বর্ষবরণে বায়ু-শব্দদূষণ জনস্বাস্থ্যে ধাক্কা

২ জানুয়ারি, ২০২৩ | ৯:০৩ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

চারদিকে আতশবাজির ঝলকানি, মুহুর্মুহু বিকট শব্দ। রাতের আকাশে উড়ে বেড়াল বর্ণিল ফানুস। নিকষ কালো গগনে রঙিন রোশনাই চলে দীর্ঘক্ষণ। কোনো কোনো সড়ক ও গলিপথে ছিল ভুভুজেলার ধ্বনি। ফাঁকা রাস্তায় মোটরসাইকেল আর প্রাইভেটকার নিয়ে কেউ কেউ মাতেন গতির খেলায়। ঘড়ির কাঁটা ১২টা ছোঁয়ার আগেই রাজধানীর প্রায় সব বাসার ছাদ থেকে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে ছিল বাহারি প্রস্তুতি। ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন ঘিরে মধ্যরাতের ঢাকার সাজ ছিল এমনই। পুরোনো বছরকে বিদায় আর নতুনকে স্বাগত জানাতে পুলিশের নিষেধাজ্ঞা উড়িয়ে দিয়ে শনিবার মাঝরাতে চিরায়ত নিয়মে ঠিকই কাঁপে ঢাকা। শব্দ আর বায়ুদূষণের তোয়াক্কা করেননি কেউ। বর্ষবরণের রাতে শব্দের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাননি হাসপাতালের মুর্মূষু রোগী কিংবা বাসাবাড়িতে থাকা বয়োবৃদ্ধ ও শিশুরা। ফানুস থেকে ঢাকার অন্তত চার এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তবে বড় কোনো অঘটন ঘটেনি। আর আতশবাজি ও উচ্চ শব্দের প্রতিকার চেয়ে নববর্ষের রাতে জাতীয় জরুরি সেবার নম্বর ৯৯৯-এ ৩৬৫টি ফোন এসেছে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর থেকে এসেছে ১৬০টি ফোন। আতশবাজি, পটকা ফাটানো ও উচ্চ শব্দের গান-বাজনা নিয়ে অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানান। থার্টিফার্স্ট উদযাপনে ঢাকা নগরজুড়ে ওড়ানো ফানুসের একটি অংশ গিয়ে আটকায় মেট্রোরেলের বিদ্যুতের লাইন ও খুঁটিতে। এতে গতকাল দুই ঘণ্টা বন্ধ ছিল মেট্রোরেল। রোববার সকালে এসব ফানুসের পলিথিন নামিয়ে আনার পর সকাল সোয়া ১০টার দিকে রেল চলাচল স্বাভাবিক হয়। বর্ষবরণের আগে শনিবার সকালে মিন্টো রোডের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল- উন্মুক্ত স্থানে কোনো অনুষ্ঠান করা যাবে না। ফানুস উড়ালে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আতশবাজি ফাটানোর ওপর দেওয়া হয় বিধিনিষেধ। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স থেকেও খুদে বার্তা পাঠিয়ে অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে ফানুস না উড়ানোর অনুরোধ জানানো হয়। তবে প্রতি বছরের মতো এবারও পুলিশের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি কেউ আমলে নেয়নি। অনেকে এমন প্রশ্নও তুলেছেন- নিষেধাজ্ঞা নাগরিকদের মানাতে বাধ্য করা যায় না, তাহলে কেন তা প্রতিবছর দেওয়া হয়? ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা বলেন, 'বর্ষবরণের মতো অনুষ্ঠান কীভাবে নির্বিঘ্নে পালন করা যায়- এটা নিয়ে ভাবতে হবে। বিদেশে ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনের জন্য বিশেষ জোন করে দেওয়া হয়। বাংলাদেশেও এই ধরনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আমরা আনন্দ করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি যেন না করি, সে ব্যাপারে সচেতন থাকব। পরিবেশ-প্রতিবেশের যাতে ক্ষতি না হয়, সেটার দিকে মনোযোগ থাকা জরুরি। নববর্ষ ঘিরে শিশুদের বেশি উচ্ছ্বাস থাকে। উদযাপনের নামে যাতে বিশৃঙ্খল কোনো আচরণ কেউ না করে, এটা নিশ্চিত করতে শিক্ষক ও অভিভাবকরাও ভূমিকা রাখতে পারেন। নিম্নমানের গ্যাস বেলুন ও আতশবাজির কারণে অগ্নিকাণ্ডের বিষয়গুলো নিয়ে সচেতন থাকতে হবে। আশা করি, সময়ের সঙ্গে নাগরিকরা আরও দায়িত্বশীল হয়ে উঠবে।' ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, 'এটা বিশ্বাস করি যে, কোনো আনন্দ উদযাপনের সব পথ বন্ধ করে দিলে তারা অন্ধকারে হাঁটবে। জোর করে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া যায় না। উন্মুক্ত স্থান হিসেবে ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনের জন্য এবার হাতিরঝিল খুলে দেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। ওই এলাকা পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখা যায়, সন্ধ্যার পর হাতিরঝিল অন্ধকার থাকে। তাই বিশেষ জোন হিসেবে এ বছর হাতিরঝিল খুলে দেওয়া যায়নি।' অধিকাংশ নাগরিক না মানলেও কেন বারবার থার্টিফার্স্ট নাইট ঘিরে পুলিশ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে- এমন প্রশ্নের উত্তরে ডিএমপি কমিশনার বলেন, 'নিষেধাজ্ঞা না থাকলে অনেকে উদযাপনের নামে লাগামহীন আচরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঁধনের ঘটনার পর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়।' রাজধানীর মেট্রোরেল পুরোপুরি বিদ্যুৎচালিত। ঝুলন্ত তারের সঙ্গে ট্রেনের সংযোগের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পরিবহন হয়। এই ব্যবস্থায় ফানুস কিংবা এ জাতীয় বস্তু আটকে গেলে বিদ্যুৎ পরিবহন বাধাগ্রস্ত হয়। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) সূত্র জানিয়েছে, গতকাল সকালে উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে একটি ট্রেন ছেড়ে আসার পর ফানুস পড়ে থাকার বিষয়টি নজরে আসে। রেললাইন থেকে উঁচু তারে আটকে থাকা কোনো কিছু সরানোর জন্য এক ধরনের স্বয়ংক্রিয় মই উত্তরায় আছে। এই মইবাহী যান রেললাইন ধরে চালানো যায়। যেহেতু একটি ট্রেন উত্তরা থেকে ছেড়ে এসে লাইনে দাঁড়ানো ছিল, সে জন্য মইটি পুরোপুরি কাজে লাগানো যায়নি। কর্মীরা বড় লাঠির সাহায্যে ফানুসগুলো নামিয়েছেন। এ জন্য সময় লেগেছে বেশি। ডিএমটিসিএলের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কেউ কেউ আতশবাজিও ছুড়ে মেরেছে রেললাইনের দিকে। এ জন্য শুরুতে পুরো বিদ্যুৎব্যবস্থা বন্ধ করা হয়েছে। কয়েক বস্তা ফানুস অপসারণ করা হয়েছে। ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক বলেন, ফানুস না ওড়াতে আগের দিন পুলিশ মাইকিং করে। টেলিভিশনে আমরা বলেছি, মেট্রোরেলের পাশে ফানুস ও ঘুড়ি যাতে কেউ না ওড়ান। ঢাকাবাসীকে এগুলো মানতে হবে। মূল্যবান সম্পদের ক্ষতি হলে তো দেশেরই ক্ষতি। এ বিষয়টি নাগরিকদের একটু বিবেচনায় নিতে হবে। দিল্লিতে মেট্রোরেলের লাইন সংখ্যা বেশি। তাই সেখানে ফানুস, এমনকি ঘুড়িও ওড়াতে দেওয়া হয় না। ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, বর্ষবরণের রাতে ফানুস থেকে ঢাকার চার এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের তথ্য তাদের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে গেছে। এর মধ্যে কুর্মিটোলায় ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে। আর লালবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল ও সদরঘাটের হকার্স মার্কেটের ছাদে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা পৌঁছার আগেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। শনিবার রাত থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ কিছু ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে একটিতে দেখা গেছে, যে দিকেই পাখি উড়ে যায়, সেদিকেই আতশবাজি ফাটছে। এর সঙ্গে সঙ্গে পাখিরা দলবদ্ধভাবে উল্টো দিকে পালানোর চেষ্টা করছে। শুধু ভয় পেয়ে পাখিদের ভিডিও নয়, সন্তানের আতঙ্কের বর্ণনা দিয়েও অনেকে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ একটি ভিডিও পোস্ট করে লেখেন- 'কেবল নিজের আনন্দই জীবন নয়। এই পাখিরাও প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখার অনন্য শক্তি। এদের দিকে কেউ তাকাল না।' ঢাকা নগরজুড়ে নতুন বছরকে বরণ করতে আতশবাজি, পটকা ফোটানো ও ফানুস ওড়ানোর ঘটনা নতুন নয়। তবে তা যদি হয় প্রাণ-প্রকৃতি ক্ষতি করে, তখন তা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ বছর থার্টিফার্স্ট নাইটে ঢাকায় শব্দ ও বায়ুদূষণ দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় চলে গিয়েছিল। বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) ছয় বছর ধরে ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে বায়ু ও শব্দদূষণের তীব্রতা পর্যবেক্ষণ করছে। এতে ডিসেম্বরের শেষ দিনের চেয়ে জানুয়ারির প্রথম দিনের বায়ুমান সূচকের বিশেষ পরিবর্তন পাওয়া গেছে। ৩১ ডিসেম্বর রাত থেকে থেকে ১ জানুয়ারি বায়ুমান সূচক ৬ থেকে ৬৬ শতাংশ বেড়েছে। শনিবার থার্টিফার্স্ট নাইটে ঢাকায় বায়ুমানের সূচক ছিল তিনশর কাছাকাছি। বিষেজ্ঞরা বলছেন, এটি বিপজ্জনক নির্দেশক। এ ছাড়া গত ৬ বছরে ৩০ ডিসেম্বর রাত ১১টা থেকে ১টার মধ্যে রাজধানীতে ১০ স্থানে গড়ে শব্দের মান ৫০-৬০ ডেসিবল পর্যন্ত ছিল। তবে শব্দের মাত্রা ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে ৯০-১১০ ডেসিবল পর্যন্ত ওঠানামা করে। এটা শব্দের স্বাভাবিক সহনীয় মাত্রার চেয়ে দিগুণ। বর্ষবরণের রাতে ঢাকার শব্দের মাত্রা ছিল ১০০-১১০ ডেসিবল। এ ব্যাপারে ক্যাপসের পরিচালক ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, বর্ষবরণ করতে গিয়ে শব্দ ও বায়ুদূষণ ঘটানো দেশের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের লঙ্ঘন। একই সঙ্গে তা নাগরিকদের মধ্যে যাঁরা দূষণের ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে বেশি থাকেন অর্থাৎ বয়স্ক ও শিশুদের স্বাস্থ্যের বিপদ আরও বাড়িয়ে দেবে। গর্ভস্থ ভ্রূণের ক্ষেত্রেও আতশবাজি ক্ষতি করতে পারে। আতশবাজি ও ফানুস প্রাণিজগতে ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনে। তিনি বলেন, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে খোলা মাঠ কিংবা সমুদ্রের তীরে ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন করা হয়। সেখানে বায়ুর প্রবাহ ভালো থাকায় পরিবেশের তেমন ক্ষতি হয় না। বিশ্বের অন্যান্য শহর আমাদের মতো এত ঘনবসতি নয়। ডিসেম্বরে এমনিতেই বায়ুর মান খারাপ থাকে। আতশবাজি যোগ হয়ে তা দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় চলে যায়। লেজার শো কিংবা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আলো উৎসব করার পরামর্শ দেন এই পরিবেশ বিজ্ঞানী। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ফজলে রেজা সুমন বলেন, ঢাকা শহরে পাঁচ লাখের মতো বাড়ি আছে। প্রতিটি বাড়িতে ১০টি করে আতশবাজি ও ফানুস উড়ালেও তা ৫০ লাখে গিয়ে দাঁড়ায়। ফানুসগুলোর অধিকাংশই পলিথিনে মোড়ানো। ফলে আগুন অনেকক্ষণ জ্বলে। ফলে তা জ্বলন্ত অবস্থায় নিচে পড়ে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, একটি চীনা আতশবাজিতে ৪৬.৮৮ শতাংশ পটাশিয়াম নাইট্রেট, ২৩.৪৪ শতাংশ সালফার, ২৩.৪৩ শতাংশ অ্যালুমিনিয়াম ও ৬.২৫ শতাংশ বেরিয়াম নাইট্রেট ব্যবহূত হয়। স্থানীয় আতশবাজিতে এসব ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহারের অনুপাত আরও বেশি। একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মালিকের দেওয়া তথ্য মতে, ৩১ ডিসেম্বর এক দিনেই অনলাইনের মাধ্যমে আতশবাজি ও ফানুস বিক্রি করেছেন ৫০ লাখ টাকার ওপরে। এক সপ্তাহে বিক্রি করেছেন অন্তত তিন কোটি টাকা।