসাবে রেখে দিলেও এত বছরে সেখানে চলেনি কোনো সংস্কারকাজ। তিন কক্ষবিশিষ্ট ঘরটির সামনে-ভেতরে ঝোলানো রয়েছে কবির নানা ছবি। কিছু বই। আছে কবি পরিবারের ব্যবহৃত পুরোনো শালকাঠের খাট। তবে অনেক জায়গায় এতে ঘুণ ধরেছে। টিনের চালে জমেছে মরিচা। বর্ষার পানি পড়ে মেঝেতে জন্মেছে শ্যাওলা। বাড়িতে গিয়ে দেখা মেলে কবির ছোট ভাই প্রয়াত সৈয়দ মোস্তাক আহমদের সত্তরোর্ধ্ব স্ত্রী ফাতেমা বেগমের সঙ্গে। তিনি জানালেন, কবির আট ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে দুই ছেলে ও এক মেয়ে বেঁচে আছেন। থাকেন ঢাকায়। নিজের ছেলেরাও ঢাকায় বসবাস করেন। নিজের বাসযোগ্য পাকা ঘর থাকলেও কবির ঘরটি আঁকড়ে বসবাস করছেন বলে জানালেন তিনি। ফাতেমা বেগম বলেন, সরকার কবির বাড়ির ওপর দিয়ে রেললাইন করতে চায়। মরে যাব, তবু ঘর ভাঙতে দেব না। ছেলেরা দূরে, এই বৃদ্ধ বয়সে আমাকেই পাহারা দিতে হচ্ছে এই ভিটেবাড়ি। ডিসি অফিস থেকে জায়গা অধিগ্রহণ করতে নোটিশ নিয়ে এলেও ফেরত দিয়েছি। অথচ রেলওয়ের গতিপথ একটু সরিয়ে নিলেই বাড়িটি টিকে যেতে পারে। ফররুখ আহমদের বাড়িটি কেবল একটি স্থাপনা নয়, বরং বাংলার সাহিত্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ। এ ঐতিহ্য রক্ষায় সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের ইতিবাচক ভূমিকা রাখা জরুরি বলে মনে করেছেন সুধীজনরা। কবি ফররুখ স্মৃতি পাঠাগারের সভাপতি সৈয়দ রিপন আহমদ বলেন, কবির বাড়িটি রক্ষার্থে আমরা বিভিন্ন সময়ে মানববন্ধনসহ জেলা প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের আশ্বাস দেওয়া হলেও সেটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ দেখা যায়নি। এ বিষয়ে কবির ছেলে অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা সৈয়দ ওয়াহিদুজ্জামান বাচ্চু বলেন, সরকার বাড়িটি সংরক্ষণ করে পর্যটন ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসাবেও গড়ে তুলতে পারে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। সেক্ষেত্রে আমরা পরিবারের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে চাই।