দুর্নীতির তদন্ত ধামাচাপা পাঁচ দফায় পদোন্নতি

বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) অনুষ্ঠান নির্বাহী মাহবুবা ফেরদৌস। তৃতীয় শ্রেণির ‘ট্রান্সমিশন/ভিটিআর রেকর্ড কিপার’ পদে তার চাকরি শুরু। এরপর পাঁচ দফায় পদোন্নতি বাগিয়ে প্রথম শ্রেণির অনুষ্ঠান নির্বাহীর পদে বসেছেন। জড়িয়েছেন অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নানা অপকর্মে। দুর্নীতির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং বিটিভি কর্তৃপক্ষ তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। বিটিভি কর্তৃপক্ষের তদন্তে ৭২ লাখ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়ায় তাকে বরখাস্তের সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি। পতিত সরকারের প্রভাবশালী দোসর হওয়ার সত্ত্বেও তিনি আছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। ধামাচাপা দিয়েছেন সব কমিটির তদন্ত কার্যক্রম। অভিযোগ আছে-অর্থের প্রভাবসহ নানাভাবে তিনি সবাইকে ম্যানেজ করে চলছেন। জুলাই বিপ্লবের পর বিটিভিকে ফ্যাসিস্টদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অনেককেই বদলি করা হয়েছে ঢাকার বাইরে। কিন্তু ভোল পালটে মাহবুবা ফেরদৌস এখনো আছেন বহাল তবিয়তে। শাস্তির বদলে উলটো তিনি অনেকটা ফাঁকা মাঠে বিটিভির ‘নিয়ন্ত্রণ কর্তা’ সেজেছেন। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তার বান্ধবী (দুজনের নামের কিছুটা মিল থাকায়) পরিচয়ে দাপট দেখাচ্ছেন। জেনারেল ম্যানেজার পদে বসতে করছেন দৌড়ঝাঁপ। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র ও প্রাপ্ত নথিপত্র থেকে পাওয়া গেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানতে চাইলে মাহবুবা ফেরদৌস বলেন, ‘আমি সরকারি চাকরি করি। আমাকে যেখানে যখন যে দায়িত্ব দিয়েছে, সেই দায়িত্ব পালন করেছি। আমি কোনো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নই।’ এক প্রশ্নের জবাবে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, বিটিভি ও দুদকের তদন্তের কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘তদন্ত কমিটি আমার কাছে যা জানতে চেয়েছে, আমি তাদের তা জানিয়েছি। পরে কমিটি কী করেছে, সেটা আমার জানার বিষয় নয়।’ বাংলাদেশ ফাইলস নামের অনুষ্ঠান তৈরি ও প্রচারের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান ও বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাকে অ্যাসাইন করা হয়েছিল বলে আমি ওই অনুষ্ঠান প্রযোজনা করেছি। ওটা আমার নিজের অনুষ্ঠান ছিল না।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে ও মেয়েজামাই স্কলারশিপ নিয়ে চায়নায় পড়াশোনা করছে। তাই মেয়ের কাছে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানে টাকা পাচার ও বিনিয়োগের তথ্য অপপ্রচার ছাড়া কিছুই নয়। ঢাকায়ও আমার নামে কোনো সম্পদ নেই।’ সাবেক দুই তথ্যমন্ত্রী ও ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতায় পদোন্নতি বাগানোর বিষয়ে বলেন, ‘চাকরি করলে স্যারদের স্যার বলতে হয়। তারা কোনো কাজে ডাকলে যেতে হয়। এটা অন্যায় না। আমি প্রমোটি অফিসার, এটা আমার অযোগ্যতা নয়।’ জানা যায়, চাকরির সার্কুলার ছাড়াই বিশেষ কায়দায় ১৯৯৫ সালে বিটিভির তৃতীয় শ্রেণির ‘ট্রান্সমিশন/ভিটিআর রেকর্ড কিপার’ পদে চাকরিতে যোগ দেন মাহবুবা ফেরদৌস। প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন মহাপরিচালকসহ তিন শীর্ষ কর্মকর্তার যোগসাজশে এই চাকরি বাগিয়েছিলেন তিনি। এরপর থেকে প্রভাবশালীদের সংস্পর্শে থাকায় তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক পদোন্নতি বাগিয়ে ২০০৩ সালে তিনি বনে যান প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা। এরপর আরও ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। সবশেষ ২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পদোন্নতি পেয়ে তিনি অনুষ্ঠান নির্বাহীর পদে বসেন। এছাড়াও বিটিভির সাবেক এক পরিচালকের হাত ধরে সৃষ্টি করেন ভিন্ন নজির। অনুষ্ঠান বিভাগের বহু কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করে শুধু মাহবুবার জন্য তৈরি করা হয় বাড়তি একটি উপস্থাপন সম্পাদকের পদ। এরপর তার অনিয়ম-দুর্নীতি চলতে থাকে লাগামহীনভাবে। তার এসিআর-এ ৪০ মার্কসহ প্রতিস্বাক্ষরকারী কর্মকর্তার কঠিন বিরূপ মন্তব্য থাকার পরও তার পদোন্নতি কেউ ঠেকাতে পারেনি। সংশ্লিষ্টরা জানান, পাঁচবার পদোন্নতি পেয়েছেন তিনি। সরকারি চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী এ রকম পদোন্নতির ঘটনা বিরল। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বেপরোয়া মাহবুবা ফেরদৌস ছিলেন সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগীদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ফ্যাসিবাদের দোসরদের নিয়ে বিশাল বিশাল বাজেটের অনুষ্ঠান নির্মাণ ও প্রচার করেছেন। তার পরিকল্পনা, পরিচালনা ও প্রযোজনায় ‘বাংলাদেশ ফাইলস’ নামের অনুষ্ঠানে শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালানো হয়। এই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ছিলেন সাংবাদিক ফারজানা রুপা (বর্তমানে কারাবন্দি)। এ অনুষ্ঠানের নামে বিপুল অঙ্কের অর্থ লোপাট করা হয়েছে। এছাড়াও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ফ্যাসিবাদ সমর্থিত শিল্পীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তৈরি করা ‘আলো আসবেই’ গ্রুপের অন্যতম সদস্য ছিলেন মাহবুবা। আওয়ামী লীগ শাসনের ১৬ বছরে প্রায় সব তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। প্রাপ্ত নথিপত্রে দেখা যায়, ‘শ্রেণিকক্ষে পাঠদান’ নামের একটি অনুষ্ঠান নির্মাণে বিপুল অর্থ উত্তোলন করে আত্মসাতের অভিযোগে ২০১৫ সালে তৎকালীন পরিচালক (অর্থ) ও যুগ্মসচিব পিয়ার মোহাম্মদকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তে অনুষ্ঠান নির্বাহী (সাবেক অধিবেশন নিয়ন্ত্রক) মাহবুবা ফেরদৌসের বিরুদ্ধে ৭২ লাখ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া যায়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির সাবেক মহাপরিচালক আব্দুল মান্নান মাহবুবাকে বরখাস্ত ও দুদকের মাধ্যমে তদন্ত করার অনুরোধ জানিয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি দেন। চিঠিতে বলা হয়, বিটিভির তৎকালীন অধিবেশন নিয়ন্ত্রক মাহবুবা ফেরদৌসকে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান ‘শ্রেণিকক্ষে পাঠদান’ নামক অনুষ্ঠান প্রযোজনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। অফিস আদেশে এ অনুষ্ঠান সপ্তাহে তিনদিন প্রচারের সিদ্ধান্ত দেওয়া হলেও পরবর্তী সময়ে তা বাড়িয়ে ৫ দিন করা হয়। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১৪-২০১৫ অর্থবছর পর্যন্ত ৫০ মিনিট ব্যাপ্তিকালের মোট ৭৯১টি অনুষ্ঠান ধারণ ও প্রচার করা হয়। কিন্তু এ অনুষ্ঠানের কাঙ্ক্ষিত ফল না পাওয়ায় বন্ধ করে দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানটি ধারণের জন্য অর্থব্যয়ে আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিপালনসহ অন্যান্য বিষয় তদন্তের জন্য গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। তদন্তে দেখা যায়, অনুষ্ঠান নির্মাণের নামে বিভিন্ন খাতে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে সরকারি খাত থেকে চেকের মাধ্যমে বিপুল টাকা উত্তোলনের পর আত্মসাৎ করেন মাহবুবা। ঢাকা কেন্দ্রের তৎকালীন জিএম এই অর্থ উত্তোলন ও আত্মসাতে সহায়তা করেছেন। এজন্য মাহবুবাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত ও আর্থিক দুর্নীতির বিষয়টি দুদককে দিয়ে তদন্তের অনুরোধ করা হয় চিঠিতে। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে মাহবুবার বিরুদ্ধে আজও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দুদক তার দুর্নীতির অভিযোগ আমলে নিয়ে বিভাগীয় তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চিঠি পাঠায় ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর। সেটাও ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। মাহবুবার বিরুদ্ধে আরও একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে ২০১৬ সালের ৭ জুন তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল তথ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন যুগ্মসচিব আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি ওই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর মাহবুবাকে নোটিশ করে। কিন্তু এসবে পাত্তা দেননি তিনি। এই কমিটির প্রতিবেদনও আর আলোর মুখ দেখেনি। সংশ্লিষ্টরা জানান, ফ্যাসিবাদের দোসর মাহবুবার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতার প্রমাণ থাকা সত্বেও রহস্যজনক কারণে তার বিরুদ্ধে এখনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। উলটো বড় একটি প্রকল্পের ফোকাল পয়েন্ট হিসাবে বহাল তবিয়তে আছেন। অভিযোগ আছে-‘শিশু, কিশোর-কিশোরী ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক প্রচার কার্যক্রম’ নামের এই প্রকল্পের দোহাই দিয়ে এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের শীর্ষপর্যায়ের এক কর্মকর্তার বান্ধবী পরিচয়ে এখনো তিনি দাপটের সঙ্গে আছেন। অভিযোগ আছে-আওয়ামী শাসনামলে তিনি দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ অর্থ উপার্জন করেছেন। মিরপুরে তৈরি করেছেন সাত তলা বাড়ি, কিনেছেন দুটি বিলাসবহুল গাড়ি। চীনে তিনি মেয়ের নামে বিপুল অর্থ পাচারের পর সেখানে বিনিয়োগ করেছেন। মেয়ে সেখানেই থাকেন। গত বছরের ৭ জুলাই তিনি মেয়ে ফারিয়াল ফেরদৌসের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা বলে স্বামী শামস আখতারকে সঙ্গে নিয়ে চীন ভ্রমণের জন্য ১০ দিনের বহিঃবাংলাদেশ ছুটি অনুমোদন করান।