মূল্যস্ফীতির হার সংশোধন কাটছাঁট হচ্ছে এডিপি

২৬ ডিসেম্বর, ২০২২ | ৮:১৫ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখীর কারণে সরকার মুদ্রাস্ফীতির আগের হার সংশোধন করেছে। দুদফা বাড়িয়ে সংশোধিত মূল্যস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে অর্থ বিভাগ। যদিও চলতি অর্থবছরের শুরুতে প্রত্যাশা ছিল এটি ৫ দশমিক ৪ শতাংশের ঘরে থাকবে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবসহ নানা কারণে তা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়নি। অপরদিকে অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে এসে লক্ষ্যমাত্রা এক শতাংশ কমিয়ে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারও ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। শুরুতে প্রবৃদ্ধি ধরা হয় ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এছাড়া চলতি বাজেটের আকারও ২০ হাজার ৯৩ কোটি টাকা কাটছাঁট করা হয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল বৈঠকে উল্লিখিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এদিকে এই কাটছাঁটের কারণে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা থেকে কমে সংশোধিত বাজেটের আকার দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৫৭ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, অর্থনীতির বেশ কয়েকটি সূচক নতুন করে সমন্বয় করা হয়েছে। তবে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আয় খাতে হাত দেওয়া হয়নি। কারণ, বছরের শুরুতে যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, সেটি অর্জন করা সম্ভব হবে বলে মনে করছে অর্থ বিভাগ। এছাড়া বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) সরকারি অংশের বরাদ্দও কাটছাঁট করা হচ্ছে। সে অঙ্ক কমপক্ষে ২০ হাজার কোটি টাকা হবে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এডিপির এই কাটছাঁট মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কোনো ভূমিকা রাখবে না। বাজেট প্রণয়নের শুরুতে অনুমানের ভিত্তিতে প্রাক্কলন সঠিক ছিল না। জানতে চাইলে অর্থ বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, এ মুহূর্তে বিশেষ নজর দিতে হবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে। মূল্যস্ফীতির হার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে নিু ও মধ্যম আয়ের শ্রেণির মানুষ কষ্টে আছে। তবে এডিপি থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা কাটছাঁট মূল্যস্ফীতিতে কোনো প্রভাব ফেলবেন না। তিনি আরও বলেন, জিডিপির প্রবৃদ্ধি কম বা বেশি হচ্ছে, এটি মানুষ দেখবে না। সাধারণ মানুষ দেখবে চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য কমছে কি না। বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার সরকারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি বিরাজ করছে। ফলে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতির নতুন যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটিও অনেক বেশি। এটি আরও কমিয়ে আনতে হবে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান শনিবার বলেন, সরকার এডিপির অংশ থেকে কাটছাঁট করছে ২০ হাজার কোটি টাকা। এটি মোট বাজেটের তুলনায় কিছুই না। এ পদক্ষেপ মূল্যস্ফীতি কমাতে কোনো কাজে আসবে না। তিনি আরও বলেন, বাজেট প্রণয়নের আগেই বৈশ্বিক সংকটের আলামত ছিল। কারণ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ গত ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয়। ওই সময় মুদ্রার বিনিময় হার, বৈশ্বিক কারণে মূল্যস্ফীতি এবং টাকার অবমূল্যায়নে মূল্যস্ফীতি উসকে যেতে পারে, সেগুলো আমলে নেওয়া দরকার ছিল। ফলে অনুমানের ভিত্তিতে যে প্রাক্কলন করা হয়েছে, তা সঠিক হয়নি। এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, গড় মূল্যস্ফীতি কমলেও ভোক্তা মূল্যস্ফীতি কমছে না। মূল্যস্তর উঁচুতে থেকে যাচ্ছে; কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমছে। এতে ভোক্তার উপকার আসবে না। এখন সরকারকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বেষ্টনীর আকার শক্তিশালী, খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি কর্মসূচি সম্প্রসারণের পাশাপাশি পণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনাকে আরও উন্নত করতে হবে। সূত্রমতে, আগামী দিনের মূল্যস্ফীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটি বিবেচনায় আনতে বিগত ৫ মাসের মূল্যস্ফীতির ওপর একটি সমীক্ষা করেছে অর্থ বিভাগ। সেখানে দেখানো হয়, আগামী অর্থবছরে (২০২৩-২৪) মূল্যস্ফীতি পর্যায়ক্রমে কমে আসবে। তবে চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় তার তুলনায় বেশি হবে। সমীক্ষায় বলা হয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শিগগিরই বন্ধ হবে-এমনটি প্রত্যাশা মাথায় রেখে অর্থবছরের শুরুতে সরকার ৫ দশমিক ৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু আগস্টে সর্বকালের মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশে ওঠে। তবে সেপ্টেম্বর থেকে সেটি পর্যায়ক্রমে কমে আসে। সেপ্টেম্বরে একটু কমে তা হয়েছে ৯.১ শতাংশ, অক্টোবরে এই হার ছিল ৮.৯১ শতাংশ। সর্বশেষ পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বরাত দিয়ে বলেছেন, নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি কমে ৮.৮৫ শতাংশ হয়েছে। পর্যায়ক্রমে মূল্যস্ফীতির হার কমে আসার প্রবণতা বিশ্লেষণ করে অর্থ বিভাগ মনে করছে, শেষ পর্যন্ত গড় মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসবে। এজন্য সংশোধিত মূল্যস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, মূল্যস্ফীতির বড় অংশ নির্ভর করে চালের মূল্যের ওপর। অপরদিকে দেশে খাদ্যশস্যের বাম্পার ফলন হয়েছে। ধরে নেওয়া হচ্ছে, চলতি মাসে চালের মূল্য কমবে। এছাড়া প্রত্যাশা করা হচ্ছে আগামী দিনে আউসের ফলনও বাম্পার হবে। কারণ, ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে, বন্যার পর কৃষিজমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। এ বছর একটি বড় বন্যা হয়েছে। ফলে জমির উর্বরতা বাড়বে। এতে ফসলের উৎপাদনও ভালো হবে। আর অধিক উৎপাদনের প্রভাবে চালের মূল্য হ্রাস পেয়ে মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে আনতে নিয়ামক হিসাবে কাজ করবে। এ বছরের শুরুতে রাজস্ব আয় ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়। এটি অর্জন হবে-এমনটি ধরে অর্থ বিভাগ রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা কাটছাঁট না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সর্বশেষ তথ্যমতে, গত অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসের (জুলাই-নভেম্বর) তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত রাজস্ব আহরণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২ হাজার ২৬৪ দশমিক ৮২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে আদায় হয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার ৬২০ দশমিক ৭৭ কোটি টাকা। তবে এ বছর এডিপি থেকে কিছুটা কাটছাঁট করা হচ্ছে। এ বছর এডিপির আকার হচ্ছে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, কৃচ্ছ সাধনের জন্য অর্থ বিভাগ থেকে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এসব পদক্ষেপের কারণে এমনিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কম হবে। বিশেষ করে আগামী দিনগুলোয় আমদানি আরও হ্রাস পাবে। কারণ, ইতোমধ্যে আমদানি ব্যয় কমাতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তার প্রতিফলন গত নভেম্বর থেকে ঘটছে। এরই মধ্যে আমদানি ব্যয় কমতে শুরু করেছে। এছাড়া নানা কারণে একধরনের সংকট রয়েছে অর্থনীতিতে। যে কারণে চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা এক শতাংশ কমিয়েছে সরকার।