রমজানজুড়ে ধ্বনিত হোক তারাবির সুর

পবিত্র রমজান মাসে মসজিদগুলো মুখরিত হয়ে ওঠে মুসল্লিদের পদচারণায়। মসজিদে মসজিদে মুসল্লিদের উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। অনেকে মসজিদে জায়গা না পেয়ে রাস্তায় জায়নামাজ বা কাগজ বিছিয়ে দাঁড়িয়ে যান খোদাপ্রেমে মশগুল হতে। নিশ্চয়ই এটা ইমানদীপ্ত ও আশাজাগানিয়া একটি দৃশ্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কয়েক দিন গড়াতেই মুসল্লিদের সংখ্যা কমতে থাকে। এক-দুই কাতার করে কমতে কমতে মসজিদ রমজানের প্রথম দিকের উৎসবমুখর পরিবেশ পাল্টে যায় অনেকটাই। এটা কোনোভাবে কাম্য নয়। আল্লাহর কাছে ওই আমল পছন্দনীয়, যা নিয়মিত করা হয়। তারাবি অতি বরকতময় সুন্নত। তারাবি নামাজ পড়ার দ্বারা রমজান ও কোরআনের হক আদায় হয়, আল্লাহতায়ালার বিশেষ রহমত ও মাগফিরাত, সর্বোপরি আল্লাহতায়ালার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। তাই আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের জন্য উচিত একনিষ্ঠতার সঙ্গে এ ইবাদতে মশগুল থাকা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করেছেন আর আমি তোমাদের জন্য তারাবিহর নামাজ সুন্নত করেছি; রাসুল (সা.) তারাবির ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় রমজান মাসের রাতে কিয়াম করবে (তারাবি পড়বে) তার অতীতের সবল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ (বোখারি: ১৯০৫)। অন্যত্র এসেছে, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় রমজানে দিনে রোজা পালন করবে ও রাতে তারাবির নামাজ আদায় করবে, সে গুনাহ থেকে এমন পবিত্র হবে; যেমন নবজাতক মাতৃগর্ভ থেকে (নিষ্পাপ অবস্থায়) ভূমিষ্ঠ হয়। (নাসায়ি: ১/২৩৯) সুন্নত ও নফল নামাজ সাধারণত জামাতে আদায় করা নিষেধ, অথচ তারাবির নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করার বিধান এসেছে। তবে রাসুল (সা.) নিজে নিয়মতান্ত্রিকভাবে জামাতের ব্যবস্থা করেননি, উম্মতের ওপর তা ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়। এ থেকে বোঝা যায়, তারাবির মর্যাদা সাধারণ নফল নামাজ থেকে অনেক বেশি। মোটকথা কোরআন ও সুন্নাহর দলিলের ভিত্তিতে ফকিহরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, তারাবির নামাজ অন্যসব নফলের মতো নয়, বরং এটা না পড়লে গুনাহ হবে। অতএব এর বিপক্ষের মিথ্যা প্রোপাগান্ডায় প্রভাবিত হয়ে নিজেকে বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত করবেন না। রমজানের রাতগুলোকে মহা সুযোগ মনে করে গুরুত্বের সঙ্গে তারাবির নামাজে যত্নবান হওয়া জরুরি এবং শেষ রাতে তাহাজ্জুদ নামাজের ব্যাপারে যত্নবান হওয়ার চেষ্টা করা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, অনেক মানুষ রমজানের প্রথম কয়েক দিন গুরুত্বের সঙ্গে তারাবি আদায় করলেও পরবর্তীকালে তা করতে চায় না। নানা ব্যস্ততা বা অযথাই সে অলসত করে তারাবি থেকে দূরে থাকে, যা কখনোই কাম্য নয় এবং এটা গুনাহের কাজ। রমজান মাসে এশার নামাজের পর তারাবির নামাজ আদায় করা নারী-পুরুষ সবার জন্যই সুন্নতে মুয়াক্কাদা। তবে পুরুষরা মসজিদে জামাতের সঙ্গে আর মহিলারা ঘরে আদায় করবে। হাদিসে এসেছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজান মাসে বিশ রাকাত তারাবি এবং বিতর পড়তেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: হাদিস ৭৬৯২)। তবে রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের নিয়ে মাত্র তিন দিন জামাতের সঙ্গে তারাবি আদায় করার পর ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় জামাতের সঙ্গে তারাবি পড়া ছেড়ে দিলেন। অতঃপর রাসুল (সা.) বাকি জীবনে, আবু বকর (রা.)-এর খিলাফতকালে এবং ওমর (রা.)-এর খিলাফতের প্রথমদিকে এ অবস্থাই বিদ্যমান ছিল। (বোখারি: ১/২৬৯)। অন্য হাদিসে এসেছে, রমজান মাসের কোনো এক রাতে হজরত ওমর (রা.) মসজিদে নববিতে গেলেন এবং দেখতে পেলেন যে, মসজিদের বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট জামাত হচ্ছে। তিনি ভাবলেন সব নামাজিকে এক ইমামের পেছনে একত্র করে দেওয়া উচিত। তখন তিনি জামাতে তারাবি পড়ার নির্দেশ জারি করেন এবং হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.)কে ইমাম বানিয়ে দেন। অতঃপর তিনি সাহাবিদের নিয়ে বিশ রাকাত তারাবি পড়ান। (বোখারি: ২০১০) আরেকটি বিষয় হলো, জামাতের সঙ্গে তারাবির নামাজ আদায় করা। এ ব্যাপারে ফুকাহায়ে কেরাম বলেন, জামাতের সঙ্গে তারাবির নামাজ আদায় করা সুন্নতে কেফায়া। কোনো মহল্লায় যদি কেউই জামাতের সঙ্গে না পড়ে, তাহলে সবাই গুনাহগার হবে। আর যদি কিছু লোক মসজিদে জামাতের সঙ্গে আদায় করে আর কেউ কেউ ঘরে একা একা আদায় করে তাহলে এতে কোনো অসুবিধা নেই। তবে এ কথা অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, যারা একা একা পড়ল তারা জামাতে পড়ার সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হলো। (কামুসুল ফিকহ ২/৪৫০)। আল্লাহতায়ালা সবাইকে রমজানের হক আদায় করার, প্রতিদিন সুন্দরভাবে গুরুত্বসহ জামাতের সঙ্গে তারাবির নামাজসহ সব ইবাদত-বন্দেগি সঠিকভাবে আদায় করার তওফিক দান করুন। লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ