ঘুস ‘ওপেন সিক্রেট’

২ মার্চ, ২০২৫ | ৫:৩০ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের গারদখানায় নিয়মবহির্ভূতভাবে ঘুসের বিনিময়ে আসামিকে বিভিন্ন ধরনের সেবা দিচ্ছে একটি সিন্ডিকেট। এর নেপথ্যে রয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশের সংশ্লিষ্ট সদস্যরা। তাদের এই অপকর্ম তিন ধাপে সম্পন্ন করা হয়। পুরো প্রক্রিয়ায় সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করছে বেশ কয়েকজন দালাল। এতে অবৈধভাবে প্রতিদিন আয় হচ্ছে কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকা। পুরো ঘটনাটি আদালতপাড়ায় এক রকম ‘ওপেন সিক্রেট’। যা বছরের পর বছর ধরে চলছে। কিন্তু সবকিছু জানার পরও নির্বিকার কর্তৃপক্ষ। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন দপ্তরের অনিয়ম ও দুর্নীতি এই মুহূর্তে অনেকাংশে হ্রাস পেলেও গারদখানার এই অনিয়ম অব্যাহত আছে নির্বিঘ্নে। নিজস্ব অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রসঙ্গত, বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী, গারদখানায় থাকা আসামিদের স্বজনদের সঙ্গে যদি কোনো আত্মীয়স্বজন দেখা করতে চায় তাহলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে দেখা করতে পারবে। সেক্ষেত্রে আইনজীবীর মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। আদালত অনুমতি দিলেই স্বজনদের সঙ্গে দেখা করবেন স্বজনরা। কিন্তু এই পদ্ধতিকে অনেক ঝক্কি-ঝামেলার মনে করে আসামিপক্ষের স্বজনরা। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিচারপ্রার্থীদের অসহায় বানিয়ে প্রতিদিন মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ওই সিন্ডিকেট। অনুসন্ধানে জানা গেছে, আদালতের গারদখানায় বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে আসামির সঙ্গে দেখা করতে চাইলে ১ হাজার ৫০০ টাকা, আসামিকে খাবার খাওয়াতে চাইলে ১ হাজার টাকা দিতে হয়। আর ওকালতনামায় আসামির স্বাক্ষর আনতে হলে ১০০ থেকে ২০০ টাকা ঘুস দিতে হয় পুলিশ সদস্যদের। টাকা না দিলে এসব সুযোগ দেওয়া হয় না। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নিউমার্কেট এলাকা থেকে সোহেল সরদার নামের এক চা বিক্রেতাকে আটক করে পুলিশ। বুধবার তাকে আদালতে নিয়ে আসা হয়। এদিন তার স্ত্রী লাইলী বেগম আদালতের গারদখানার সামনে তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, আমার নির্দোষ স্বামীকে পুলিশ ধরে নিয়ে এসে হত্যা মামলায় চালান দিয়েছে। তাকে অনেক মারধরও করা হয়েছে। কিছু খেতে পারে না। পরে পুলিশের মাধ্যমে তাকে জুস কিনে দিছি। জুস কীভাবে দিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তারে জুস দেওয়ার জন্য পুলিশকে ৫০০ টাকা দিছি। আমার কাছে ১ হাজার টাকা চাইছিল, আমার কাছে তো এত টাকা নাই পরে ৫০০ টাকায় রাজি করাইছি। স্বামীর সঙ্গে দেখা করেছেন কিনা-জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেখা করতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমার কাছে ১৫০০ টাকা চাইছে। আমি এত টাকা কই পাব? তাই দেখা করিনি। শুধু খাবার দিয়েছি।’ আরেক বিচারপ্রার্থী মোহাম্মদ আলী তার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে আদালতে আসেন। সোমবার দক্ষিণখান এলাকা থেকে তাকে আটক করে পুলিশ। গ্রেফতারের পর তার সঙ্গে দেখা হয়নি তার ভাইয়ের। পরে গারদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক দালালের মাধ্যমে ১ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে দেখা করেন। তিনি বলেন, ‘আমার ভাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে আসার পর গারদখানায় তার সঙ্গে দেখা করার জন্য এক দালালের মাধ্যমে ১৫০০ টাকা দিতে হয়েছে। আদালতে এত দৌড়াদৌড়ি করার তো সময় নেই। আইনজীবী ধরলেও ১ হাজার টাকা দিতে হতো, আবার দৌড়াদৌড়ি করতে হতো। টাকা গেলেও ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে পারছি এটাই অনেক।’ ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নাজির রেজওয়ান খন্দকার বলেন, গারদে থাকা আসামিদের সঙ্গে দেখা করার জন্য নির্ধারিত আদালত রয়েছে। আদালতের অনুমতি নিয়ে স্বজনরা দেখা করতে পারবে। বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে দেখা করানোর কোনো নিয়ম নেই। আমরা অনেকবার পুশিকে বলেছি যেন তারা এগুলো না করে। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এ ব্যাপারে তদারকি প্রয়োজন। এখানে কারও কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা থাকা উচিত নয়। একজন আটক হলে বা গ্রেফতার হলে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বা দেখা করার অধিকার রয়েছে। টাকা নিয়ে বিচারপ্রার্থীদের কাছে তার অধিকার বিক্রি করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, যাদের আদালতে হাজির করা হচ্ছে, তাদের আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করার কোনো সুযোগই থাকে না। আসামিকে যখন কাঠগড়ায় উঠানো হয়, এই সময়ে যতটুকু আলাপ করা যায়। কিন্তু এটারও তো একটা ব্যবস্থা থাকা উচিত। বিচার সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে যদি এসব বিষয় না থাকে তাহলে এই বিষয়গুলো আসা উচিত। সিন্ডিকেটের অপকর্ম : অনুসন্ধানে জানা গেছে, গারদের ঘুস বাণিজ্য সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করেন গারদখানার দায়িত্বে থাকা পুলিশের সংশ্লিষ্টরা। প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুস তোলা হয়। টাকা কালেকশনে থাকেন গারদখানার গেটে দায়িত্বে থাকা ৫ পুলিশ। প্রতি সপ্তাহে তাদের দায়িত্ব পরিবর্তন হয়। এর মধ্যে একজন এএসআই, বাকি চারজন কনস্টেবল। সারাদিনের ঘুসের টাকা কালেকশন করে তুলে দেওয়া হয় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের হাতে। এই টাকার মধ্যে ঘুস আদায়ের দায়িত্বে থাকা কনস্টেবলরা পান ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা করে। আর এএসআই পান ১ হাজার টাকা। বাকি টাকা ওই কর্তৃপক্ষ নিজের কাছে রেখে তা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে বিতরণ করেন। অভিযোগ রয়েছে, এই টাকা কেবল গারদের মধ্যেই থাকে না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও নিয়মিত ভাগ দেওয়া হয়। এ কারণেই এই ঘুস বাণিজ্য বছরের পর বছর চললেও কেউ ব্যবস্থা নেয় না। এ প্রসঙ্গে আদালতের গারদখানার দায়িত্বে থাকা ওসি ফারুক বলেন, এমন টাকা নেওয়ার মতো কোনো কিছু হয় না। আদালতের অনুমতি নিয়ে পাশ আনলে দেখা করতে দিই। টাকা নেওয়ার বিষয় সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। প্রয়োজন হলে আমার সঙ্গে দেখা করে কথা বলেন, না হলে ডিসি প্রসিকিউশন ও ডিএমপির মিডিয়া শাখায় কথা বলেন। ডিএমপির মিডিয়া শাখার ডিসি তালেবুর রহমান বলেন, এই বিষয়টা তো আমার জানা নেই। এই ধরনের টাকা নেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। এটা খুবই অন্যায়। যদি এ রকম সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পাই, তাহলে আমরা এটার জন্য ব্যবস্থা নেব। ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগের ডিসি তারেক জুবায়েরের বক্তব্য নিতে গত বৃহস্পতিবার ও শনিবার একাধিকবার তার মোবাইল ফোনে ডায়াল করা হয়। কিন্তু তিনি রিসিভ করেননি। একই নম্বরে এই প্রতিবেদক পরিচয় দিয়ে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও শনিবার রাত ১০টা পর্যন্ত তিনি জবাব দেননি। আদালতের এক পাশে অনেকজন : অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, আসামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে নির্ধারিত পাশ নিয়ে গারদখানায় প্রবেশের নিয়ম থাকলেও এ প্রক্রিয়ায় রয়েছে ব্যাপক অনিয়ম। একটি পাশ সাধারণত একজন সাক্ষাৎপ্রার্থীকে দেওয়া হলেও সিন্ডিকেট ও দালালচক্রের কারসাজিতে এক পাশে ঢুকছে একাধিক ব্যক্তি। আদালত থেকে পেশকারদের সঙ্গে যোগসাজশে নাম ছাড়া পাশ সংগ্রহ করে, সেটি ব্যবহার করে গারদখানায় স্বজনদের প্রবেশ করানো হয়। এতে আইনি প্রক্রিয়া লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর প্রভাব পড়ছে। ঢাকা জজকোর্টের আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম বলেন, অনেক সময় দালালদের মাধ্যমে টাকা দিয়ে এসব পাশ সংগ্রহ করে বিচারপ্রার্থীরা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গারদখানায় সাক্ষাতের অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যাতে নিয়মবহির্ভূত প্রবেশ বন্ধ হয় এবং ন্যায়বিচার ব্যবস্থা স্বচ্ছ থাকে। নামছাড়া পাশ দেওয়ার বিষয়ে সিএমএম আদালতের নাজির রেজওয়ান খন্দকার বলেন, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। কোনো পেশকার এমন করে না। এগুলো সব পুলিশ বাহিনী করে টাকা নিয়ে। অনেক সময় আইনজীবীরাও পেশকারদের কথা বলে বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেয়। পিপি যা বললেন : ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক ফারুকী মনে করেন গারদখানায় থাকা আসামিদের বাইরের খাবার খাওয়ানো ঝুঁকিপূর্ণ। যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তিনি বলেন, এই ধরনের খাবার দেওয়া বা টাকা নেওয়ার কোনো বিধান নেই। আসামিদের বাইরের খাবার দিলে তাতে ঝুঁকি আছে। আদালতের অনুমতি ছাড়া খাবার দেওয়া যাবে না। খাবারে কী থাকে তার তো কোনো ঠিক নেই। কারণ সে তো পুলিশের কাস্টডিতে তখন। বাইরের খাবার খেতে দিলে যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এর দায়িত্ব কে নেবে। তিনি বলেন, ওকালতনামায় স্বাক্ষর দেওয়ার জন্য ওদের দায়িত্ব। এতে টাকা কেন নেবে। ডিসি প্রসিকিউশনকে জিজ্ঞেস করেন। আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়া : ঢাকা আদালতের আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম শান্ত বলেন, গারদখানায় আসামিদের সঙ্গে দেখা করা, খাবার দেওয়া কিংবা আইনি কাজের জন্য স্বাক্ষর নেওয়া মৌলিক অধিকার। কিন্তু এসব কাজে ঘুস আদায় করা হয়, যা পুরো ব্যবস্থাকে কলুষিত করছে। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার পাওয়া থেকে আরও দূরে সরে যাবে। তিনি বলেন, আসামির জামিন করানোর পর আসামিকে গারদখানা থেকে ছাড়াতে গেলেও দিতে হয় আরও ৫০০ টাকা। না হলে আসামি ছাড়তে নানা টালবাহানা করে। ঢাকা আইনজীবী সমিতির অ্যাডহক কমিটির সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন, আসামিদের সঙ্গে স্বজনদের দেখা করার জন্য আইনগতভাবে নির্দিষ্ট আদালত আছে। আবেদন দিলে আদালত যাচাই করে অনুমতি দেয়। এতে কোনো টাকা লাগে না। আর যারা খাবার নিয়ে দেখা করতে দেওয়া বা খাবার দেওয়ার মতো কাজ করে এটা অনৈতিক। আর যারা এই অনৈতিক সুবিধা নেয় এটাও অনৈতিক। তিনি বলেন, ওকালতনামায় স্বাক্ষর করার জন্য ২০০ টাকা নয়, ৫০ বা ১০০ টাকা দিলেই হয়। ওকালতনামায় স্বাক্ষর আনতে গেলে একজন সিপাহি ভেতরে গিয়ে স্বাক্ষর নিয়ে আসে। এজন্য চা-পান খাওয়ার জন্য ৫০-১০০ টাকা দেয়। ঢাকা আইনজীবী সমিতির অ্যাডহক কমিটির সভাপতি খোরশেদ মিয়া আলম বলেন, এগুলো থেকে পরিত্রাণের দাবি বহুদিনের। এই ধরনের কাজকর্ম আজকের প্রেক্ষাপটে থাকুক এটা আমরা আশা করি না। এর থেকে পরিত্রাণের সুস্পষ্ট কোনো পথও দেখি না। পুলিশ তো টাকা নেয়ই, অনেক সময় বিচারপ্রার্থীরাও টাকা দেয়। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। ডিসি প্রসিকিউশনকে এদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।