৩৩ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে ঘর পেলেন ৪২ জন

২ জানুয়ারি, ২০২৩ | ৯:০১ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

বগুড়ার সোনাতলা উপজেলা পরিষদের রাস্তায় তিনতলা একটি বাড়িতে যে কারও চোখ আটকে যেতে বাধ্য। দৃষ্টিনন্দন বাড়িটির মালিক উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আনোয়ার বাদশা। ৩৮ শতাংশ জমিতে বাড়ি ও ১৭টি টিনশেড দোকান করেছেন তিনি। রানীর পাড়া গ্রামে বাড়িসহ আবাদি জমি ১৩ বিঘা, শহরের কাটনারপাড়ায় চার শতক জমিতে রয়েছে দোতলা বাড়ি। এত সম্পদের পরও সরকারি খাতায় বাদশা নিঃস্ব ও অসচ্ছল। বসবাস করেন জীর্ণ ঘরে। এভাবেই জালিয়াতির মাধ্যমে বাদশা বাগিয়ে নিয়েছেন উপজেলার আগাবর গাছায় ৫ শতক জমিতে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্মিত সরকারি 'বীরনিবাস'। উপজেলার নিত্যরঞ্জনপুরের এ কে এম রেজাউল হক থাকেন পাকা বাড়িতে, ১২ বিঢ়া আবাদি জমির মালিক। স্ত্রী উম্মে হাবিবা আতিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। অথচ ঘর পাওয়া রেজাউলও আবেদনে নিজেকে অসচ্ছল এবং ঘরবিহীন মুক্তিযোদ্ধা উল্লেখ করেছেন। পিছিয়ে নেই উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার রফিকুল ইসলাম। তবে তিনি একটু ভিন্ন কৌশলে হয়েছেন সম্পদশালী, যেটিকে এলাকায় আলাউদ্দিনের 'আশ্চর্য প্রদীপ' আখ্যা দেওয়া হচ্ছে! বীরনিবাস বরাদ্দ পাওয়ার আগে রফিকুলের অর্থ-সম্পদ বলতে ছিল একটি টিনশেড ঘর ও এক বিঘা আবাদি জমি। গত এক বছরে তিনি ১ কোটি ৩২ লাখ টাকা ব্যয়ে কিনেছেন বালু পরিবহনের ছয়টি ট্রাক্টর। ৩৫ লাখ টাকায় কিনেছেন ৫ বিঘা আবাদি জমি। টিনশেড ফেলে প্রায় ১২ লাখ টাকা খরচে দিয়েছেন পাকাঘর। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছর ২২ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বগুড়া জেলায় ১৭৩ মুক্তিযোদ্ধার নামে বীরনিবাস বরাদ্দ দেয়। এর মধ্যে সোনাতলা থেকে সবচেয়ে বেশি ৬৭ জন বরাদ্দ পান। বাকিগুলো পান আট উপজেলার ১০৬ জন। নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, সোনাতলা উপজেলা প্রশাসনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বীরনিবাস বরাদ্দ দেওয়া অসচ্ছল ৬৭ জনের মধ্যে রয়েছেন সচ্ছল ও কোটিপতি নুরুল আনোয়ার বাদশা, রফিকুল ইসলাম, রেজাউল হকসহ অন্তত ৫৫ মুক্তিযোদ্ধা। অবশ্য বিতর্ক এড়াতে বাকি ১৩টি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সত্যিকারের সুবিধাভোগীকে। আবার আবেদন করেও ঘর পাননি উপজেলার নামাজখালী এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম, কাবিলপুরের শুকুর আলী, রানীর পাড়ার মকবুল হোসেনসহ শতাধিক অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা। এ নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। সুবিধাবঞ্চিতরা অভিযোগ করেন, দুটি কারণে তাঁদের ঘর দেওয়া হয়নি। এর একটি হলো, চাহিদা অনুযায়ী ঘুষ দিতে পারেননি তাঁরা। দ্বিতীয়টি হলো, পেশিশক্তি না থাকায়। সরকারের কাছে এ বরাদ্দ বাতিল দাবি করেছেন তাঁরা। ইতোমধ্যে প্রতিকার চেয়ে একটি পক্ষ আদালতে মামলা এবং মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে আবেদন করেছে। গত বছর আগস্টে বগুড়া আদালতে মামলা করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম। তাঁর মৃত্যুর পর মামলা চালাচ্ছেন আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয় ও জামুকা থেকে কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখতে পাননি তাঁরা। দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধা শুকুর আলী বলেন, 'জমি নেই, বয়সের ভারে দিনমজুরিও করতে পারি না। অন্যের বাড়িতে আশ্রিত। টাকা দিতে পারিনি বলে আমি ঘর পাইনি।' ঘর পাওয়ার বিষয়ে নুরুল আনোয়ার বাদশা বলেন, 'আবেদন করেছিলাম। যাচাই-বাছাই করেই ঘর বরাদ্দ দিয়েছে। এতে দোষের কী আছে? সত্যি বলতে নিজের সম্পদ বলে কিছুই নেই। আমি একজন নিঃস্ব মুক্তিযোদ্ধা, ব্যাংকে ঋণ রয়েছে ৬০ লাখ টাকা। যেসব সম্পদ আছে, তা স্ত্রী ও সন্তানদের।' রেজাউল হক বলেন, 'প্রয়োজন ছিল বিধায় আমাকে ঘর দেওয়া হয়েছে। অন্যদেরও দেওয়া হবে। অর্থ-সম্পদ বলতে আমার কিছুই নেই, যা আছে সব স্ত্রী-সন্তানদের।' অনুসন্ধানে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটিকে ম্যানেজ করে সচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পাঠানো হয় মন্ত্রণালয়ে। এর মধ্যে প্রভাবশালী হিসেবে নিয়ম ভেঙে ঘর পান ১২ জন। এ তালিকায় ১৩ অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাকে রাখা হয়। আর বাকি ৪২ জন বরাদ্দ পান ঘুষ দিয়ে। তাদের কারও কাছ থেকে ১ লাখ, কারও কাছ থেকে দেড় লাখ, কারও থেকে ৫০ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে। এভাবে ঘুষের প্রায় ৩৩ লাখ টাকা পেয়েছেন সাবেক কমান্ডার ও যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম। অভিযোগ রয়েছে, তিনি আবার এ থেকে ২০ লাখ টাকা দিয়েছেন দেড় মাস আগে বিদায়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে। বরাদ্দ বাতিলের আশঙ্কা ও ভয়ভীতি দেখানোর কারণে টাকা দিয়েও মুখ খুলছেন না অনেকে। যাচাই-বাছাই কমিটির অন্যতম সদস্য মতিয়ার রহমান বলেন, 'প্রভাব খাটিয়ে ও অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে অনেকেই ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন। অগ্রিম টাকাও দিয়েছেন বলে শুনছি। কিন্তু বরাদ্দ বাতিলের আশঙ্কায় কেউই এসব নিয়ে মুখ খুলছেন না।' সূত্র জানায়, রফিকুল ইসলাম বীর নিবাসের ঘর দেওয়ার কথা বলে অগ্রিম টাকাও নিয়েছেন। উপজেলায় মোট ভাতাভোগী মুক্তিযোদ্ধা ৫১৮ জন। তাঁদের মধ্যে ৩০ থেকে ৩৫ জন ছাড়া সবাই ঘর পেতে তদবির করছেন। এটিকে কাজে লাগিয়ে ১৮৬ মুক্তিযোদ্ধা থেকে রফিকুল অন্তত ১ কোটি ২৭ লাখ টাকা অগ্রিম নিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলার ভেলুরপাড়ার এক মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেন, ঘরের জন্য তিনি রফিকুলের হাতে দেড় লাখ টাকা দিয়েছেন। ৬৭টি ঘর বরাদ্দে সুপারিশ করা তখনকার ইউএনও এবং বর্তমানে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলায় কর্মরত সাদিয়া আফরিন বলেন, 'যাচাই-বাছাই কমিটির অন্য চার সদস্য তালিকা করলে আমি স্বাক্ষর করে তা মন্ত্রণালয়ে দিয়েছি। ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ভিত্তিহীন। কেউ হয়তো আমার নাম ভাঙিয়ে এসব করে থাকতে পারে।' অভিযোগ অস্বীকার করে রফিকুল ইসলাম বলেন, 'ঘর একসময় সবাই পাবেন। এ জন্য সবাই আবেদন করছেন। আমি তাঁদের আবেদন জমা রেখে সময় মতো মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। কিন্তু এ জন্য কারও থেকে একটি টাকাও নিইনি।' হঠাৎ এত সম্পত্তি কীভাবে হলো- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, 'লোকে যা বলে, তা পুরোপুরি ঠিক নয়। পরিশ্রম করেই সম্পদ করেছি।' এ বিষয়ে বর্তমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাঈদা পারভীন বলেন, 'সচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ঘর পেয়েছেন- লিখিত অভিযোগ দিলে তদন্ত করে সত্যতা পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'