বিপুল ভোটে জাপার মোস্তফার জয়

২৮ ডিসেম্বর, ২০২২ | ৯:২৮ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন। তিনি দ্বিতীয়বারের মতো নগরপিতার আসনে বসতে যাচ্ছেন। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে ছিটকে পড়েছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া। ৯ প্রার্থীর মধ্যে তাঁর স্থান চতুর্থ। ২২৯ কেন্দ্রের সবটাতে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে জাতীয় পার্টির মোস্তফা ১ লাখ ৪৬ হাজার ৭৯৮ ভোট পেয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী আমিরুজ্জামান পিয়াল (হাতপাখা) পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৮৯২ ভোট। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী লতিফুর রহমান মিলন (হাতি) পেয়েছেন ৩৩ হাজার ৮৮৩ ভোট। অন্যদিকে, নৌকা প্রতীক নিয়ে ডালিয়া পেয়েছেন মাত্র ২২ হাজার ৩০৬ ভোট। তিনি জামানত রক্ষা করতে পারেননি। চার লাখ ২৬ হাজার ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ২ লাখ ৭৯ হাজারের কিছু বেশি লোক। ভোট পড়েছে ৬৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এর আগে ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) বিড়ম্বনা ছাড়া শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই শেষ হয় রংপুর সিটির ভোট। নগরের কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি ছিল কম। সেখানে কোনো কোনো কেন্দ্রে কিছুক্ষণ পরপর দুয়েকজন ভোটার দেখা গেলেও অনেক কেন্দ্রই ছিল ফাঁকা। ভোটারদের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে ভোট কর্মকর্তাদের। তবে ভিন্ন চিত্র ছিল শহরতলির বর্ধিত কেন্দ্রগুলোতে। সেখানে ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে মানুষ এ উৎসবে যোগ দেয়। শহরতলির প্রতি কেন্দ্রেই ভোটার উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। সেখানেও প্রতি কেন্দ্রে গিয়ে ইভিএম বিড়ম্বনার অভিযোগ এসেছে। অধিকাংশ ভোটার জানিয়েছেন, এ প্রযুক্তির ব্যাপারে তাঁরা অবগত নন। আগে কেউ তাঁদেরকে এ মেশিন ব্যবহারের ব্যাপারে প্রশিক্ষণ কিংবা নির্দেশনা দেয়নি। এ কারণে তাঁরা ভোট দিতে পারছেন না। কক্ষে দায়িত্বরত নির্বাচন কর্মকর্তারা সহযোগিতা করলেও সাধারণ মানুষ তা ঠিকমতো বুঝতে পারছেন না। সকাল ১১টার দিকে বুড়িরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে ভোটারদের দীর্ঘ সারি। সেখান ভোটার ২০৯০ জন। ওই সময় ভোট দিতে পেরেছেন মাত্র ১৭৫ জন। লাইনে দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা ভোটার ছাকিউজ্জামান ও খায়রুল ইসলাম ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, এর পর এভাবে আর কেউ ভোট দিতে আসবে না। না জানার কারণে একজন ভোটারের ভোট দিতে ৩০ মিনিট সময় লাগছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ক্ষুব্ধ হয়ে লাইনে থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ। বিড়ম্বনা আরও দেখা দেয় আঙুলের ছাপ না পড়ার কারণে। অনেকেই ছাপ দিতে হাত ধুয়ে আঙুল পরিস্কার করছিলেন। ভোটার আজিজুল ইসলাম জানান, প্রথমে তাঁর আঙুলের ছাপ মেলেনি। পরে আঙুল ঘষে পরিস্কার করে ভোট দিয়েছেন। ভোট দিতে আসা কোবারু গ্রামের রেশমা বেগম বলেন, 'ভোট দেওয়া নাগবে; ফির বাড়ির কামও করা নাগবে। সেই বাদে সকালোতে ভোট দিবার আচ্ছু। দুপুর পার হইল, ভোট দিবার পানু না।' প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বিধান চন্দ্র রাও জানান, নানা কারণে ভোট নিতে সময় বেশি লাগছে। প্রথমত ভোটাররা ইভিএমে ভোট দিতে অজ্ঞ। বাটন চাপতে চিন্তা করতেই তাঁরা সময় নিচ্ছেন। এর ওপর অনেকের আঙুলের ছাপ উঠছে না। গড়ে ভোটারপ্রতি ভোট দিতে ১৫ থেকে ২০ মিনিট সময় লাগছে বলে স্বীকার করেন তিনি। এর এক ঘণ্টা আগে সকাল ১০টায় নগরীর চব্বিশ হাজারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, পাশাপাশি দুটি কেন্দ্র। ভোটারের দীর্ঘ সারি। সকাল সাড়ে ৮টায় শুরু হলেও ভোট দিয়ে বের হয়ে আসা ভোটারের সংখ্যা কম। বরং নতুন নতুন ভোটার এসে যোগ দিচ্ছেন লাইনে। ভোটার ইমরুল ইসলাম বলেন, আগে থেকেই এই ভোট নিয়ে উৎকণ্ঠা ছিল। কোনো ঝামেলা ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিতে পেরেছি। তবে ইভিএমে ভোট দিতে খুব সময় লাগছে। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন নারী ভোটাররাও। এ সময় ষাটোর্ধ্ব ভোটার কেচুয়ানি বেগম বলেন, 'হামার ব্যালোটে ভাল বাহে। মেশিনোত (ইভিএম) ভোট দিতে দিনটায় চলি যায়। এতক্ষণ খাড়া হয়্যা (দাঁড়িয়ে) কি থাকা যায় ?' কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা তানজেউর রহমান জানান, তাঁর কেন্দ্রে পুরুষ ভোটার ১৭০০ এবং নারী ভোটার ১৬৮৮। এলাকার ভোটাররা ইভিএম সম্পর্কে কিছুই জানেন না। সে কারণে সময় বেশি লাগছে। সকাল ১০টায় ১৭০০ পুরুষ ভোটারের মধ্যে ১৫১ জন ভোট দিতে পেরেছেন। ওই সময়ে নারী ভোটার ভোট দিয়েছেন ১৫৫ জন। নগরীর লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে মোট ভোটার ৯২২ জন। দুপুর ১২টায় ওই কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ভোটার উপস্থিতি খুবই কম। পুরুষ ভোটারের লাইনে কয়েকজন থাকলেও নারী ভোটারের লাইন ছিল একেবারে ফাঁকা। সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা রতন সরকার জানান, ওই কেন্দ্রে নারী ভোটারের ৩ নম্বর বুথে ভোটার সংখ্যা ২২৪। দুপুর ১২টা পর্যন্ত ভোট দিয়েছেন মাত্র ৪০ জন। ভোটার আবদুস সালাম ও আলমগীর হোসেন বলেন, ইভিএম পদ্ধতি নতুন হওয়ার কারণে অনেকে ভোট দিতে আসেনি। এ কারণে কেন্দ্রে উপস্থিতি কম। কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা শাহ আলম জানান, দুপুর ১২টায় ভোট দিয়েছেন মাত্র ১৭০ জন। তবে অনেকে বলেছেন, বিকেলের দিকে ভোটার উপস্থিতি বাড়তে পারে। ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর রংপুরে প্রথম সিটি নির্বাচন হয়েছিল। দিনটি ছিল কুয়াশায় ঢাকা। মোমের আলোয় ভোট দিতে হয়েছিল নগরীর ভোটারদের। তৃতীয়বারের সিটি নির্বাচনে গতকাল মঙ্গলবার ভোট দিতে অবশ্য ভোটারদের মোমের বাতি জ্বালাতে হয়নি। তবে কুয়াশা, কনকনে শীত, ঠান্ডা হাওয়া ছিল। রংপুর সিটির নগরপিতা নির্বাচনের জন্য সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত চলে টানা ভোট গ্রহণ। দুই মেয়রপ্রার্থী ভোট দিলেন :সকাল ৯টা ২০ মিনিটে নগরীর কলেজ রোডের আলমনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেন জাতীয় পার্টির (জাপা) মেয়র প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। এর আগে তিনি ৮টা ৫০ মিনিটে ভোট দেওয়ার জন্য কক্ষে ঢুকলে ইভিএমে ত্রুটি দেখা দেয়। ভোট দিতে না পেরে কক্ষ থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। মোস্তফা বলেন, কেন্দ্রে গিয়ে দেখি, ইভিএম হ্যাং হয়েছে। এই যদি ইভিএমের অবস্থা হয়, তাহলে সাধারণ ভোটার ভোট দেবে কীভাবে? আমরা প্রথম থেকে ইভিএম সম্পর্কে নেতিবাচক কথা বলেছিলাম। তবে রিটার্নিং কর্মকর্তা সে কথা শোনেননি। অনেকেই ইভিএমের ব্যবহার জানে না। এই মেশিনে যে সমস্যা- তা আজ প্রমাণিত। এর পর ভোটকেন্দ্রের সামনে আধাঘণ্টা অপেক্ষার পর ইভিএম সচল হলে ভোট দিয়ে বেরিয়ে মোস্তফা বলেন, 'জয়ের ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী। গত নির্বাচনে রংপুরের মানুষ আমাকে বিপুল ভোটে জয়লাভ করিয়েছে। পাঁচ বছরে রংপুরে যে উন্নয়ন হয়েছে, তার মূল্যায়নে এবারও বিপুল ভোটে বিজয়ী হবো। সকাল ১০টার দিকে নগরীর লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ভোট দেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী ডালিয়া। এ সময় উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, রংপুরের মানুষ আর ভুল করবে না। তারা নৌকা মার্কায় ভোট দেবে। চমৎকার পরিবেশে সুষ্ঠু ভোট হচ্ছে। ভোটকেন্দ্রে ইভিএমে কোনো সমস্যা হয়নি। বিপুলভাবে সাড়া ও সমর্থন পেয়েছি। জয়ের ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী। রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলকে কেন্দ্র করে দু'পক্ষের সংঘর্ষসহ বিজিবির টহল গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে বিজিবির এক সদস্য আহত হয়েছেন। সন্ধ্যার পর ভোট গ্রহণ শেষে নগরীর ৪ নম্বর ওয়ার্ডের আমাশু কুকরুল কেন্দ্রে লাটিম প্রতীকের কাউন্সিলর প্রার্থী হারাধন রায় ও একরামুল হকের কর্মী-সমর্থকদের মাঝে হট্টগোল বেধে যায়। এ ঘটনায় পুলিশ হারাধনকে গ্রেপ্তার করেছে। মঙ্গলবারের নির্বাচনে ৯ মেয়র প্রার্থীসহ মোট ২৬০ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ৩৩ ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদপ্রার্থী ১৮৩ জন এবং ১১ সংরক্ষিত ওয়ার্ডে নারী কাউন্সিলর প্রার্থী ৬৮ জন। নির্বাচন কর্মকর্তার ভাষ্য :রিটার্নিং কর্মকর্তা আব্দুল বাতেন বলেন, দুপুরে ভোট কিছুটা ধীরগতিতে হয়েছে। কোনো কোনো কেন্দ্রে আঙুলের ছাপজনিত সমস্যায় ভোটাররা ভোগান্তিতে পড়েন। তাঁদের একটি ভোট দিতে ১৫ থেকে ২০ মিনিট সময় লেগে যায়। দুপুরের পর থেকে ভোট গ্রহণের হার অনেক বেড়েছে বলে তিনি দাবি করেন। সুশৃঙ্খল ভোট হয়েছে-সিইসি :ভোট গ্রহণ শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বিকেলে ঢাকায় নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের বলেন, ভোটের হার ৬০ শতাংশের কমবেশি হতে পারে। তবে মেয়র পদে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফা ইভিএমের 'ত্রুটি' এবং ভোট গ্রহণে ধীর গতির অভিযোগ করেছেন। ইভিএম জটিলতায় তাঁর নিজেরও ভোট দিতে আধা ঘণ্টা দেরি হয়েছে। জাপা প্রার্থীর অভিযোগ 'অসত্য নয়' মন্তব্য করে সিইসি বলেন, ব্যালট পেপারের প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে ইভিএমের ভোটে কিছুটা ধীরগতি হতে পারে। এর আগে ঢাকার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে স্থাপিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে রংপুরে কেন্দ্রে কেন্দ্রে বসানো সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে ভোটের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন সিইসি। সিসি ক্যামেরায় কেন্দ্র পরিস্থিতি দেখে তিনি বলেন, প্রচুর ভিড় আছে। যেহেতু ভোটটা ধীরে হয়, বাইরে প্রচুর ভিড় আছে এবং আগ্রহী ভোটারের সংখ্যা কম নয়। বিকেল সাড়ে ৪টায় ভোট শেষে সিইসি বলেন, রংপুর সিটি নির্বাচন অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ হয়েছে। রংপুরে ভোটগ্রহণ সুশৃঙ্খলভাবে হয়েছে মন্তব্য করে সিইসি বলেন, ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ, আগ্রহ, উদ্দীপনা, আনন্দঘন পরিবেশ পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রথম থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য সহযোগিতা করে আসছেন, তাঁরা সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে আছেন।