নতুন বছরের কূটনীতি, ভারসাম্য রক্ষা করাই কঠিন

১ জানুয়ারি, ২০২৩ | ৯:১৬ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

ভারসাম্য রক্ষা করাই বাংলাদেশে নতুন বছরের কূটনীতিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিদায়ি বছরের শেষদিকে বড় শক্তিগুলোর বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা বাংলাদেশের ওপর ভর করে। কৌশলগত বিতর্কে লিপ্ত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। এ ঘটনার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত একটি রুশ জাহাজ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরঞ্জাম নিয়ে বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ জাহাজটিকে এদেশের জলসীমায় ঢুকতে দেয়নি। এ নিয়ে কূটনীতিতে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে মস্কো ও ওয়াশিংটনের মধ্যে এই পালটাপালটি অবস্থান নতুন বছরে শেষ হয় কি না, সেটিই দেখার বিষয়। কারণ, বাংলাদেশে সংসদীয় নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের পক্ষে সোচ্চার। মানবাধিকারের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় তৎপরতা রয়েছে। সরকার এসব বিষয়কে কূটনীতিসংক্রান্ত ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন বিবেচনায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলে মনে করে। সরকারের সঙ্গে সুর মিলিয়ে রাশিয়া বলছে, মানবাধিকারকে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র। নির্বাচন নিয়ে ভারত ও চীন প্রকাশ্যে কিছু বলেনি। তবে তারাও রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতি নজর রাখছে। ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অপরিবর্তিত আছে। চীনের সঙ্গেও বাংলাদেশের সম্পর্কের তেমন হেরফের হয়নি। বাংলাদেশ কখনোই ভারত ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা চায় না। তাই চীন ও ভারতের সঙ্গে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক বজায় রেখে চলে বাংলাদেশ। ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণে নতুন বছরে স্পর্শকাতরতা বাড়তে পারে। রোহিঙ্গা সংকটের পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও এই সংকট সমাধানের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ফলে নতুন বছরেও রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে দুশ্চিন্তা অব্যাহত থাকতে পারে। মহামারি পরবর্তী পরিস্থিতি এবং ইউক্রেনে রুশ অভিযানের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে রপ্তানি বাড়ানোও চ্যালেঞ্জ। কারণ, রপ্তানি বৃদ্ধি না পেলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ অব্যাহত থাকতে পারে। ফলে বিদেশে অর্থনৈতিক কূটনীতি জোরদার করার কোনো বিকল্প নেই। বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের আরেক খাত জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধি করার লক্ষ্যেও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা জরুরি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে রুশ জাহাজ স্পার্টা-৩ বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করতে না পেরে এখন কলকাতা বন্দরে নোঙর করবে। সেখান থেকে অন্য জাহাজে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরঞ্জাম বাংলাদেশে আসবে। রুশ জাহাজ স্পার্টা-৩ মূলত বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে প্রথমে ভারতে যায়। ওই জাহাজে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কিছু সরঞ্জাম দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ভারতে তাদের পণ্য খালাসের পর জাহাজটি রূপপুরের সরঞ্জাম নিয়ে বাংলাদেশ অভিমুখে রওয়ানা করে। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের তরফে বাংলাদেশকে সতর্ক করা হয় যে, স্পার্টা-৩ জাহাজের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। জাহাজটি আন্তর্জাতিক জলসীমায় অপেক্ষার সময়ে বাংলাদেশ জানিয়ে দেয়, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে স্পার্টা-৩ এদেশে নোঙর করতে পারবে না। বিষয়টি নিয়ে রুশ রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার মন্তেৎস্কির সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্সবিষয়ক বিভাগের সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) খুরশেদ আলমের সঙ্গে বৈঠক হয়। উল্লেখ করা প্রয়োজন, রুশ জাহাজ স্পার্টা-৩-এর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও জাতিসংঘ কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থার নিষেধাজ্ঞা নেই। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞা আমলে নেয়নি। তাই তারা মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা রুশ জাহাজকে তাদের দেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকখানি নির্ভরশীল থাকায় শক্তিধর দেশটির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না। তার ওপর বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র‌্যাবের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। ফলে নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞার চাপ সহ্য করা বাংলাদেশের পক্ষে কঠিন। বিষয়গুলো বোঝানোর পর রাশিয়া বাস্তবতা মেনে নিয়েছে। তারা ভারতে জাহাজ নোঙর করে অন্য জাহাজে রূপপুরের সরঞ্জাম বাংলাদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সূত্রটি আরও জানায়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল সরঞ্জাম আগে চলে এসেছে। স্পার্টা-৩ জাহাজে ছোটখাটো যন্ত্রপাতি এলেও এসব চার্টার বিমানেও আনা সম্ভব। আগে এসব ছোটখাটো যন্ত্রপাতি ভাড়া করা বিমানেই এসেছে। এবার খরচ কমানোর লক্ষ্যে সমুদ্রপথে জাহাজে আনা হচ্ছিল। তবে জাহাজটির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কথা আগে থেকে বাংলাদেশের জানা ছিল না। জাহাজ কলকাতায় নোঙর করে সরঞ্জাম খালাসের পর অন্য জাহাজে বাংলাদেশে আনার কারণে সময় ও ব্যয় কিছুটা বাড়বে। তবে কর্মকর্তারা বলছেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ পেতে বিলম্বের কারণ সরঞ্জমাদি পৌঁছাতে দেরি হওয়া নয়; বরং বিদ্যুৎ গ্রিডের সঞ্চালন লাইন আপডেট না থাকায় কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ পেতে সময় লাগতে পারে। রাশিয়ার সহযোগিতায় বাংলাদেশের পাবনা জেলায় অবস্থিত রূপপুরে পারমণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৩ বিলিয়ন ডলার। ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযান পরিচালনা করার পর থেকে রূপপুর পারমাণবিক বিদু্যুৎকেন্দ্রে কর্মরত রাশিয়া ও ইউক্রেনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশে টাকা পাঠাতে সমস্যায় পড়েছিলেন। বাংলাদেশ সরকার এখন তাদের পাওনা বেতন রাশিয়ায় পরিশোধ করার সিদ্ধান্ত নিলে সংকটের সুরাহা হয়। তবে বিষয়টি এখনো বাংলাদেশের কূটনীতিতে আলোচনার মধ্যে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ১৪ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকার শাহীনবাগে গুম হওয়া বিএনপি নেতা সুমনের বাসায় গেলে বাইরে জিয়াউর রহমানের আমলে ফাঁসিপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের স্বজনরা সেখানে ভিড় করেন। এ ঘটনায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের তরফে বিষয়টি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবহিত করা হয়। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরানের কাছে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগের কথা জানায়। তবে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এমন পরিস্থিতি তার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অনিবার্য পরিণতি। নির্বাচনের আগের বছরে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের খবরদারি বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের তৎপরতা মোকাবিলা করাও বাংলাদেশের বড় চ্যালেঞ্জ। চীন ও ভারতে নতুন করে কোভিড পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় বাংলাদেশে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা খুব প্রয়োজন হতে পারে। বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশের ওপর বিভিন্ন ধরনের প্রভাব মোকাবিলা করা কঠিন এক চ্যালেঞ্জ।