হরিলুটের চিত্র মিলল ছিঁচকে চুরির তদন্তে

২০ ডিসেম্বর, ২০২২ | ৮:৩৩ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

একটি ছিঁচকে চুরির ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে হরিলুটের চিত্র। এ ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) নারায়ণগঞ্জের ‘খানপুর কেন্দ্রীয় গুদামে’। উঁচু প্রাচীর দেওয়া বাউন্ডারির মধ্যে আটটি গুদামের একটিতেই হদিস মেলেনি ১৭১ ধরনের (আইটেম) ৪৩৮২ সেট যন্ত্রাংশ। এসব যন্ত্রাংশের দাম প্রায় ৯ কোটি টাকা। এ ছাড়াও ওই গুদামের লেজারেই অন্তর্ভুক্ত নেই আরও সাড়ে সাত কোটি টাকার ১৮১ ধরনের এক হাজারের বেশি যন্ত্রাংশ। সব মিলিয়ে সন্ধান না পাওয়া এসব যন্ত্রাংশের দাম প্রায় ১৭ কোটি টাকা। চুরির ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ বের করতে গিয়ে যন্ত্রাংশ উধাওয়ের চিত্র উঠে এসেছে সংস্থাটিরই এক প্রতিবেদনে। এসব যন্ত্রাংশের হদিস না পাওয়ার ঘটনায় কার কী দায়দায়িত্ব ছিল তা নির্ধারণে গত ১৩ ডিসেম্বর আরেকটি কমিটি গঠন করেছে বিআইডব্লিউটিএ। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, হরিলুটের এমনই আরেকটি ঘটনা ঘটেছে নারায়ণগঞ্জ বন্দর বিভাগে। ওই বিভাগের ৩০ লাখ ৫২ হাজার টাকার সরকারি পে-অর্ডার বিক্রি করে টাকা নিয়েছেন সংস্থাটির এক সিবিএ নেতা। ২০২০ সাল থেকে চলতি অর্থবছর সরকারের নামে জমা পে-অর্ডারের এ পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেন ওই নেতা। তিনি বিআইডব্লিউটিএ’র বন্দর ও পরিবহণ বিভাগের সহকারী এবং নারায়ণগঞ্জ সিবিএর পদধারী নেতা। সম্প্রতি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বিষয়টি ধরা পড়ার পর ওই টাকা ফেরতও দেন তিনি। এ ঘটনায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। যন্ত্রাংশ হারানোর প্রতিবেদন পাওয়ার কথা জানিয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক বলেন, ক্রয় ও সংরক্ষণ বিভাগের আওতাধীন ওই গুদামে মনিটরিংয়ের অভাব ছিল। এ বিভাগটি দুর্বলভাবে সাজানো হয়েছে। এসব কারণে এমনটি হয়ে থাকতে পারে। একটি প্যাকেজের সব যন্ত্রাংশ না পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা অস্বাভাবিক ঘটনা। এর সঙ্গে কারা জড়িত তা নির্ধারণে একটি কমিটি করা হয়েছে। এ ছাড়া বাকি গুদামের যন্ত্রাংশ সঠিক আছে কনিা- তাও পর্যায়ক্রমে খতিয়ে দেখা হবে। এদিকে হরিলুটের এসব ঘটনা প্রকাশ হওয়ায় বিআইডব্লিউটিএ’র ভেতরে তোলপাড় চলছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, বিআইডব্লিউটিএতে রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনিয়ম ও দুর্নীতি জেঁকে বসেছে। এসব ঘটনা তারই অন্যতম বহিঃপ্রকাশ। এতেই বুঝা যায়, সংস্থার আর্থিক ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলা নাজুক হয়ে পড়েছে। তারা জানান, সংস্থাটির স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর অসাধু কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী একাধিক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। ওইসব সিন্ডিকেটের কারণে অনিয়ম ও দুর্নীতি সহসা ধরা পড়ে না। যেগুলো ধরা পড়ে, সেগুলো আবার ধামাচাপা পড়ে যায়। যেভাবে বের হয় এ চিত্র : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জের খানপুরে একই প্রাচীরের ভেতরে আটটি গুদাম রয়েছে। গুদামে ড্রেজিং, যান্ত্রিক ও নৌ-প্রকৌশল, নৌ-সংরক্ষণ ও পরিচালন এবং প্রকৌশল- এই চার বিভাগের কেনা যন্ত্রাংশ মজুত করা হয়। এটিই বিআইডব্লিউটিএ’র সবচেয়ে বড় সংরক্ষণাগার। কুরবানির ঈদের গত ৮-১১ জুলাই চার দিনের সরকারি ছুটির কোনো এক সময়ে ৮ নম্বর গুদামের দেয়ালের একটি এডজাস্ট ফ্যান খুলে সেখান দিয়ে চোর ঢুকে সংরক্ষিত যন্ত্রাংশ চুরি করে। চুরির ওই ঘটনায় ধরা পড়ে গত ১৭ জুলাই। এ ঘটনায় স্থানীয় থানায় চুরির মামলা হয়। ওই ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণে গত ২৫ জুলাই সংস্থাটির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) আহম্মদ সাঈদের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হলেও গত ৩ নভেম্বর তা জমা পড়ে। ওই প্রতিবেদনের যন্ত্রাংশ না পাওয়ার ঘটনায় কার দায়-দায়িত্ব ছিল তা নির্ধারণে গত ১৩ ডিসেম্বর সংস্থাটির নিরীক্ষা বিভাগের পরিচালক ছিদ্দিকুর রহমানের নেতৃত্বে আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রায় ৯ কোটি টাকার যন্ত্রাংশের হদিস নেই : শুধু ৮ নম্বর গুদামে কী কী যন্ত্রাংশ থাকার কথা এবং কী কী যন্ত্রাংশ নেই তা উল্লেখ করে বিআইডব্লিউটিএ’র আট কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত কমিটি গত ১৩ নভেম্বর ২৭ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে গুদামের সার্বিক হ-য-ব-র-ল অবস্থা, হদিস না পাওয়া যন্ত্রাংশের তালিকা ও দাম, যত্রতত্র যন্ত্রাংশ ফেলে রাখা এবং গুদামের নাজুক নিরাপত্তা ব্যবস্থা তুলে ধরা হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, ড্রেজার, নৌযান ও এক্সকেভটরের ১৭১ ধরনের চার হাজার ৩৮২টি বা সেট যন্ত্রাংশ পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এসব মালামাল কম পাওয়া গেছে বা চুরি হয়েছে।’ এসব যন্ত্রাংশের দাম উল্লেখ করা হয়েছে আট কোটি ৯৩ লাখ ২৮ হাজার ৯৮০ টাকা। হদিস না পাওয়া যন্ত্রাংশের মধ্যে রয়েছে ইয়ানমার ইঞ্জিনের তিনটি লুব ওয়েল কিলার; যার একেকটি কেনা হয় ২১ লাখ ২৪ হাজার ৬৮২ টাকা দরে। দুটি স্পিড র‌্যাম গুদামে পাওয়া যায়নি। এর একেকটি কেনা হয় ১১ লাখ পাঁচ হাজার টাকা দরে। গড়াই জাহাজের পাঁচটি প্রপেলার শ্যাফট বুশ গুদামে থাকার কথা থাকলেও কমিটি তা খুঁজে পায়নি। সেগুলোর দাম ১৩ লাখ ৬১ হাজার টাকা। একই জাহাজের তিনটি রাডারও পাওয়া যায়নি। যেগুলো ১৬ লাখ ৩৩ হাজার টাকা ব্যয়ে কিনেছিল বিআইডব্লিউটিএ। প্রতিবেদনে কোন আইটেমের কতটি যন্ত্রাংশ ছিল এবং কতগুলো আছে তারও বিবরণ উল্লেখ রয়েছে। তবে এসব ঘটনায় কারা দায়ী তা প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই। যদিও এটি নির্ধারণ করার এখতিয়ার কমিটির ছিল না। তবে গুদামে দীর্ঘদিন ধরে হরিলুট চলছে বলে মনে করেন তদন্ত কমিটিরই একাধিক সদস্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তারা জানান, এডজাস্ট ফ্যানের জন্য দেওয়ালে যেটুকু ফাঁকা রয়েছে, সেই ফাঁকা অংশ দিয়ে চোর ঢুকে চুরি করেছে বলে গুদামের দায়িত্বরতা দাবি করছে। অথচ ওই ফাঁকা অংশে একটি শিশু ঢুকতে পারবে। সেখান দিয়ে বড় মানুষ ঢুকতে পারার কথা নয়। এ ছাড়া যেসব যন্ত্রাংশ হারানোর কথা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তার অনেকগুলোর আকার এত বড় যে ওই ফাঁকা দিয়ে বের করা সম্ভব নয়। চুরি হলেও গুদামের দরজা বন্ধ ছিল। এসব যন্ত্রাংশ চুরি হিসাবে দেখানোর চেষ্টা চলছে। মূলত ওইসব যন্ত্রাংশ হরিলুট হয়েছে অথবা গ্রহণ না করেই বিল দেওয়া হয়েছে। এখন দায় এড়াতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা একে অপরকে দোষারোপ করছেন। এমনকি গুদামের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কমিটির কাজে অসহযোগিতা করেছে। সাড়ে সাত কোটি টাকার যন্ত্রাংশ অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন : প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬/৯৩৪ নম্বর চুক্তির আওতায় কেনা প্যাকেজ ‘ডি’ মালামাল লেজারে খতিয়ানভুক্ত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’ তবে প্রতিবেদনে ওই মালামালের মূল্য, কতটি যন্ত্রাংশ ছিল, সেগুলো গুদামের তালিকায় ছিল কিনা সে বিষয়ে স্পষ্ট করা হয়নি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই প্যাকেজের আওতায় ১৮১ ধরনের এক হাজারের বেশি যন্ত্রাংশ কেনে বিআইডব্লিউটিএ। যার দাম প্রায় সাড়ে সাত কোটি টাকা। ভোস্তা এলএমজি-কর্ণফুলি এসব যন্ত্রাংশ সরবরাহ করেছিল। কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্সের মালিক প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার এমএ রশিদ এ খাতের একজন প্রভাবশালী ঠিকাদার। যন্ত্রাংশ গুদামে থাকলে তা লেজারে অন্তর্ভুক্ত থাকবে- এটাই নিয়ম। এসব যন্ত্রাংশের বিষয়ে জানতে চাইলে ২০ ড্রেজার ক্রয়সংক্রান্ত প্রকল্পের পরিচালক এবং যান্ত্রিক ও নৌপ্রকৌশল বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মো. আতাহার আলী সরদার বলেন, যন্ত্রাংশ বুঝে নিয়েছে কমিটি। সেগুলো গুদামেও নেওয়া হয়েছে- তার প্রমাণও আছে। সেখান থেকে যন্ত্রাংশ নিয়ে ড্রেজারগুলো মেরামতও করা হয়েছে। তবে কেন লেজারভুক্ত করা হয়নি তা বোধগম্য নয়।