বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক নতুন দিগন্তে

পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে শীতল থাকা সম্পর্ক। বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, শিক্ষা, ভ্রমণ, সংস্কৃতিসহ নানা ক্ষেত্রে দুই দেশ দ্বিপাক্ষিক তৎপরতা বৃদ্ধিতে সচেষ্ট। বিগত সরকারের সময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক একেবারেই সাদামাটা পর্যায়ে থাকলেও বর্তমানে সেটিও বেশ জোরদার ও তৎপর। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েনে পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নয়নে ব্যস্ত। পাকিস্তান চাইছে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য, অর্থনীতি, সামরিক, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ নানা ক্ষেত্রে দুই দেশের সম্পর্ক ও যোগাযোগ আরও নিবিড় হোক। দুই দেশের জনগণের সঙ্গে (পিপল টু পিপল) পারস্পরিক আদান-প্রদানে নেওয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। সাম্প্রতিক এক সফরে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ, লাহোর, মারি, তক্ষশিলায় সেখানকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় ও নানা অধিদপ্তরের প্রধান, পাকিস্তানের থিংকট্যাংকসহ বিশিষ্টজনরা এমনটাই জানিয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ও ভূরাজনীতির শক্তিশালী অবস্থানে সার্কের পুনরুজ্জীবিত হওয়াকে গুরুত্ব দেওয়া হয় বিভিন্ন সেশনে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য বাড়তে থাকে। দেখা যায়, আগস্ট থেকে ডিসেম্বরে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য আনুমানিক ২৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। উভয় দেশ নির্মাণসামগ্রী, খাদ্যপণ্য, ওষুধ এবং তথ্যপ্রযুক্তির মতো ক্ষেত্রগুলোয় বাণিজ্যকে প্রাধান্য দিচ্ছে। পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে বার্ষিক বাণিজ্য চারগুণ বৃদ্ধি করতে চায়। বাংলাদেশের সঙ্গে আগামী পাঁচ বছরের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়ে পাকিস্তানের হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অর্থ ও বাণিজ্যের হিসাবে আগামী পাঁচ বছরে খুব গভীর এবং শক্তিশালী হোক আশা করি। যেন এ সময়ে দুই দেশের বাণিজ্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যায়। দুই দেশই দুই দেশে বিনিয়োগ করে। সবসময় যেন দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ থাকে। দুই দেশেই যেন জনগণের ভ্রমণ চলতে থাকে। সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান যেন চলতে থাকে চলচ্চিত্র, মঞ্চ ও সংগীতে। সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি। অন্তর্বর্তী সরকারের এই সময়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা গেছে। দুই দেশের জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তারা জানুয়ারিতে রাওয়ালপিন্ডিতে আঞ্চলিক নিরাপত্তা গতিশীলতা এবং যৌথ সামরিক মহড়া, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং অস্ত্র ব্যবসার সুযোগ নিয়ে আলোচনা করেছেন। যেখানে আরও গুরুত্ব পায় ‘দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ল্যান্ডস্কেপ পুনর্নির্মাণ। বাণিজ্যের পাশাপাশি শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ বিষয়ে আগ্রহী পাকিস্তান। পাকিস্তান সরকার ডিসেম্বরে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের সেখানকার শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিভিন্ন বিষয়ে ৩০০টি সম্পূর্ণ বৃত্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাকিস্তানে ভ্রমণ করে মারি, তক্ষশিলা, হরপ্পা, মহেঞ্জোদারোর মতো ঐতিহাসিক স্থানগুলো যেন আরও অনেক বাংলাদেশি দেখতে পারেন, সেজন্য সচেষ্ট সরকার। জুলাই অভুত্থ্যানের পর থেকে দেশে রাহতা ফতেহ আলী খান, পাকিস্তানি ব্যান্ড জালসহ আরও কয়েকজন শিল্পী কনসার্ট করেছেন। সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান আরও বাড়াতেও তৎপর তারা। পাকিস্তানের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব আম্বরিন জান দুই দেশের সম্পর্কের বিষয়ে বলেন, উভয় দেশেরই বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সংযোগ, মিডিয়া, শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ে সম্পৃক্ততা বাড়ানোর উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা রয়েছে। দুই দেশের জনগণের পারস্পরিক সুবিধার জন্য পাকিস্তান এ অঞ্চলে সম্পর্ক জোরদার করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ চেতনায় সাম্প্রতিক প্রচেষ্টাগুলো বোঝাপড়া বাড়ানোর জন্য এবং ভুল ধারণাগুলো প্রতিরোধ করার জন্য মিডিয়া সহযোগিতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে। পাকিস্তানের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের বহিরাগত প্রচার শাখা (এক্সটার্নাল পাবলিসিটি উইংস)-এর মহাপরিচালক রাইসা আলি বলেন, আমি প্রায়ই ভাবি আমাদের শেয়ার করা সংস্কৃতি এবং ইতিহাসকে প্রকল্প আকারে নিয়ে কাজ করতে পারি। আমরা সহ-প্রযোজনা নাটক, তথ্যচিত্র এবং সংবাদ অনুষ্ঠানে আমাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রদর্শন করতে পারি। লাইভ ইভেন্ট, খেলাধুলাসহ টিভি ও রেডিও অনুষ্ঠানের যৌথ সম্প্রচার আমাদের জনগণকে কাছাকাছি আনতে পারে, সম্প্রদায়ের বোধ এবং ভাগাভাগি করে নেওয়া পরিচয়কে উৎসাহিত করতে পারে। নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যেমন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, লাইভ কনসার্ট এবং গজল/আধ্যাত্মিক সন্ধ্যা আমাদের দুই দেশের তরুণদের মধ্যে আরও ভালো বোঝাপড়া তৈরি করবে। তিনি বলেন, ডিজিটাল মিডিয়ার উত্থানের এই সময়ে অনলাইনেও আমরা কনটেন্ট শেয়ার, যৌথ ডিজিটাল প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থবহ পরিবর্তন আনতে পারি এবং দুই দেশের মধ্যে ব্যবধান কমাতে পারি। কিন্তু বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে যাতায়াতের ক্ষেত্রে সরাসরি ফ্লাইট না থাকা দুই দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায়। ২০১৮ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি কোনো ফ্লাইট নেই। বছরের পর বছর পাকিস্তানিরা বাংলাদেশি ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন বলেনও জানা গেছে। কারণ, একাধিক রাষ্ট্রীয় সংস্থার কঠোর নিরাপত্তা ছাড়পত্র নেওয়া ভ্রমণকে কার্যত অসম্ভব করে তুলেছিল। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার এ নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তান বাংলাদেশি ভ্রমণকারীদের জন্য ভিসা ফি কমিয়েছে। নিরাপত্তা ছাড়পত্রের প্রয়োজনও হবে না। তবে আশার কথা, মাস কয়েকের মধ্যেই ঢাকা ও করাচির মধ্যে চালু হচ্ছে সরাসরি ফ্লাইট। এ রুটে ফ্লাইটের অনুমোদন পেয়েছে ‘ফ্লাই জিন্নাহ’ নামে পাকিস্তানের একটি এয়ারলাইন্স। ঢাকা থেকে আকাশপথে করাচির দূরত্ব প্রায় ২ হাজার ৩৭০ কিলোমিটার। সরাসরি ফ্লাইট না থাকায় এয়ারলাইন্সগুলোকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় ট্রানজিট নিয়ে যেতে হয় পাকিস্তানে। ট্রানজিট ফ্লাইটের কারণে ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকার বিমান ভাড়া বর্তমানে লাখ টাকারও বেশি। তবে সরাসরি ফ্লাইট চালু হলে খরচ কমে আসবে অনেকটা। সময়ও লাগবে কম। প্রসঙ্গত, দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে দুবার দেখা করেছেন। তদুপরি, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে পণ্যবাহী দুটি পণ্যবাহী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে-১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর এ ধরনের আগমন এই প্রথম। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের এ পরিবর্তনে দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কারণ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিদের গণহত্যা মানুষ ভোলেনি। পাকিস্তান এখনো ক্ষমা চায়নি। তাই অনেকে নতুন করে এ বন্ধনকে স্বাগত জানালেও অনেকে একে ভালোভাবে নিতে নারাজ।