জরুরি সংস্কার শেষে নির্বাচনে যেতে চায় সরকার

৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ১১:০৯ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

অযথা সময়ক্ষেপণ করে ক্ষমতায় থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে জরুরি সংস্কার শেষ করেই নির্বাচনে যেতে চায় সরকার। আর রাজনৈতিক দল নির্বাচন চাওয়ার অধিকার রাখে। শনিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদষ্টো অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, সংস্কার কার্যক্রমের বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেছে। কিছু কিছু সংস্কার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে করা হবে। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়া শুরু হবে। রমজানেও চলবে আলোচনা। এর আগে রাষ্ট্র সংস্কারে গঠিত ছয়টি কমিশনের পক্ষ থেকে শনিবার তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রধান উপদষ্টোর কাছে জমা দেওয়া হয়। এই প্রতিবেদনে সরকারের আশুকরণীয় নিয়ে কিছু সুপারিশ এসেছে। ওই সুপারিশগুলো জানাতেই ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, কমিশনের রিপোর্টগুলোতে তিন ধরনের সংস্কারের প্রস্তাব এসেছে। এর মধ্যে∏স্বল্পমেয়াদি, যা নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়ন করা যায়। দ্বিতীয়ত, মধ্যমেয়াদি, যা রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমতের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন এবং দীর্ঘমেয়াদি হলো∏যা বাস্তবায়নে নির্বাচিত সরকার বা সংসদ লাগবে। প্রধান উপদষ্টোর প্রেস সচিব শফিকুল আলম এবং উপপ্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার এ সময় উপস্থিত ছিলেন। আসিফ নজরুল বলেন, ছয় সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন অনলাইনে আপলোড করা হয়েছে। কমিশনগুলো বিভিন্ন পর্যায়ে সংস্কারের কথা বলেছেন, যা আগামী নির্বাচনের আগে করা যেতে পারে। আশুকরণীয় কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐকমত্যের প্রয়োজন। তিনি বলেন, ছয়টি সংস্কার কমিশন মোট ২ হাজার পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এগুলো ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়েছে। সেখানে সংস্কার প্রস্তাবগুলো আলাদা করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে আশুকরণীয় অর্ধেক সংস্কার প্রস্তাব এক মাসের মধ্যে করে ফেলা সম্ভব। জুলাই ঘোষণাপত্র ইসু্যতে তিনি বলেন, বিএনপি একটি ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করেছে। ছাত্রনেতারা এক্ষেত্রে যথষ্টে সংযমের পরিচয় দিচ্ছে। আশা করি, সবাই প্রক্রিয়াটি বেগবান করার চষ্টো করবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, Èরাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত নির্বাচন চায়। সেটা বলার অধিকার তাদের আছে। কিন্তু আমাদের বক্তব্য এরই মধ্যে পরিষ্কার করা হয়েছে। সরকারে থেকে অযথা সময়ক্ষেপণ করতে চাইছি না। রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে যেসব সংস্কার জরুরি তা শেষ করেই নির্বাচনে যেতে চাই। তিনি আরও বলেন, যে প্রস্তাবগুলো নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়ন করা সম্ভব সেগুলো আমরাই বিবেচনা করব। তবে এগুলো নিয়েও যদি রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনা করতে চায়, সরকার আলোচনা করবে।' মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে আসিফ নজরুল বলেন, Èসরকারের সহনশীলতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণতনে্ত্রর ওপর শ্রদ্ধাবোধের কারণে আওয়ামী লীগ এখনো কর্মসূচি দিতে পারছে।' আইন উপদষ্টো বলেন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন আশুকরণীয় বলতে ছয় মাস বুঝিয়েছে। তবে অবশ্যই এসব সংস্কার আগামী নির্বাচনের আগে করতে হবে। এর কিছু বিষয় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন হতে পারে। আর কিছু বিষয় এতই মামুলি, যে নির্বাহী আদেশে করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, প্রত্যেক আদালতে বিচারপ্রার্থীদের তথ্য দেওয়ার সুবিধা দেওয়ার কথা এসেছে। এর বাস্তবায়নের জন্য কারও সঙ্গে আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন নেই। উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ আইনের কথা বলেছে। এটি আমরা ইতোমধ্যে করে ফেলেছি। এছাড়া আশুকরণীয় সুপারিশে বলা হয়েছে, স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করতে হবে। এই খাতের জন্য নতুন করে আচরণবিধি তৈরি জরুরি। সরকারি সব ধরনের সেবা খাত অবশ্যই ডিজিটাল করতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দুটি প্রতিষ্ঠান। সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, দুটি প্রতিষ্ঠান আলাদা থাকার দরকার নেই। এটি একটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কতর্ৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন কতর্ৃপক্ষ (বেপজা) এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল কতর্ৃপক্ষ (বেজা) পৃথক থাকার দরকার নেই। সবগুলো মিলে একটা করতে হবে। সংস্কার কমিশন নতুন দুটি বিভাগের কথা বলেছে। এগুলো কুমিল্লা এবং ফরিদপুর। ১০টি বিভাগকে পুনর্বিন্যাস করার কথা বলেছে। জেলা প্রশাসককে জেলা কমিশনার এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে উপজেলা কমিশনার। উপজেলা পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট এবং ভূমি রেজিস্ট্রার অফিস সংস্কার করা জরুরি। বর্তমানে ভূমি রেজিস্ট্রেশন অফিস আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করে। কিন্তু ব্যবস্থাপনার অন্যান্য অফিস ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এটি সমন্বয়ে সমস্যা হয়। এজন্য এখানে সংস্কার জরুরি। আইন উপদষ্টো আসিফ নজরুল বলেছেন, ছয় সংস্কার কমিশন তিন ধাপে সংস্কারের সুপারিশ দিয়েছে, স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি। এর মধ্যে যেগুলো স্বল্পমেয়াদি এবং আশুকরণীয়, সেগুলোর ৫০ শতাংশ এক মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। তিনি বলেন, গত ৫৫-৫৬ বছরে রাজনৈতিক দলগুলো বহু সংস্কার করেছে। প্রতিটি দলেরই নিজস্ব সংস্কার ভাবনা রয়েছে। Èরাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি এই সংশয় দূর হয়, এসব সংস্কার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার জন্য নয়, তাহলে অনেক কিছুই বাস্তবায়িত হবে। আইন উপদষ্টো বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র মেরামতের মেৌলিক শর্ত পূরণ করা হবে। রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে যেসব সংস্কার জরুরি, সেগুলো বাস্তবায়ন করে পাশাপাশি আমরা নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চলে যেতে চাই। আসিফ নজরুল বলেন, তার দুটি মন্ত্রণালয়ে প্রায় হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকে জমা রাখা হয়েছিল। যা সাবেক মন্ত্রীদের আত্মীয়দের ব্যাংক বা তাদের সংশি্লষ্ট প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে পদ্মা ব্যাংক ও মধুমতি ব্যাংক অন্যতম। তিনি বলেন, Èএসব বেহাত হওয়া টাকা তুলে আনতে খবর হয়ে যাচ্ছে।' আওয়ামী লীগ আমলে কোনো নিয়মকানুন বা আইন মানা হয়নি। প্রশ্ন রেখে আসিফ নজরুল বলেন, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের টাকা কেন বেসরকারি ব্যাংকে রাখা হবে। আশুকরণীয় : ছয়টি কমিশনের মধ্যে ৫টি কমিশনই আশুকরণীয়ের জন্য সুপারিশ দিয়েছে। তবে সংবিধান সংস্কার কমিশন এ ব্যাপারে কোনো সুপারিশ দেয়নি। পঁাচ কমিশনের সুপারিশের মধ্যে রয়েছে∏ স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন, সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন আচরণবিধি প্রণয়নে গণশুনানি এবং নাগরিকদের অভিযোগ শোনা, নাগরিক কমিটি গঠন, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে স্থায়ী নাগরিক কমিটি, মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা কমানো, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ এবং এনবিআরকে একসঙ্গে এক বিভাগে অন্তভর্ুক্ত করা, কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে নতুন বিভাগ করা, জেলা প্রশাসককে জেলা কমিশনার হিসাবে অভিহিত করা, উপজেলা পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট স্থাপন, সাবরেজিস্ট্রি অফিস সম্পূর্ণ ডিজিটাল করা, পাবলিক সার্ভিস কমিশন পুনর্গঠন, জুডিশিয়াল সার্ভিস সদস্যদের জন্য আচরণবিধি নির্ধারণ, ফেৌজদারি মামলা তদনে্ত আলাদা ফেৌজদারি সার্ভিস, বাণিজ্যিক আদালত গঠন, আদালতে সহায়ক কর্মচারী নিয়োগ, জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে প্রতিটি আদালতে তথ্য ডেস্ক, অনলাইনে যেন পুলিশের সাক্ষ্য গ্রহণের ব্যবস্থা, আদালত প্রাঙ্গণে রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিহারের নিয়ম প্রণয়ন, বিদ্যমান মামলাজট কমাতে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, আইনজীবীদের ফি নির্ধারণ, লিখিত চুক্তি ও রসিদ প্রদান বাধ্যতামূলক করা, যারা তদন্ত করবে তাদের আলাদা ইউনিট থাকবে, পুলিশদের মানবাধিকার ট্রেনিং ও আচরণবিধি প্রণয়ন, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে মানবাধিকার কমিশন তদন্ত করবে, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন, গণমাধ্যম নীতিমালা সংশোধন, অনলাইন ভোটিংয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করা, দুর্নীতিবিরোধী জাতীয় কেৌশল বাস্তবায়নে ন্যায়পাল নিয়োগ, কালোটাকা কোনোদিনও সাদা করা যাবে না সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন, রাজনৈতিক ও নির্বাচনি আইনে স্বচ্ছতায় শুদ্ধাচার চর্চা, বেসরকারি পর্যায়ের ঘুস লেনদেনকে শাসি্তর আওতায় আনা এবং দুদককে আরও শক্তিশালী করতে যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ অন্যতম। প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ১ মাস ৩ দিনের মাথায় গত ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বহুল আলোচিত ৬টি খাত সংস্কারে সুনির্দষ্টি কমিশনের ঘোষণা দেন প্রধান উপদষ্টো ড. ইউনূস। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনের প্রধান করা হয় সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারকে। পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সাবেক জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র সচিব সফর রাজ হোসেন, বিচার বিভাগ সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধান সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, জনপ্রশাসন সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধান সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদষ্টো আবদুল মুয়ীদ চেৌধুরী এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান যুক্তরাষ্ট্রের ইলিয়ন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ। এর মধ্যে গত ১৫ জানুয়ারি ৪ কমিশন রিপোর্ট দিয়েছে। ৫ ফেব্রুয়ারি রিপোর্ট দিয়েছে দুই কমিশন। শনিবার কমিশনগুলো পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিয়েছে। এই রিপোর্টের ওপর আয়োজন করা হয় শনিবারের প্রেস ব্রিফিং। আবার কমিশনগুলো প্রধানদের নিয়ে গঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এই কমিশনের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং সদস্য সচিব অধ্যাপক আলী রীয়াজ। এই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের রিপোর্টের পর প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে শিগগির পরামর্শ করবে সরকার। চূড়ান্ত পর্যায়ে শিক্ষার্থী, নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, সরকারের প্রতিনিধি নিয়ে তিন থেকে সাত দিনব্যাপী একটি পরামর্শসভার ভিত্তিতে সংস্কার ভাবনার রূপরেখা চূড়ান্ত করা হবে।