মার্কেট-কাঁচাবাজারে সন্ত্রাসীদের থাবা

৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ১২:১০ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেট ও কাঁচাবাজারের নিয়ন্ত্রণ ছিল আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের হাতে। তাদের সঙ্গে যোগসাজশ ছিল একশ্রেণির শীর্ষ সন্ত্রাসীর। তৎকালীন সরকারদলীয় স্থানীয় নেতাকর্মী ও আওয়ামীপন্থি সন্ত্রাসীরা মার্কেট ও কাঁচাবাজার থেকে নিয়মিত চাঁদা তুলত। এর ভাগ পেতেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসাধু কর্মকর্তারাও। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পালিয়ে যায় অনেকেই। গা ঢাকা দেয় তাদের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীরা। কিন্তু তাদের স্থান দখল করে অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সন্ত্রাসীদের নানা গ্রুপ। এদের অনেকেই দীর্ঘদিন ছিলেন জেলে। স্বৈরাচারের পতনের পরই তারা জেল থেকে ছাড়া পান। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন কতিপয় অসাধু পুলিশ সদস্য (যারা পদায়নের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন বঞ্চিত ছিলেন এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দায়িত্ব পেয়েছেন)। অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, ক্ষমতার পালাবদলের পর অনেক সন্ত্রাসী জামিনে বের হয়েছেন কারাগার থেকে। জামিনপ্রাপ্তদের মধ্যে সরকারের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী আছেন ১১ জন। তাদের মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছেন সানজিদুল ইসলাম ইমন, নাঈম আক্তার টিটন ও রাসু। হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন আরমান পিচ্চি হেলাল, হাবিবুর রহমান তাজ, আক্তার হোসেন, সোহেল প্রমুখ। কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ থেকে মুক্তি পেয়েছেন কিলার আব্বাস ও শাহাজাদা সাজু। আরও কিছু সন্ত্রাসী জামিনের অপেক্ষায় আছেন। কারামুক্ত সন্ত্রাসী এবং মুক্তির অপেক্ষায় থাকা সন্ত্রাসীরা ইতোমধ্যেই অনেক মার্কেট-বাজারের চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। বাকিগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, বনশ্রী ‘এ’ ব্লকের কাঁচাবাজারটি লিজ নিয়ে পরিচালনা করতেন ব্যবসায়ী সাব্বির আহমেদ। গত ৫ আগস্টের পর থানা পুলিশ, রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাকর্মী ও সন্ত্রাসীদের ম্যানেজ করে কিছুদিন ব্যবসা পরিচালনা করেন তিনি। একপর্যায়ে সন্ত্রাসী টোকাই আলামিন ওরফে পিচ্চি আলামিনের নেতৃত্বে বাজারটি দখলে হয়ে যায়। তার সঙ্গে আছে ঘাতক স্বপনের (ক্রসফায়ারের) বড় ভাই রিপন, সন্ত্রাসী তুষার ওরফে ভাগনে তুষার, অহিদ মিয়া ওরফে ইয়াবা ওহিদ (সম্প্রতি গ্রেফতার হয়েছেন), রাকিব ওরফে ভাইস্তা রাকিব, সুন্দরী জুয়েল, বায়েজিদ, মহসিন প্রমুখ। পিচ্ছি আলামিন ও ভাগনে তুষারের নামে বেশ কয়েকটি অস্ত্র, চাঁদাবাজি, মাদক ও হত্যা মামলা আছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা পলাশের আপন ভাগনে তুষার। বাজার দখলের সময় একটি সিসি ক্যামেরা ফুটেজে দেখা যায়, একজন ব্যবসায়ীকে দিনের আলোতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ধাওয়া করছে আলামিন। গত ১০ জানুয়ারি বাজারের ম্যানেজার ফারুককে মারধর করে সব টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নিয়ে কুমিল্লা গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় সন্ত্রাসীরা। এ বিষয়ে রামপুরা থানায় একটি জিডি দায়ের করেন ম্যানেজার ফারুক। জিডির তদন্তে অগ্রগতি না হওয়ায় থানায় মামলা করতে চান ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী। কিন্তু বেশ কয়েকদিন ঘুরেও মামলা রেকর্ড করা সম্ভব হয়নি। সূত্র জানায়, আগস্টের পর থেকে রামপুরা থানার ওসিকে প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দিতেন সাব্বির। আলামিন বাজারটি দখলের পর প্রতি মাসে ওসিকে ৫০ হাজার করে টাকা দেন। এ কারণে ওসির অবস্থান আলামিনের পক্ষেই। বারবার অভিযোগ করেও সাব্বির থানা থেকে কোনো সুফল পাচ্ছিলেন না। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য একটি ইউনিট অভিযান চালিয়ে পিচ্চি আলামিনের সহযোগী ওহিদকে গ্রেফতার করে। এ সময় অন্যরা পালিয়ে যায়। এই সুযোগে সাব্বির বাজারটি দখলে নেওয়ার চেষ্টা চালালেও ওসির অসহযোগিতায় সম্ভব হচ্ছিল না। মঙ্গলবার সাব্বির তার লোকজন নিয়ে বাজারটি দখল করে নেয়। এ সময় পিচ্চি আলামিনের সহযোগী মধুকে আটক করে থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে এলাকাবাসী। পাশাপাশি মামলার জন্য এজাহার দাখিল করা হয়। কিন্তু থানা পুলিশ মামলা নেয়নি। উপরন্তু ছেড়ে দেয় মধুকে। জানতে চাইলে রামপুরা থানার ওসি আতাউর রহমান আকন্দ বলেন, আমার বিরুদ্ধে বাজার থেকে টাকা নেওয়ার যে অভিযোগ করা হয়েছে তা সঠিক নয়। তিনি বলেন, বাজারের দখল-বেদখলকে ঘিরে তিনটি মামলা হয়েছে। এগুলোর তদন্ত চলছে। নতুন করে কোনো অভিযোগ আমার কাছে আসেনি। যারাই মামলা করতে আসবেন, আমি তাদের মামলাই নেব। তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেব। টিকাটুলিতে অবস্থিত রাজধানী ও নিউ রাজধানী সুপার মার্কেট। এই মার্কেটটি দীর্ঘদিন সাবেক কাউন্সিলর ময়নুল হক মনজুর দখলে ছিল। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় মনজু গ্রেফতার হলে এই মার্কেটটি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পরে ফজলুল হক বিপ্লব ও আশরাফ উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিটি এই মার্কেটি পরিচালনা করছিল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিএনপি নেতা মকবুল ইসলাম টিপুর নেতৃত্বে এটি দখলের প্রক্রিয়া চলছে। ইতোমধ্যেই টিপুর নেতৃত্বে ১৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে শ্রম অধিদপ্তরের পরিচালকের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। ১৯ জানুয়ারি ওই কমিটি জমা দেওয়া হয়। এর আগে ৯ জানুয়ারি নিজেদের কমিটি জমা দেয় বর্তমান কার্যনির্বাহী কমিটি। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে চলছে উত্তেজনা। এ বিষয়ে গত ৪ ফেব্রুয়ারি ওয়ারী থানায় বর্তমান কার্যনির্বাহী কমিটির পক্ষে একটি জিডি করেছেন কোষাধ্যক্ষ সাঈদ মোল্লা। জিডিতে উল্লেখ করা হয়, দীর্ঘদিন ধরে মার্কেটটি দখলের পাঁয়তারা চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৩ ফেব্রুয়ারি নিজামুল হক, মোবারক হোসেন, আক্তার হোসেন ও আব্দুল মান্নান মার্কেটের অফিস দখলের হুমকি দেয়। জানতে চাইলে মকবুল ইসলাম টিপু বলেন, রাজধানী ও নিউ রাজধানী সুপার মার্কেটে এই মুহূর্তে কোনো বৈধ কমিটি নেই। বৈধ ছিলেন ময়নুল হক মনজু। কিন্তু তিনি মানুষজনের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতেন। তাই তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে বিপ্লব-আশরাফের নেতৃত্বাধীন কমিটি অবৈধভাবে মার্কেট দলে করে আছে। এ কারণে আমরা একটি কমিটি করে শ্রম অধিদপ্তরে জমা দিয়েছি। বলেছি, আমাদের কমিটি অনুমোদন দিন। না হলে নির্বাচন দিন। কিন্তু শ্রম অধিদপ্তর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। শ্রম ও কর্মসংস্থান অধিদপ্তরের পরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জান বলেন, মার্কেট দখল-বেদখলকে ঘিরে তিনটি মামলা চলমান। এর মধ্যেই আমার কাছে দুটি কমিটি জমা দেওয়া হয়েছে। মামলাগুলোর সবশেষ অবস্থা জানার চেষ্টা করছি। এরপর যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। রাজধানীর নীলক্ষেত এলাকার গাউসুল আজম সুপার মার্কেটের মালিক মোতালেব মিয়া। গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের সুযোগে মোতালেব মিয়াকে ভয় দেখিয়ে সাবেক ছাত্রদল নেতা মার্কেটটি দখল করে । এ বিষয়ে নিউমার্কেট থানার ওসি মহসীন উদ্দিন বলেন, দখলের পর আমার কাছে দুই পক্ষই এসেছিল। বেশ কিছুদিন ধরে কেউ আসছে না। মনে হয়, উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়ে গেছে।