কারাবন্দিদের কাছ থেকে মসজিদ তৈরির নামেও তোলা হচ্ছে টাকা

৫ আগস্টের পরেও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চলছে আগের মতোই অনিয়ম, দুর্নীতি, জুলুম আর নির্যাতন। অবাধে মিলছে ইয়াবা, গাঁজাসহ সব ধরনের মাদক। কারাবন্দি ফ্যাসিবাদ দোসরদের কাছ থেকে গ্রামের বাড়িতে মসজিদ তৈরির নামেও টাকা তোলা হচ্ছে। ফ্যাসিবাদ সরকারের ভিআইপি বন্দিদের কাছ থেকে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন। টাকার বিনিময়ে তাদের দিচ্ছেন আয়েশি সময় কাটানোর সুযোগ। খাবারের মেন্যুতে যোগ হচ্ছে মাছ-মাংসসহ পছন্দের খাবার। খোদ জেলার একেএম মাসুমের নেতৃত্বে কারাগারে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এর সদস্যের মধ্যে রয়েছেন ডেপুটি জেলার তানজিল হোসেন, দেলোয়ার হোসেন, জান্নাত, ইউসুফ, সার্জেন্ট ইনস্ট্রাক্টর আমিনুল ইসলাম, সুবেদার সাইফুল, আতাউর প্রমুখ। সিন্ডিকেট সদস্যরা ফ্যাসিবাদ সরকারের ভিআইপি বন্দিদের কাছ থেকে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন। টাকার বিনিময়ে তারা কারাগারের ভেতর সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। সালমান এফ রহমান এবং জাফর উল্লাহদের কাছ থেকে ইতিপূর্বে আইফোন এবং মিনি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়েছে। কারা অভ্যন্তরের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে। সূত্র জানায়, কারাবন্দি ফ্যাসিবাদ দোসরদের কাছ থেকে গ্রামের বাড়িতে মসজিদ তৈরির নামেও টাকা তোলা হচ্ছে। দেশ টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আরিফ হাসান টাকার বিনিময়ে কারাগারের সূর্যমুখী সেলের চতুর্থতলায় একাই থাকছেন তিনটি রুম নিয়ে। এর একটিতে তিনি ঘুমান। একটি রুমে রান্না ও খাবার খাওয়া হয়। অন্য রুমে তিনি মালামাল রাখেন। গোপনে তিনি মোবাইল ফোনও ব্যবহার করেন। সূত্র আরও জানায়, অবস্থা এমন যে, টাকাই কারাগারে শেষ কথা। টাকা দিলে এখানে সবই মিলছে। আর টাকা না দিলেই বন্দির ওপর নেমে আসে নির্মম নির্যাতন। একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে ওই সূত্র জানায়, ২৮ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা ৪ মিনিট। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে একটি ফোন আসে মাদারীপুর সদর রকেট বিড়ি রোডের রাহিম চৌকিদারের কাছে। ০১৭১৩-১০৭৮৭৩ নম্বর থেকে ওই ফোনটি করেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নাইম চৌকিদার। নাইম ও রাহিম দুই ভাই। এই দুজনের কথোপকথন থেকে বেরিয়ে এসেছে বন্দি নির্যাতনের ভয়াবহ বর্ণনা। রাহিমকে নাইম জানায়, সে গুরুতর অসুস্থ। গলায় টিউমার মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। জরুরি অপারেশন দরকার। চিকিৎসার জন্য তাগিদ দেওয়ায় জেলার একেএম মাসুম, ডেপুটি জেলার তানজিল হোসেন, ফরহাদ, মোতাহারা, সুবেদার সাইফুল, কয়েদি জনি, আলামিন এবং আশিকসহ কয়েকজন তার রুমে ঢুকে চোখ বেঁধে নির্মমভাবে পেটায়। গলায় চাপ দিয়ে ধরে রাখে। মারাত্মক আহতাবস্থায় তিনি এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। ২৪ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের শিউলি খাতুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে এক আবেদনে বলেন, ‘আমার স্বামী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। তিনি গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অবস্থান করছেন। চিকিৎসার প্রয়োজনে কারাগারের ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে না। তার কাছে টাকা দাবি করা হচ্ছে। টাকা না দেওয়ার কারণে তিনি চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।’ শিউলি খাতুন বলেন, ‘আমার স্বামী দুবার স্ট্রোক করেছেন। তার বাম পা অবশ হয়ে আছে। কারাবিধি অনুযায়ী আবেদন করার পরও তার চিকিৎসা হচ্ছে না।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে নাইম তার ভাইকে বলেন, ‘আমি হয়তো আর বাঁচব না। যে কোনো সময় মারা যেতে পারি। আমার প্রতি কোনো দাবি-দাওয়া রাখিস না। সবাইকে দেখে রাখিস। আমাকে মাফ করে দিস। ব্যথায় যেভাবে কাতরাচ্ছি, মনে হয় না বাঁচব। তারা আমাকে কিছুক্ষণ পরপর টর্চার করছে। আমার শরীরে পচন ধরে গেছে। কীভাবে নির্যাতন করেছে বলে বোঝাতে পারছি না। ওরা হুমকি দিয়ে বলেছে— এরপর যদি চিকিৎসার কথা বলিস তাহলে তোকে বস্তায় ভরে ঝুলিয়ে পেটাব। যে কোনো সময় আমার কিছু হয়ে যেতে পারে। তাই তোকে বিষয়টি জানিয়ে রাখলাম। কেবল শারীরিকভাবেই নয়, এখন আমি মানসিকভাবেও রোগী হয়ে গেছি। গলায় টিউমারের চিকিৎসা চাওয়াই আমার জন্য কাল হয়েছে। জেলারের কাছে চিকিৎসা চেয়েও পাইনি। এ কারণে জেল সুপারের কাছে চিকিৎসার আবেদন করেছি। শুনেছি, জেল সুপার ভালো মানুষ। তাই তার কাছে আবেদন করেছিলাম। আর এতেই চটে গেছেন জেলার।’ প্রাপ্ত কল রেকর্ডে জানা যায়, নাইমের ওপর নির্যাতনের সময় জেলার বলেন, ‘শালা, খালি মেডিকেল মেডিকেল করিস। মেডিকেল যেতে টাকা লাগে না?’ নাইম বলেন, ‘আমাকে যে নির্যাতন করা হয়েছে সেই লজ্জায় বর্ণনা করতে পারছি না। এই লজ্জা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই না। ৪-৫ দিন ধরে কিছু খেতে পারছি না। গলা দিয়ে কিছু ঢুকছে না। এমনিতেই টিউমার। অন্যদিকে কয়েকজন মিলে চেপে ধরেছিল। আমি হাঁটতে পারছি না। সকালে আমাকে দুজনে ধরে এনে ফোনের কাছে নিয়ে এসেছে। তাই তোর সঙ্গে কথা বলতে পারছি। আমি মরে গেলেও তোরা এর বিচারটা করবি। মারার সময় ওরা বলেছে, শালা বিএনপি করতি, না? বিএনপি তোর... দিয়ে ভরে দেব। আমার কাছে টাকা নেই। তোরা গরিব মানুষ। তোদের কাছেও টাকা চাইতে পারি না। তাই জেলারকেও টাকা দিতে পারি না। টাকা দিতে না পারার কারণেই এ নির্যাতন।’ কারা অভ্যন্তরের সূত্র জানায়, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য এখানে বিক্রি করা হয় বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক চড়া দামে। ২৫০ টাকার সিগারেট বিক্রি হয় ৪০০ টাকা করে। এক হালি সাগর কলা ৫০ টাকা, এক কেজি টমেটো ৮০ টাকা, পেঁয়াজ ১১০ টাকা ও আলু কেজিপ্রতি বিক্রি হয় ৮০ টাকা। প্রতিপিস লেবু বিক্রি হয় ১০ টাকা করে। রান্না করা এক পিস পোলট্রি মুরগির মাংস ১০০ টাকা, দুই পিস গরুর মাংস বিক্রি হয় ২০০ টাকায়। কারাগারের ভেতরে থাকা ক্যান্টিনের কোনো ভাড়া নেই। নেই কর্মচারীদের বেতন। তারপরও বাজারমূল্যের চেয়ে এত বেশি দামে পণ্য বিক্রির বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। তারা জানান, ক্যান্টিন থেকে যে লাভ হচ্ছে তা ভাগ করে নিচ্ছেন সিন্ডিকেট সদস্যরা। তারা আরও জানান, কারা অভ্যন্তরে বন্দিদের তল্লাশি করে নগদ টাকা, টিভি, রাইস কুকার, ওভেন, ঘড়ি, সাউন্ড বক্স, হিটার ইত্যাদি উদ্ধার করা হয়। কিন্তু নিয়মানুযায়ী সেগুলো জমা না দিয়ে ভাগ করে নিয়ে যান সিন্ডিকেট সদস্যরা। জেলার একেএম মাসুম যুগান্তরকে বলেন, কারাগারের বিষয়ে আপনার কাছে যেসব অভিযোগ এসেছে, সেগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কারা এসব মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে তা বলতে পারব না। ডিআইজি (প্রিজন) জাহাঙ্গীর কবির বলেন, যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো একেবারেই ডাহা মিথ্যা ও ভুয়া প্রচারণা। যারা অতীতে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে তারাই এসব ছড়াচ্ছে।