মুক্তিযুদ্ধে ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে যাওয়া

৩ মার্চ, ২০২৫ | ৫:০১ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

আমি হঠাৎ করেই মুক্তিযুদ্ধে যাইনি। রাজনৈতিকভাবে আমি প্রণোদিত হয়েছিলাম। আমি যে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনটির সদস্য ছিলাম, সেই পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসা ‘বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নে’র একজন সক্রিয় সদস্য ছিলাম আমি। আমাদের মূল মন্ত্রণাই ছিল, যুদ্ধ ছাড়া দেশ স্বাধীন করা যাবে না। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করো।’ আমরা সেই সব দিনেই জানতাম পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের কেউ না। তারা শোষক, লুটেরা এবং আমাদের ওপর চেপে থাকা এক জগদ্দল পাথর। পাকিস্তানি শাসকদের এদেশ থেকে তাড়াতে হলে অস্ত্র ছাড়া সম্ভব নয়। আমাদের নেতারা এই জ্ঞান লাভ করেছিলেন মাও সে তুংয়ের কাছে থেকে। চীন বিপ্লবের এই মহান বিপ্লবী ছিলেন আমাদের পার্টির আদর্শিক অনুপ্রেরণা। তার বিপ্লবের আদর্শই আমরা অনুসরণ করতাম। তার নামে বহুবার জয়ধ্বনি দিয়েছি। সেই সব দিনে আমরা গোপনে যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং নিতাম নিয়মিত। সেই রাইফেলগুলো ডামি রাইফেল ছিল। তার পরও কী উত্তেজনা আমাদের। রক্ত যেন টগবগ করে ফুটত। আর মওলানা ভাসানী, আমরা বলতাম লাল মওলানা, কারণ তিনিই বিপ্লবের পতাকা তুলেছিলেন আমাদের চিন্তার আকাশে। আমরা যখন কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না, কী হবে কোন্ পথে বিপ্লব করব, যখন দো-টানায় দোল খাচ্ছি, সেই সময় তিনি ওই মন্ত্র দিলেন আমাদের অন্তরে- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো...!’ ২. সারাদিন পার্টির কাজেই ব্যয় করতাম। পড়াশোনা গোল্লায় যাওয়ার জোগাড়, সেই দিনগুলো ছিল ঝড়ো রাজনৈতিক আন্দোলনের কাল। আমরা পাকিস্তানি শাসকদের দেওয়া নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। যে কয়টি শর্তের অধীনে ’৭০-এর নির্বাচন ইয়াহিয়া দিয়েছিলেন, তার একটি ছিল-সরকার যদি ইচ্ছে করে বিজয়ী দলকে ক্ষমতায় নিয়ে আসবে, তাহলেই কেবলমাত্র তারা সরকার গঠন করতে পারবে। আমাদের নেতা মওলানা ভাসানী বললেন, ‘তাহলে তো হাতে তাদের মার দেবার সবকিছুই রয়ে গেল। আমরা ওই নির্বাচন মেনে নিতে পারি না।’ আওয়ামী নেতারা বুঝতেই পারেননি ইয়াহিয়ার শর্তের এই চালটি। ’৭০-এর নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের পরও যখন শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী করতে চাইল না, তখন তাদের আক্কেল দাঁত উঠেছিল। কিন্তু ততদিনে সময় চলে গেছে অনেকটাই। পাকিস্তানি সামরিক নেতারা যদি বুঝতে পারত, আমরা তাদের শেকড়-বাকড় উপড়ে ফেলতে পারব, তাহলে তারা বাংলাদেশের মানুষ হত্যার নীলনকশা তৈরি করত না। তারা ভেবেছিল অস্ত্র দেখলেই বাঙালিরা মাথা নত করে মেনে নেবে ইয়াহিয়ার মতো বর্বরের হত্যাযজ্ঞ। ৩. ঠিক কতদিন পর যুদ্ধের ময়দানে যেতে পেরেছিলাম, সেটা মনে করতে পারছি না। জেলা আর থানা শহরগুলো পাকিস্তানি সেনারা দখল নিয়েছিল। আর আমরা ঢুকে পড়েছিলাম গ্রামাঞ্চলে। চাষির বাড়িতে বাড়িতে আমরা জায়গা করে নিয়েছিলাম। সবাই যে আমাদের পক্ষে ছিল, তা তো নয়। গ্রামের কিছু দুষ্টপ্রকৃতির মানুষ, পাকিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাদের ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। এর মধ্যেই আমরা অনেক অস্ত্র জোগাড় করে আসল অস্ত্রের মাধ্যমে ট্রেনিং নিয়েছি। আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন বেশ কিছু ইপিআর ও সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য। সেসব সাবেক সেনা সদস্যের কাছে আমরা শুনেছি পাকিস্তানিরা কতটা বর্বর। গ্রামের বিডি মেম্বার ও তাদের চেলাদের শায়েস্তা করা গেল। কিন্তু যারা গ্রাম ছেড়ে জেলা শহরে পাকিদের সহযোগী ‘শান্তি বাহিনী’ তৈরি করেছিল তাদের নিয়েই হলো বিপদ। জেলা শহরে গেলেই ধরিয়ে দিতে চাইত তারা। আমিও একবার ওই রকম ফাঁদে পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছিলাম। এইচ কিউ, মানে হেড কোয়ার্টারের জন্য কিছু জরুরি জিনিস, টেনসিল পেপার, কালি ও কাগজ কিনে আনতে গিয়ে সেই ফাঁদে পড়েছিলাম। ছেলেটি আমাদের গ্রামের। সে যে চর হিসেবে কাজ করছে তা বুঝতে পারিনি। হঠাৎ করেই আনোয়ার কাকার সঙ্গে দেখা হলো কুমুদিনি কলেজের গেটে। তিনি আমাকে নিয়ে ঝাড়া দৌড় দিলেন সাবালিয়ার দিকে। তিনি ওই গ্রামে থেকেই পড়াশোনা করতেন। ‘মোল্লার ছেলেটি যে তোকে ফলো করে আসছে তুই বুঝিসনি?’ -না, কাকা। ‘ও তো রাজাকার। তোকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্যই তোর পেছনে আসছিল।’ আনোয়ার কাকার সঙ্গে দেখা না হলে ওইখানেই আমাকে আটক করে নিয়ে যেত। এক কী দেড় মাস আগে আমার আরেক চাচার ছেলে লেবুকেও ধরে নিয়ে গেছে ওরা। লেবু মুক্তি পেয়েছিল, টাঙ্গাইল মুক্ত হবার পর দিন।