‘নগদ’ টাকা ছাপিয়েছে রাষ্ট্রের সহায়তায়

৪ মার্চ, ২০২৫ | ৪:৫৩ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

বাংলাদেশ ডাক বিভাগের মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান নগদ ভয়াবহ ডিজিটাল জালিয়াতি করেছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ই-মানি সৃষ্টির মাধ্যমে নগদ টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছেড়েছে। এভাবে চক্রটি প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। এছাড়া নানাভাবে লোপাট করেছে আরও ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা। এসব কারণে যে আর্থিক ঘাটতি হয়েছে, এর দায় চাপানো হয়েছে ডাক বিভাগের ওপর। এ জালিয়াতিতে নগদকে প্রত্যক্ষভাবে উৎসাহিত করেছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার পুত্র ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় সরাসরি এর সুবিধা ভোগ করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার এসব জালিয়াতিতে চুপ থেকে নগদকে সহযোগিতা করেছেন। প্রসঙ্গত, টাকা ছাপানো বা ছাপানো টাকা বাজারে সরবরাহ করতে পারে একমাত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া দেশের অন্য কোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এটি করতে পারে না। এমনকি বিশ্বের কোথাও টাকা ছাপানো ও বাজারে ছাড়ার কাজটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান করতে পারে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক তদন্ত প্রতিবেদন থেকে নগদের এমন চাঞ্চল্যকর জালিয়াতির ঘটনা উঠে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, বাংলাদেশে এ ধরনের জালিয়াতির ঘটনা এই প্রথম। ডিজিটাল মাধ্যমে মানি ক্রিয়েশন বা ই-মানি সৃষ্টি করা একধরনের টাকা ছাপানোর মতো। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ অপরাধের দায়ে নগদের কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেব্রুয়ারিতে একটি মামলা করেছে। অবৈধভাবে টাকা ছাপানোর ঘটনায় এটাই প্রথম মামলা। এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইটিসিএল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বেআইনি ব্যাংকিং কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য মামলা করেছিল ২০০১ সালের দিকে। ফলে এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই সরাসরি মামলা করল। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নগদের বিরুদ্ধে ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলা করেছে। সূত্র জানায়, ডাক অধিদপ্তর ও থার্ড ওয়েভ টেকনোলজির চুক্তি অনুযায়ী, নগদের ব্যাংক হিসাবে যত টাকা জমা থাকবে, ঠিক সমপরিমাণ ই-মানি ইস্যু করা যাবে। এর বেশি ই-মানি ইস্যু করা যাবে না। কিন্তু নগদ অ্যাকাউন্টে থাকা টাকার চেয়ে ৬৪৫ কোটি টাকার বেশি ই-মানি ইস্যু করেছে। অনুমোদন ছাড়াই নগদে ৪১টি পরিবেশকের হিসাব খোলার মাধ্যমে ১ হাজার ৭১১ কোটি টাকা বের করে নিয়েছে। এসব পরিবেশকের দায়িত্ব ছিল সরকারি ভাতা বিতরণ করা। কিন্তু তারা ভাতা বিতরণ করেনি। ভাতার টাকা পরিবেশকদের হিসাব ব্যবহারের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে। বিশেষ করে হিসাবে টাকা দেওয়ার পর যেসব ভাতাভোগী তিনদিনের মধ্যে তা উত্তোলন করেননি, তাদের টাকা তুলে নেয় নগদ। অনুমোদন ছাড়াই যেসব পরিবেশক নিয়োগ করা হয়েছে, তাদের ব্যবহার করে এই জালিয়াতি করা হয়েছে। এসব জালিয়াতির মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। এখনো তদন্ত চলছে, এর পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। জানা যায়, মোবাইল ব্যাংকিং পরিচালনার জন্য নগদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে লাইসেন্স চেয়ে পায়নি। পরে ডাক বিভাগের আইন সংশোধন করে তারা মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি ছাড়াই। পরে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে মোবাইল ব্যাংকিং করার সাময়িক লাইসেন্স নেয়। কিন্তু স্থায়ী লাইসেন্স পায়নি। পরবর্তী সময়ে তারা নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসাবেই লাইসেন্স পেয়েছে। অবশ্য একপর্যায়ে তা ফেরত দিয়ে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের লাইসেন্স নিয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই নগদ যোগ্যতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। সবই পেয়েছে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র জয়ের হস্তক্ষেপে। নগদ, ডাক বিভাগের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রচারণা চালানো হলেও এটি ডাক বিভাগের কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না। ডাক বিভাগের নাম ব্যবহার করে নগদের মালিকপক্ষ প্রতারণা করেছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশ ডাকঘর নগদ নামে পোস্টাল ক্যাশ সেবা চালু করে। পরে নগদের মাধ্যমে মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবা চালু করতে ২০১৭ সালে থার্ড ওয়েভ টেকনোলজির সঙ্গে চুক্তি করে ডাকঘর। ২০২০ সালে থার্ড ওয়েভ টেকনোলজির নাম পরিবর্তন করে হয় নগদ লিমিটেড। ডাক বিভাগের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী সেবাটি পরিচালনা করে নগদ। এর মালিকানায় ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ লোকজন। নেপথ্যে ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। নগদের কার্যক্রম শুরুর সময় থার্ড ওয়েবের শেয়ারহোল্ডার হিসাবে যুক্ত হন আওয়ামী লীগের তৎকালীন দুই সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক ও রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকনের স্ত্রী রেজওয়ানা নূর। পরে তিনি মালিকানা ছেড়ে দেন। ২০১৮ সাল থেকে নগদকে ডাক বিভাগের সেবা হিসাবে প্রচার করা হলেও এর মালিকানায় ডাক বিভাগ ছিল না। নগদের পরিচালক এখন নয়জন। এর মধ্যে বাংলাদেশসহ যুক্তরাজ্য, কানাডা ও সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত কোম্পানির একজন করে পরিচালক আছেন। অন্য ছয়জন বাংলাদেশি। নগদের শেয়ারহোল্ডার নিয়াজ মোর্শেদ যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট সাবেক গভর্নর ফজলে কবিরের সময়ে ডাক বিভাগের পক্ষে নগদ নামে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালুর অনুমতি চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করা হয়। শর্ত মেনে আবেদন না করার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুমোদন দেয়নি। তখন ডাক অধিদপ্তর নিজেদের আইনে পরিবর্তন এনে ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ নগদ নামে মোবাইলে ব্যাংকিং সেবা চালু করে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এটি চালুর কারণে নগদ আগ্রাসি কার্যক্রম শুরু করে। তখন তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টিকে কোনো আমলে নেয়নি। নিয়ম অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া কোনো ব্যাংকিং কার্যক্রম চালুর সুযোগ নেই। এতে নগদ তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। ইতোমধ্যে নগদের কার্যক্রম ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়। সরকারি ভাতা নগদের মাধ্যমে বিতরণ শুরু হয়। এ অবস্থায় জয় নগদকে লাইসেন্স দেওয়ার জন্য সাবেক গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গে টেলিফোনে সরাসরি কথা বলেন। এরপর শর্ত পূরণ না করলেও ২০২০ সালের ১৫ মার্চ নগদকে সাময়িকভাবে অনুমোদন দিয়ে ডাক বিভাগকে চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নগদে যখন অনিয়ম সংঘটিত হয়, তখন এর পরিচালনায় ছিলেন আওয়ামী লীগের একাধিক সংসদ-সদস্য ও প্রভাবশালী নেতা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় নগদ অনিয়ম করেছে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীরবে তা দেখেছে। কিছুই বলেনি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী সব জেনেও ছিলেন চুপ। কারণ, এর সঙ্গে তার পুত্র জয় জড়িত। ডাকঘর থেকেও কোনো কথা বলা হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২১ আগস্ট নগদে প্রশাসক নিয়োগ করে। তারা দায়িত্ব নেওয়ার পর জড়িত কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করা হয়। তদন্ত শুরু হলে উঠে আসে জালিয়াতির তথ্য।