পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি অনেক অঙ্গীকার

১ জানুয়ারি, ২০২৩ | ৯:২২ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

আওয়ামী লীগের ২০১৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারের মূল কথা ছিল ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ।’ দলটি তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জনগণের কাছে কিছু বিশেষ অঙ্গীকার করেছিল। ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ স্লোগান দিয়ে তারা প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণ করতে চেয়েছিল। ‘তারুণ্যের শক্তি-বাংলাদেশের সমৃদ্ধি’ স্লোগান দিয়ে তরুণ-যুবসমাজকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর এবং কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অঙ্গীকারও ছিল এ ইশতেহারে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে। টানা তিন মেয়াদের এই সরকারের ৪ বছর পূর্ণ হচ্ছে ৭ জানুয়ারি। বাকি আছে মাত্র এক বছর। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ দেশবাসীর কাছে যে ওয়াদা করেছিল, তার কতটা পূরণ হয়েছে-চার বছর পূর্ণ হওয়ার প্রাক্কালে সেই প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচনি ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ, জাতীয় সংসদকে কার্যকর করা এবং সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ ও মাদক নির্মূলের অঙ্গীকার করেছিল আওয়ামী লীগ। এতে আরও ছিল, মেগা প্রকল্পগুলোার দ্রুত ও মানসম্মত বাস্তবায়ন, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সুদৃঢ় করা, সার্বিক উন্নয়নে ডিজিটাল প্রযুক্তির অধিকতর ব্যবহার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, দক্ষ ও সেবামুখী জনপ্রশাসন, জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, ব্লু-ইকোনমি- সমুদ্রসম্পদ উন্নয়ন, নিরাপদ সড়কের নিশ্চয়তা দিয়ে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার। এ বছর আগস্টে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত এক নাগরিক সম্মেলনে বলা হয়, নির্বাচনের আগে জনপ্রতিনিধিদের কাছে জনগণ তাদের দাবিদাওয়া তুলে ধরতে পারলেও নির্বাচনের পর সে সুযোগ কমে গেছে। এ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের ২০১৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও লিঙ্গসমতা সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতিগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে পর্যালোচনা হয়। নাগরিক সম্মেলনে বক্তারা তাদের মতামত তুলে ধরেন। তারা বলেন, আগের দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগ জোট সঙ্গীদের নিয়ে সরকার গঠন করলেও এবার করেছে এককভাবে। ফলে চার বছরে সফলতার কৃতিত্ব যেমন, তেমনি ব্যর্থতার দায়ও এককভাবে আওয়ামী লীগের বলে তারা মনে করেন। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী শনিবার বলেন, ভালোর কোনো শেষ নেই। আমাদের সরকার সেই চেষ্টা করে যাচ্ছে। গত নির্বাচনের আগে ইশতেহারে আমরা যে অঙ্গীকার করেছিলাম তা একে একে বাস্তবায়ন করছি। দেশের মানুষ তা লক্ষ্য করছে। সংসদ কার্যকর হয়েছে বলে মনে করেন কিনা-জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিরোধী দল সংসদে বেশি কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে উপস্থিত থেকে বিরোধী দলের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। তাদের যেসব দাবি যৌক্তিক বলে মনে হয়, তা বিবেচনা করেন। দুর্নীতি বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রবীণ এই নেত্রী বলেন, আমাদের সরকার বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছেন, যার অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। তবে এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি শনিবার বলেন, এগুলো (নির্বাচনি অঙ্গীকার) তাদের (আওয়ামী লীগের) কথার কথা। এসব অঙ্গীকারের দিকে তারা ফিরেও তাকায় না। তারা বলেন, ভোট নেওয়ার জন্য নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা এবং অঙ্গীকারের কথা বলতে হয় বলেই বলে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারের ৩.১ অনুচ্ছেদে ‘গণতন্ত্র, নির্বাচন ও কার্যকর সংসদ’ অংশে বলা হয় : বিগত ১০ বছরে জাতীয় সংসদই ছিল সব রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। আমরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের চলমান প্রক্রিয়াকে আরও জোরদার করব। সংসদকে আরও কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। একই সঙ্গে মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, গণমাধ্যম, বিচার বিভাগকে আরও শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু গত তিন বছরে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ কিংবা জাতীয় সংসদকে আরও কার্যকর করার কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক সোহরাব হাসান বলেন, নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতনের পর যখন বেসরকারি টিভি চ্যানেল ছিল না, জাতীয় সংসদের ধারাবিবরণী সরকারি প্রচারমাধ্যম রেডিওতে প্রচার করা হলে রাস্তাঘাটেও মানুষ ভিড় জমাত। গাড়ির চালকেরা গাড়ি থামিয়েও সেই বিতর্ক শুনতেন। এখন জাতীয় সংসদের বিতর্ক নিয়ে জনগণের কোনো আগ্রহ নেই। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব গণতন্ত্রকে এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে। তিনি বলেন, ইশতেহারে আওয়ামী লীগ মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বলেছিল। গত এক যুগে কমিশন একটি অথর্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। অধ্যাপক মিজানুর রহমান চেয়ারম্যান থাকাকালে মানবাধিকার কমিশনকে কিছু কিছু বিষয়ে আওয়াজ তুলতে দেখা যেত। এখন একেবারে নীরব। আওয়ামী লীগ দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বলেছে। দুদক ছোট ও মাঝারি দুর্নীতিবাজদের ধরলেও রাঘববোয়ালেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের অনেক সাফল্য আছে। অনেক বড় বড় প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলেছে। বাস্তবসম্মত নীতি-পরিকল্পনার কারণে করোনার ধাক্কাও অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যে মূল ভিত্তি গণতন্ত্র, তা ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আরও দুর্বল হয়েছে। নির্বাচনি ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এটাই আওয়ামী লীগের ওয়াদার বড় বরখেলাপ। ইশতেহারের ৩.২ অনুচ্ছেদে ‘আইনের শাসন ও মানবাধিকার সুরক্ষা’ অংশে ছিল : সর্বজনীন মানবাধিকার সুনিশ্চিত করার পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে কোনো প্রচেষ্টা প্রতিহত করার অঙ্গীকার। গত চার বছরে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠান হিসাবে র‌্যাব এবং এর সাবেক ও সে সময়কার সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, যা বাংলাদেশে অতীতে কখনো ঘটেনি। এতে দেশের ভাবমূর্তি সমুন্নত হয়েছে না ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে নিয়ে প্রশ্ন করছেন বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর নেতারা। আওয়ামী লীগের ইশতেহারে পাঁচ বছরে ১ কোটি ২৮ লাখ কর্মসৃজনের পরিকল্পনা নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। সে ক্ষেত্রে চার বছরে প্রায় এক কোটি লোকের কর্মসংস্থান হওয়ার কথা। অর্থনীতিবিদদের মতে, বছরে ৭ থেকে ৮ লাখের বেশি লোকের চাকরি হয়নি। বর্তমানে দেশ ভয়াবহ বেকার সমস্যায়। আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে বলা হয়েছিল, পার্বত্য শান্তি চুক্তির যেসব ধারা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি, সেগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে। চুক্তি হয়েছে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর। কিন্তু অবাস্তবায়িত অনেক বিষয় এখনো উদ্যোগ নেওয়ার মধ্যে সরকারের কার্যক্রম সীমিত। আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুত জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন কিংবা সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক সব ধরনের আইন ও ব্যবস্থার অবসানও হয়নি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। ইশতেহারের ৩.৫ অনুচ্ছেদে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের অঙ্গীকার করে বলা হয়, দুর্নীতি একটি বহুমাত্রিক ব্যাধি। পেশিশক্তির ব্যবহার ও অপরাধের শিকড় হচ্ছে দুর্নীতি। যার ফলে রাষ্ট্র ও সমাজ-জীবনে অবক্ষয় বা পচন শুরু হয় এবং অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসন প্রভৃতি কোনো ক্ষেত্রেই ইস্পিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয় না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করার অঙ্গীকার ফলাও করে ঘোষণা হলেও তা বাস্তবায়নে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। সংশ্লিষ্টরা বলেন, ব্যাংক সেক্টরের বর্তমান চিত্র সে কথায় প্রমাণ করে। আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তি চালুর মাধ্যমে দুর্নীতির পরিধি ক্রমান্বয়ে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে। কিন্তু সরকারের ঘোষিত এই নীতির প্রতিফলন গত ৪ বছরে দেখা যায়নি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পর্যালোচনা, পর্যবেক্ষণ ও তদারকি ভবিষ্যতে আরও জোরদার করার অঙ্গীকার করা হয়েছিল আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে। দুর্নীতি প্রতিরোধে আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি রাজনৈতিক, সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ জোরদার করা হবে। ঘুস, অনোপার্জিত আয়, কালো টাকা, চাঁদাবাজি, ঋণখেলাপি, টেন্ডারবাজি ও পেশিশক্তি প্রতিরোধ এবং দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু কানাডায় বেগম পাড়ার যে সংবাদ গণমাধ্যমে ছাপা হচ্ছে-তাতে এ অঙ্গীকার বাস্তবায়ন নিয়ে সব মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে। রাজনীতিকেরা না আমলারা বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত, তা নিয়ে সরকারি পর্যায়েই বিতর্ক হচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কানাডায় যারা সেকেন্ড হোম বানিয়েছেন, তাদের মধ্যে আমলার সংখ্যা বেশি। জঙ্গিবাদ দমনে সরকার সফল হয়েছে। কিন্তু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কতটা বন্ধ করতে পেরেছে সরকার সে প্রশ্নই রয়েই গেছে। ইশতেহারের ৩.৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকারের অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতির জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি ও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। জাতির পিতার আদর্শ ও সংবিধানের ২৫নং অনুচ্ছেদে বিধিবদ্ধ নীতি ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’-এর আলোকে সব রাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক জোরদার করা হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত আমলের দুর্নীতিগ্রস্ত ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’, ‘অকার্যকর রাষ্ট্র’ প্রভৃতি কলঙ্ক ঘুচিয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় স্বার্থে অর্থনৈতিক কূটনীতিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, সরকারের দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির কারণে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে এখনও কার্যকর কোনো আশ্বাস আদায় করতে পারেনি। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের বিষয়েও কোনো অগ্রগতি হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্র নীতি এবং তাদের দাবিকৃত সাফল্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।