আইনজীবী পিতাকে খুন, ছেলেসহ ৩ জনের মৃত্যুদণ্ড

সিলেটের প্রবীণ আইনজীবী, জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও সাবেক ফ্লাইট লে. অ্যাডভোকেট শামসুল ইসলাম চৌধুরীকে নির্মমভাবে হত্যার দায়ে তার ছেলে মাসউদ আহমদ চৌধুরী মুন্নাসহ তিনজনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। মঙ্গলবার সিলেট বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. শাহাদৎ হোসেন প্রামাণিক এ রায় ঘোষণা করেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্য দুই আসামি হলেন- সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার চন্ডিপুর গ্রামের আব্দুল লতিফের ছেলে মো. জাহের আলী এবং ছাতক উপজেলার রাউলী গ্রামের সুরুজ আলীর ছেলে মো. আনসার আহমেদ। তাদের প্রত্যেককে পৃথক দুটি ধারায় ২৫ হাজার টাকা করে জরিমানা ও অনাদায়ে তিন বছর করে সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশও দেওয়া হয়েছে। এছাড়া মামলার অন্য আসামি মাইক্রোবাসচালক মো. বোরহান উদ্দিনকে ৩ বছরের কারাদণ্ড এবং ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অপরদিকে মো. ইসমাইল হোসেন রানুর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আদালত তাকে খালাস দিয়েছেন। আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট আনছারুজ্জামান বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, রায় ঘোষণার সময় কোনো আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন না; তারা সবাই পলাতক। জানা যায়, অ্যাডভোকেট শামসুল ইসলাম চৌধুরীর চার কন্যা ও দুই পুত্রসন্তান রয়েছে। বড় ছেলে মাহমুদ আহমদ চৌধুরী ঢাকায় পেশাগত কারণে পরিবার নিয়ে থাকেন। ছোট ছেলে মুন্নাকে নিয়ে তিনি সিলেট নগরীর মীরবক্সটুলা এলাকার আজাদী ১১০নং বাসায় বসবাস করতেন। ২০১১ সালের ১৭ জুলাই শবেবরাতের রাতে তিনি নিখোঁজ হন। পর দিন মুন্না কোতোয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন এবং কয়েক দিন পর নিজেই আত্মগোপনে চলে যান। পরে জানা যায়, তিনি ভারতে পালিয়ে গিয়েছেন। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার প্রায় তিন সপ্তাহ পর, ৪ আগস্ট নিহতের বড় ছেলে মাহমুদ আহমদ চৌধুরী বাদী হয়ে সহোদর মাসউদ আহমদ চৌধুরী মুন্নাসহ ৫ জনের নাম উল্লেখ করে কোতোয়ালি মডেল থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলাটি প্রথমে তদন্ত করেন কোতোয়ালি মডেল থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-তদন্ত) খায়রুল ফজল। পরবর্তীতে মামলাটি র্যাবে স্থানান্তর হলে তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই ইদ্রিছ আলী ৫ জনকে অভিযুক্ত করে ২০১২ সালের ১৩ মার্চ আদালতে অভিযোগপত্র দেন। মামলার তদন্তে র্যাব-৯ এর সদস্যরা আনসার আহমেদ, বোরহান উদ্দিন ও ইসমাইল হোসেন রানুকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর আনসার ও বোরহান আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তদন্তে উঠে আসে নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত। জবানবন্দিতে আনসার জানান, শবেবরাতের রাতে মুন্না তাকে ও জাহের আলীকে বাসায় ডেকে নেয়। তখন শামসুল ইসলাম নামাজ শেষে তসবিহ পাঠ করছিলেন। সেই সময় আনসার তার হাত, জাহের মুখ চেপে ধরলে, মুন্না তার ঊরুতে ইনজেকশন পুশ করে ও গামছায় পেঁচিয়ে পাথর দিয়ে ঘাড়ে আঘাত করে। পরে তিনজনে মিলে তার কোমর ভেঙে দেয়। জীবিত অবস্থাতেই তাকে একটি প্রাইভেটকারে তুলে ছাতকের সুরমা নদীতে নিয়ে ফেলে দেয়। র্যাবের তদন্তে আনসারের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রাইভেটকার, ৪ কেজি ওজনের পাথর, গামছা এবং ইনজেকশনের সিরিঞ্জ উদ্ধার করা হয়। এরপর ভারত থেকে ফোনে মুন্না পুলিশের এক সাক্ষীর মাধ্যমে জানায় যে, লাশ সুনামগঞ্জের ছাতকের ব্রাহ্মণগাঁও এলাকার সুরমা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় মরদেহের কিছু অংশ, একটি পাঞ্জাবি, গেঞ্জি ও টুপি। পরবর্তীতে ডিএনএ পরীক্ষায় এগুলোর সঙ্গে শামসুল ইসলামের পরিচয় নিশ্চিত হয়। বিচারিক প্রক্রিয়ায় উঠে আসে, মুন্না দীর্ঘদিন ধরেই তার বাবাকে মীরবক্সটুলার বাসার সামনের অংশ নিজের নামে লিখে দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন এবং মানসিকভাবে নির্যাতন করতেন। কখনো কখনো খাবারও দিতেন না। পিপি আনসারুজ্জামান জানান, একজন প্রবীণ ও সম্মানিত আইনজীবীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার দ্রুত শেষ করতে বিচারক মো. শাহাদৎ হোসেন প্রামাণিক আন্তরিকভাবে কাজ করেছেন। এ রায়ের মাধ্যমে দীর্ঘ এক যুগ ধরে ঝুলে থাকা একটি জঘন্য হত্যার বিচার সম্পন্ন হলো। দ্রুত সময়ের মধ্যেই বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন করে আদালত এ রায় দেন। বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতের পেশকার মো. আহমদ আলী জানান, মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় ৩০ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৯ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। মামলাটি চলতি বছরের ১০ মার্চ আদালতে আসে, যুক্তিতর্ক ও শুনানি শেষ হয় ২৪ এপ্রিল।