মা পাকিস্তানি, সন্তান ভারতীয়: রাজনীতির নির্মম বলি নয় মাসের শিশুর ভালোবাসা

বিদায়ের সময় হয়ে গেছে। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে জল ছলছল চোখে স্বামী ফারহানের হাত শক্ত করে ধরে ছিলেন সায়েরা। মুখে কালো নেটের বোরকা, কোলে তাদের নয় মাসের শিশুসন্তান আজলান। জায়গাটি আটারি-ওয়াঘা সীমান্ত, ভারত-পাকিস্তানের অন্যতম স্থলসীমান্ত। এই সীমান্তে এখন শুধু দু’দেশের নাগরিক নয়, মা-ছেলের ভালোবাসাও রাজনীতির নির্মম বলি হচ্ছে। শিশু আজলানকে কোলে নিয়ে সায়েরা ও ফারহান রাতভর সফর করে দিল্লি থেকে সীমান্তে এসে পৌঁছেছেন। দুজন দু’দেশের নাগরিক। কাঁটাতারের বেড়া আর ব্যারিকেড দিয়ে ঘেরা চেকপোস্টে তাদের একমাত্র পরিচয় পাসপোর্টের রঙ দেখে বোঝা যায়; সায়রার পাসপোর্ট সবুজ আর ফারহানের নীল। পাকিস্তানের করাচির মেয়ে সায়েরা। তিন বছর আগে ফেসবুকে দিল্লির যুবক ফারহানের সঙ্গে পরিচয়। তারপর প্রেম, বিয়ে, নতুন জীবনের শুরু—সবই হয়েছিল স্বপ্নের মতো। কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে হামলার পর ভারত সরকার পাকিস্তানি নাগরিকদের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার পাকিস্তানকে হামলার জন্য দায়ী করে; ইসলামাবাদ তা অস্বীকার করে নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছে। ফারহান ও সায়েরা চোখে জল নিয়ে সীমান্তে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। শেষবিদায়ের মুহূর্ত তখন। ফারহান তখন বলেছিলেন, আবার দেখা হবে ইনশাআল্লাহ, খুব শিগগিরই। আমি তোমাদের জন্য দোয়া করব। কিন্তু সে স্বপ্ন যেন মুহূর্তেই চূর্ণ হয়ে যায়! এক ভারতীয় সীমান্তরক্ষী হঠাৎ আজলানের পাসপোর্টের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, এই শিশুটি যেতে পারবে না, ম্যাডাম। ওর পাসপোর্ট নীল, ভারতীয়। সবকিছু বোঝার আগেই পরিবারটি ভেঙে গেল—সায়েরা চলে যান করাচির পথে, আর ফারহান শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে ফিরতে বাধ্য হন দিল্লিতে। আটারি-ওয়াঘা সীমান্ত।২৯ এপ্রিল, ২০২৫। ছবি: আল-জাজিরা ‘জীবন নয়, এ যেন নির্বাসন’ গত ২২ এপ্রিল পহেলগাঁওয়ে সশস্ত্র হামলায় নিহত হন ২৬ জন, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন পর্যটক। এরপর থেকেই ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক চরম উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠে। সীমান্তে টানা গুলি বিনিময়, কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা, বাণিজ্য স্থগিত, এমনকি সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি থেকেও ভারতের সরে আসার হুমকি—সব মিলিয়ে দুই দেশের সাধারণ মানুষ গভীর সঙ্কটে পড়ে গেছেন। এ সংকটের মধ্যে প্রায় ৭৫০ পাকিস্তানি নাগরিক ভারতে থেকে ফিরে গেছেন, আর পাকিস্তান থেকেও প্রায় এক হাজার ভারতীয় নাগরিক ফিরেছেন দেশে। এদের মধ্যে ৪৮ বছর বয়সি হালিমা বেগমও একজন। ২৫ বছর আগে করাচি থেকে বিয়ে করে ভারতের ওড়িশায় চলে এসেছিলেন তিনি। তখন জীবন ছিল শান্তিপূর্ণ। হালিমার স্বামী মারা গেছেন ৮ বছর আগে। দুই ছেলেকে নিয়ে থাকতেন ওড়িশায়। কিন্তু সম্প্রতি হঠাৎ একদিন পুলিশের হাতে পান ‘ভারত ছাড়ো’ নোটিশ। তিনি বলেন, আমি তো এখনকাই। এটা কি ন্যায়সঙ্গত? আমি খুব ভয়ে আছি। দুই ছেলে—২২ বছরের মুসায়িব ও ১৬ বছরের জুবায়ের। তারা চেয়েছিল মাকে একা না পাঠিয়ে কেউ একজন যাক সঙ্গে, কিন্তু উভয়ের পাসপোর্টই নীল। মায়েরটা সবুজ। সীমান্তরক্ষীদের সঙ্গে বহু অনুরোধ আর বাদানুবাদ করেও কাজ হয়নি। হালিমা জানিয়েছেন, করাচিতে তার কোনো স্থায়ী থাকার জায়গা নেই। বাবা-মা মারা গেছেন, ভাই পরিবার নিয়ে থাকেন কেবল দুই রুমের একটি ছোট্ট ফ্ল্যাটে। ‘হাজারটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে, কিন্তু কোনো উত্তর নেই,’ বলেই চোখ মুছলেন তিনি। বলেন, শুধু ছেলেদের নিরাপত্তার জন্য দোয়া করি। একদিন আবার মিলিত হবো ইনশাআল্লাহ। সাংবাদিকদের দেশ ছাড়ার একটি নোটিশ দেখাচ্ছেন এক নারী। ছবি: আল-জাজিরা ‘শুধু মা-ই জানে সেই যন্ত্রণার গভীরতা’ সীমান্তে দাঁড়িয়ে ফারহান, সায়েরা আর তাদের আত্মীয়রা। ফারহানের কোলে আজলান। দুধের ফিডারের মাথাটা আজলানের মুখে গুঁজে দেন ফারহান। ‘কিন্তু সে (আজলান) তো ফিডার পছন্দ করে না, সে তো মায়ের স্পর্শ চেনে,’ বললেন ফারহানের বোন নূরিন। তারা সবাই এসেছিলেন সায়েরাকে বিদায় জানাতে। নূরিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এই দুই দেশের ক্ষমতাধররা যুদ্ধ করছে, আর নিরীহ শিশুদের জীবন নষ্ট হচ্ছে। ধিক্কার! হঠাৎ ফারহানের নাম ধরে ডাকলেন এক সীমান্তরক্ষী। সেই ডাকে দৌড়ে ছুটে গেলেন তিনি। ভেবেছিলেন, হয়তো আজলানকে মায়ের সঙ্গে যাওয়ার অনুমতি দেবেন তিনি। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পর ভেজা চোখে ফিরে এলেন ফারহান। তখন ভীষণ চিৎকারে কাঁদছিল আজলান। ‘সীমান্ত পারি দেওয়ার সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল সায়েরা, জ্ঞান ফেরার পরও সে কাঁদছিল’, বলেন ফারহান। পুরনো দিল্লির বাসিন্দা ফারহান একজন ইলেকট্রিশিয়ান। স্ত্রী সায়েরার আগমনে তার জীবন বদলে গিয়েছিল। এখন আবার সব বদলে গেছে, কিন্তু এ বদল মৃত্যুসম। ফারহানের মা আয়েশা বেগম। ভাঙা পা নিয়ে এসেছিলেন ছেলের সঙ্গে। তিনি আবেগময় কণ্ঠে বলেন, এসব অন্ধ প্রেমের শাস্তি। নরকের সঙ্গে প্রেম করো, তবুও পাকিস্তানে প্রেম করো না।