বিএনপি ও জোটের অর্ধডজন প্রার্থী, জামায়াতের রমজান

তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনায়েম খান ও দেশের প্রথিতযশা শিল্পপতি জহুরুল ইসলামের এলাকা কিশোরগঞ্জ-৫ (বাজিতপুর-নিকলী) আসন। এক সময়ের মুসলিম লীগের দুর্গ হিসাবে পরিচিত এই আসনটি পরবর্তী সময়ে বিএনপির ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠে। গুরুত্ব বিবেচনায় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকার এ আসনটির প্রাচীন জনপদ বাজিতপুরকে মহকুমা শহর হিসাবে উন্নীত করার জন্য ভূমি অধিগ্রহণ কাজও সম্পন্ন করেছিল। গড়ে তোলা হয়েছিল আদালত ও কারাগার। বিমান-হেলিকপ্টার উঠানামার জন্য তৈরি করা হয়েছিল মিনি এয়ারপোর্টও। বর্তমানে এয়ারপোর্টটির তত্ত্বাবধান করছে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। সবকিছু মিলিয়ে এটি জেলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আসন। আর এজন্য পতিত স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিগত দিনে কিশোরগঞ্জ-৫ আসনে প্রতিপক্ষ দলের প্রার্থীকে কোণঠাসা করে নিজ দলের পক্ষে ফলাফল নিতে নারকীয় নিপীড়ন-নির্যাতনের আশ্রয় নেয়। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এখানে ইতোমধ্যেই ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, পৌরসভা ও উপজেলা ইউনিটের সাংগঠনিক কাঠামো নবায়নের কাজ শেষ করেছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। শুরু হয়েছে দলীয় কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি ব্যাপক সভা-সমাবেশ ও গণসংযোগ কার্যক্রম। সম্ভাব্য প্রার্থীদের পোস্টার-ব্যানার, দেওয়াল লিখনে ছেয়ে যাচ্ছে গোটা নির্বাচনি এলাকা। কোথাও কোথাও প্রার্থীদের সমর্থনে তৈরি হচ্ছে সুদৃশ্য তোরণ। নিজ বাড়িতে দানবীয় হামলা ও নির্যাতনের শিকার বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সহসভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান ইকবাল এগিয়ে থাকলেও দলে এবং জোটে সব মিলিয়ে হাফ ডজন মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন। বিএনপির অন্যান্য সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হচ্ছেন-বিএনপি নেতা ও সাবেক পৌর মেয়র এহসান কুফিয়া, জেলা বিএনপির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও নিকলী উপজেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট বদরুল মোমেন মিঠু, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির গণযোগাযোগ বিষয়ক সম্পাদক এএম জামিউল হক ফয়সাল, জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিঠির সহ-সাধারণ সম্পাদক হাজী মাশুক মিয়া। বিগত দিনগুলোতে মনোনয়ন পাওয়া এবং এবার বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী শেখ মুজিবুর রহমান ইকবাল বলেন, আমি দলের চরম দুর্দিনে নেতাকর্মীদের পাশে থেকে জুলুম-নির্যাতন ও হামলা-মামলার শিকার হয়েছি। নেতাকর্মীদের নিয়ে অনেক সময় হাওড় এলাকার নদীতে নৌকায় কিংবা জঙ্গলে রাত কাটিয়েছি। বিএনপির মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে গিয়ে আমি সরকারের রোষানলে পড়ে নিজ বাড়িতেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দানবীয় তাণ্ডবের শিকার হয়েছি। আমার বাড়ি ঘিরে রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন হাজার-হাজার গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেল ছুড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করে। এ সময় সাউন্ড গ্রেনেডে আমার এক নিবেদিত প্রাণ কর্মীও নিহত হন। সে ঘটনা পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতাকেও হার মানায়। এমন সব নিপীড়ন-নির্যাতনের পরও আমি সরে দাঁড়াইনি। দলের নির্দেশ ও কর্মসূচি পালনে অবিচল ছিলাম। এবার স্বৈরাচারমুক্ত পরিবেশে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে দলকে এ আসনটি ফিরিয়ে দেওয়ার প্রত্যাশায় রাত-দিন কাজ করে যাচ্ছি। তবে, এ আসনটি থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদাও মাঠে রয়েছেন। তাকে সহযোগিতা করার জন্য ইতোমধ্যেই কেন্দ্রীয় বিএনপি বার্তা পাঠিয়েছে। ফলে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও সহযোগিতা করছেন বিএনপি নেতারা। এ বিষয়ে কথা হলে বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, বিএনপির সঙ্গে আমরা জোটবদ্ধ আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলাম এবং আছি। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও বিএনপি জোটবদ্ধভাবে করবে বলে আমাদের সঙ্গে অঙ্গীকারবদ্ধ। আমি নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠে কাজ শুরু করেছি। বিএনপি কেন্দ্র থেকে ইতোমধ্যে আমাকে সহযোগিতা করার জন্য স্থানীয় বিএনপিকে নির্দেশনাও দিয়েছে। তাই ত্রয়োদশ নির্বাচনে আমি এ আসন থেকে বিএনপি জোটেরই একজন প্রার্থী হিসাবে মনোনীত হব বলে প্রত্যাশা করি। অপরদিকে, এ আসনটিতে কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার সদস্য জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির অধ্যাপক রমজান আলীকে প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। কথা হলে অধ্যাপক রমজান আলী বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে জামায়াতে ইসলামীর গ্রহণযোগ্যতা তৃণমূল পর্যায়েও বেড়েছে, বিস্তৃত হয়েছে। আমি দীর্ঘদিন ধরে এ আসনটির দুটি উপজেলার সর্বত্র গণসংযোগ ও প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। রাজনৈতিক সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সামাজিক ও মানবিক কর্মকাণ্ড ও কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছি। আমার বিশ্বাস এ আসন থেকে ভালো ফলাফল পাব। এ আসন থেকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের বাজিতপুর উপজেলার সভাপতি মুহাম্মদ শাহাদাত ভূঁইয়া দলীয় প্রার্থী হিসাবে গণসংযোগ ও প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) জেলা কমিটির সদস্য অধ্যাপক ফরিদ আহমেদও প্রার্থিতা ঘোষণা করে মাঠে রয়েছেন। তবে, জাসদসহ (রব) সমমনা অন্যান্য ডান-বাম ও ইসলামী দলগুলোর তৎপরতা এখনো দৃশ্যমান হয়নি। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, এ আসন থেকে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মঞ্জুর আহমেদ, ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী কেন্দ্রীয় বিএনপির ধর্মবিষয়ক সম্পাদক আমির উদ্দিন আহমেদ, ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থী একেএম খালেকুজ্জামান, ১৯৮৮ সালে সম্মিলিত বিরোধী দল ‘কপ’র প্রার্থী হিসাবে খন্দকার মফিজুর রহমান রোকন, ১৯৯১ সালে বিএনপির প্রার্থী আমির উদ্দিন আহমেদ, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী মজিবুর রহমান মঞ্জু, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী আমির উদ্দিন আহমেদ, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আফজাল হোসেন নির্বাচিত হন।