বন্ধ ট্রেন চালুর উদ্যোগ নেই

২৪ ডিসেম্বর, ২০২২ | ৬:৫৪ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

২০০৬ থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ১০৫ জোড়া ট্রেন বন্ধ হয়েছে। মেইল, লোকাল ও কমিউটার নামে সাধারণ মানুষের ট্রেনগুলো কবে চালু হবে-উত্তর নেই খোদ রেল কর্মকর্তাদের কাছেও। গত এক যুগে নতুন করে ১৪২টি ট্রেন চালু হয়েছে। অথচ, বন্ধগুলো চালু করা হয়নি। বন্ধ একেকটি ট্রেনে গড়ে ৫০০ লোক উঠলে প্রতিদিন যাত্রীর সংখ্যা দাঁড়ায় সংখ্যা ১ লাখ ৫ হাজার, বছরে ৩ কোটি ৭৮ লাখ। এছাড়া এসব ট্রেনে পণ্যবাহী বগি থাকায়, স্থানীয় ভাবে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের মালামাল বহন করা সহজ ছিল। কিন্তু এখন এসব কিছু থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ যাত্রীরা। রেলপথমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, বন্ধ ট্রেনগুলো চালু করতে বলা হয়েছে। করোনা স্বাভাবিক হওয়ার পর বন্ধ অনেক ট্রেন চালু হয়েছে। বন্ধ সবকটি ট্রেন চালু করতে হলে কোচ-ইঞ্জিন এবং জনবল খুবই জরুরি। একই সঙ্গে বন্ধ স্টেশনগুলো চালু করতেও স্টেশন মাস্টারসহ কোচ-ইঞ্জিন প্রয়োজন। কোচ-ইঞ্জিন আনা হচ্ছে। স্টেশন মাস্টারসহ প্রয়োজনীয় লোকবলও নিয়োগ হচ্ছে। আশা করি, বন্ধ ট্রেন, স্টেশন পর্যায়ক্রমে চালু হবে। জানা গেছে, পশ্চিমাঞ্চল রেলে বর্তমানে মেইল, কমিউটার ও লোকাল ট্রেন চলছে ১১১টি। অপরদিকে ২০০৬ সালের ১২ মে থেকে ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট পর্যন্ত ৪৯ জোড়া অর্থাৎ ৯৮টি যাত্রীবাহী ট্রেন বন্ধ রয়েছে। পূর্র্বাঞ্চল রেলে মেইল, কমিউটার ও লোকাল ট্রেন চলছে ১৪২টি। অপরদিকে ২০২০ সালের ৩ মার্চ থেকে ২০২২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৬ জোড়া অর্থাৎ ১১২টি ট্রেন বন্ধ রয়েছে। একেকটি ট্রেন গন্তব্যে থেকে ছেড়ে আবার ফিরে এলে দুটি ট্রেন ধরা হয়। ঢাকা-চট্টগ্রামগামী ট্রেন যাত্রী আমিনুর রহমানের (৮২) ভাষ্য, ‘জালালাবাদ এক্সপ্রেস স্বাধীনতার আগ থেকেই চলাচল করত। রেলওয়ে কর্মকর্তাদের সাহস হয় কী করে, ঐতিহ্যের, সাধারণ মানুষের এসব ট্রেন বছরের পর বছর ধরে বন্ধ রাখে। রেলপথমন্ত্রী আসে-যায়-নতুন ট্রেনও উদ্বোধন করেন। কিন্তু, অতি সাধারণ মানুষের ট্রেনগুলো চালুর কোনো উদ্যোগই নেয় না। পরিবহণ দপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বহু বন্ধ ট্রেনের কোচ দিয়ে জোড়াতালির মাধ্যমে নতুন ট্রেন উদ্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু, বন্ধ ট্রেনগুলো চালুর কোনো উদ্যোগই নেওয়া হচ্ছে না। রেলপথ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে বন্ধ ট্রেনের একটি বিশেষ তালিকা এসেছে। তালিকায় ২০০৬ সালে লালমনিরহাট-বুড়িমারী রুটে চলাচলকারী ‘মিশ্র-৪৫১/৪৫২’ নামের এক জোড়া যাত্রীবাহী ট্রেন বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে ওই পথের সাধারণ যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পোহাচ্ছেন। এরকম প্রায় অর্ধশতাধিক ট্রেন বন্ধের অন্যতম কারণ হিসাবে-মন্তব্যের ঘরে লেখা রয়েছে, ‘কোচ, ইঞ্জিন ও ক্রুর অভাবে’। বন্ধ মোট ট্রেনের গড় মন্তব্যের ১২টি স্থানে লেখা রয়েছে ‘করোনাকালীন সময় থেকে গার্ড, ইঞ্জিন, ক্রু এবং কোচ স্বল্পতা।’ জানা যায়, ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত ৫৪০টি যাত্রীবাহী কোচ, ৭৪টি লোকোমোটিভ, ২০ সেট এমজি ডেমু, ৫১৬টি ওয়াগন এবং ৩০টি বগি ব্রেক ভ্যান, ২টি রিলিফ ক্রেস রেলবহরে যুক্ত হয়। এসব কোচ কিংবা লোকোমোটিভ দিয়ে একটি লোকাল-মেইল ট্রেনও চালু করা হয়নি। বন্ধ প্রায় শত জোড়া লোকাল-মেইল ট্রেনের একটিও চালু হয়নি। প্রকৌশল দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘নতুন কোচ-ইঞ্জিন আসার আগ থেকেই স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ওতপেতে থাকেন। রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরাও এদের হয়ে বিভিন্ন রুটে ‘নতুন ট্রেন’ চালু করেন। রাজনৈতিক কারণে চালু এসব ট্রেনও টানা লোকসান গুনছে। একাধিক স্টেশন মাস্টার জানান, মেইল লোকাল ট্রেনের যাত্রীরা টিকিট কাটতে চাইলেও সহজে তা করতে পারেন না। বুকিং সহকারীরা ব্যস্ত থাকেন আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিটি বিক্রির ক্ষেত্রে। রেলের ইতিহাসে সরকারি ভাবে চলা মেইল-লোকাল কিংবা কমিউটার ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি হয়নি। বন্ধ ট্রেন চালুর জন্য রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলা উপজেলায় মানববন্ধন হলেও রেল কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করেনি। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, নতুন ট্রেন চালু-গুরুত্বহীন স্টেশনে আন্তঃনগর ট্রেনের বিরতির জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ডিও লেটার দিচ্ছেন। কিন্তু, একটিবারের জন্যও উনারা বন্ধ ট্রেন চালুর বিষয়ে ডিও লেটার কিংবা সোচ্চার হচ্ছেন না। এমন অভিযোগ স্থানীয় যাত্রীদের মুখে মুখে। স্থানীয় লোকজন বলছেন, রেলওয়ে পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চল জেলাগুলোতে গণপরিবহণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লোকাল-মেইল ট্রেন। সেই ট্রেন বন্ধ থাকলে সাধারণ মানুষের অসুবিধা হবে এটাই স্বাভাবিক। শুধু ট্রেন বন্ধ নয়, বর্তমানে ১১০টি স্টেশনও বন্ধ রয়েছে। স্টেশন এবং ট্রেন বন্ধ থাকায় স্টেশনকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যও লাটে উঠছে। অথচ বছর শেষে ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত টাকায় দোকানের লাইসেন্স নবায়ন করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, ট্রেন সাধারণ মানুষের বাহন হিসাবে রাখতে চাচ্ছেন না রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরাই। রেল কর্তৃপক্ষ সাধারণ মানুষের জন্য যে ট্রেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেই ট্রেনগুলোই বন্ধ রেখেছে। করোনা নিয়ন্ত্রণে এসেছে প্রায় দেড় বছর আগে-কিন্তু ওই সময় যে সব ট্রেন বন্ধ করে রাখা হয়েছিল, সেগুলোর অধিকাংশ এখনো বন্ধ। তাছাড়া বছরের পর বছর যাত্রীবাহী ট্রেন বন্ধ রাখলেও এর কোনো জবাবদিহিতা নেই। রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলী বলেন, ‘আমরা ট্রেন বন্ধ রাখতে চাই না। সব ট্রেন চালাতে চাই। কিন্তু, আমাদের লোকবলের স্বল্পতা রয়েছে। কোচ, ইঞ্জিনসহ চালক ও গার্ডের অভাব আছে। বহু স্টেশন বন্ধ । একটি ট্রেন সম্পূর্ণ রুপ পেলে, সেই ট্রেন আমরা পরিচালনা করি। আমরা চাই, বন্ধ ট্রেন চালু হোক। এতে রেলের আয় বাড়ার সঙ্গে স্থানীয় ট্রেন যাত্রীদের সেবাও নিশ্চিত হবে। রেলওয়ে মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. কামরুল আহসান বলেন, বন্ধ ট্রেনগুলো চালুর বিষয়ে আমরা খুবই গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। কিন্তু, সবচেয়ে বড় সমস্যা কোচ, ইঞ্জিন এবং লোকবল পাওয়া যাচ্ছে না। যেসব নতুন ইঞ্জিন-কোচ আসছে সেগুলো দিয়ে বন্ধ ট্রেন চালু করা যাচ্ছে না কেন? নতুন ইঞ্জিন কোচ দিয়ে নতুন ট্রেন এবং পুরাতন রেক পালটানো হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি, বন্ধ ট্রেনগুলো পর্যায়ক্রমে চালু করতে। কবে চালু হতে পারে? সেটা বলা যাচ্ছে না। কোচ ইঞ্জিন হলেই চালু শুরু হবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক বলেন, রেলে উন্নয়ন হচ্ছে কিন্ত উন্নয়নের সুফল যথাযথ পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। বন্ধ স্টেশন এবং ট্রেনগুলো স্থানীয় মানুষের জন্য গর্বের-অহংকারেরও। কিন্তু, রাজনৈতিক এবং রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা না থাকার কারণে স্টেশন এবং ট্রেনগুলো চালু হচ্ছে না। বন্ধ ট্রেনগুলো ঘিরে স্থানীয় ভাবে অর্থনৈতিক বিষয়গুলো জড়িত। যা থেকে সাধারণ মানুষ চরম ভাবে বঞ্চিত হচ্ছে।